শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪
আধুনিক কবিতার ভবিষ্যৎ
Home Page » সাহিত্য » আধুনিক কবিতার ভবিষ্যৎকবি:আ ল মা হ মু দ
আমাদের দেশে সবচেয়ে দিশেহারা অবস্থা সম্ভবত এখন তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের। কোনো একটা দলের সদস্য না হতে পারলে প্রকাশপ্রবণ তরুণ লেখকদের কবি হিসেবে, কথাশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগসন্ধান দুরূহ হয়ে পড়েছে। ফলে আমাদের জাতীয় সাহিত্যের অঙ্গনে এখন এক সর্বব্যাপী হতাশার অন্ধকার নেমে এসেছে। আর এই হতাশার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি তাদের কবিতায়, গল্পে ও প্রবন্ধে।
আমি মাঝে মধ্যে কখনো ইচ্ছায় আবার কখনো অনিচ্ছায় এই শহরের নানা সাহিত্যসভায় যোগ দিতে বাধ্য হই। একেবারেই বাধ্য হয়ে ওই সব সভায় যাই এটা অবশ্য বলা ঠিক হবে না। আমারও সামান্য কৌতূহল থাকে। আমি জানতে চাই সাম্প্রতিক সাহিত্য আন্দোলন কোন দিকে মোড় ফিরছে। কারা সমসাময়িক কালের প্রকৃত কবি। তাদের রচনাধারা বা স্টাইল কেমন। তারুণ্যের সতেজ উদ্ভাবনা শক্তি কী কী নতুন, অভাবনীয় বিষয় আমাদের আধুনিক কবিতার একঘেয়ে অতিকথনের জঞ্জালকে সরিয়ে ঝলকিয়ে উঠেছে। এসব জানার আগ্রহই অনেক সময় শারীরিক কান্তি ও মানসিক স্থবিরতাকে কাটিয়ে আমাকে একধরনের লোভে কম্পমান রাখে। মূলত এ জন্যই আমি নানা ধরনের ছোট সাহিত্যগোষ্ঠী কিংবা শৌখিন কবি-সাহিত্যিকদের পারিবারিক সাহিত্য আড্ডায় হাজির হই।
এতে আমার সাহিত্যিক অনুসন্ধিৎসা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিতৃপ্ত না হলেও, এ শহরের অনেক নিঃস্বার্থ সাহিত্যিপ্রেমিক যুবক-যুবতী, অবিচল সাহিত্যপাঠক, ভাবুক, দার্শনিক, প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ও সুখী গৃহবধূর অকৃত্রিম বিনয় ও ভালোবাসার পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই।
১৯৫৪-৫৫ খ্রিষ্টাব্দে আমি যখন ঢাকা আসি তখন এ ধরনের পরিচ্ছন্ন সাহিত্য রুচিসম্পন্ন পরিবার কদাচ দৃষ্টিগোচর হতো। একেবারেই ছিল না, এ কথা অবশ্য বলছি না। তবে আমার মতো সদ্য শহরে আগত তরুণ কবিযশপ্রার্থীদের তারা ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর আমারও ছিল কবিসুলভ গ্রাম্য সঙ্কোচ। সপ্রতিভ কোনো পরিবেশেই বেশিক্ষণ মানিয়ে নিতে পারতাম না। শুধু আড়াল খুঁজতাম এবং একটি নতুন কবিতা লেখার অবকাশ চাইতাম। কবিতাটা লিখে ফেললেই যে দুশ্চিন্তা কাটত এমন নয়। রচনাটি প্রকাশ করারও একটা দায় ছিল। এই দায়টাই আমাকে বেশি করে ভোগাত। অন্যান্য বন্ধুর মতো অতি সহজে আমি কবিতা বা গল্প হাতে নিয়ে কোনো পত্রিকা সম্পাদকের দফতরে ধর্ণা দিতে পারতাম না। বরং ডাকে লেখা পাঠিয়ে অপেক্ষা করতাম, কখন ছাপা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছাপা হতো না। তবে মাঝে মধ্যে অলৌকিক ঘটনার মতো অভাবনীয় ঘটনাও ঘটে যেত। যেমন ঢাকার একটি তৎকালীন প্রখ্যাত পত্রিকার ততোধিক প্রখ্যাত সম্পাদক আমার একটি কবিতা অমনোনীত করে ফিরিয়ে দিলে আমি লেখাটি কলকাতার একটি বিখ্যাত কবিতা পত্রিকায় সুবিচারের আশায় পাঠাই। লেখাটা সেখানে সযতেœ ছাপা হয়। পরবর্তীকালে তিরিশের একজন খ্যাতনামা কবি তার এক প্রবন্ধে সমসাময়িক আধুনিক সাহিত্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে ওই রচনাটির কথা উল্লেখ করেন।
আজকাল আমাদের সাহিত্যে অপেক্ষার কোনো ব্যাপার নেই। অপেক্ষার কথা ওঠে যদি লেখাটা অমনোনীত হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে। আমাদের দেশে মানবরচিত সব বিষয়ই মূলত মুদ্রণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় এমনকি সাহিত্যেও। এহেন অবস্থায় তরুণ লেখক-লেখিকাদের সাহিত্য আড্ডায় কী ধরনের আলোচনা-সমালোচনা ও সাহিত্যধারণা ব্যক্ত হয় তা জানতে স্বভাবতই আমার মতো অরাজনৈতিক লেখকের অপরিসীম আগ্রহ থাকে। এই আগ্রহের টানেই আমি সাধারণত আমন্ত্রিত হলে সাহিত্যের গোষ্ঠীগত পারিবারিক আসরগুলোতে উপস্থিত হই। এই উপস্থিতি খুবই অনিয়মিত হলেও আমার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। মূল্যবান এই অর্থে যে, সমকালীন সর্বপ্রকার সাহিত্যতৃষ্ণা, এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পাদকদের সাহিত্য প্রকাশের জন্য বিনিময় পাওয়ার চাপ সৃষ্টি ও নিজের চার পাশে প্রতিভাহীনদের আসর জমানোর অদৃশ্য শর্তের কথা আমি জানতে পারি। আর জানতে পারি আমাদের সমকালীন কবিদের রচনাগুলোর দুর্বলতা। অনুকরণ, অশুদ্ধ ছন্দ, পুনরুক্তিতে ভারাক্রান্ত, এক অদ্ভুত ধরনের পদ্যের দৌরাত্ম্য দেখে মনে হয় আমাদের সমকালীন কাব্যপ্রয়াস হয় জাহান্নামে গেছে কিংবা আমিই বুঝি সকমালীন কাব্যপ্রয়াসের আধুনিকতার দিকটি ধরতে পারছি না। সম্ভবত চিন্তার দিক দিয়ে আমিই তারুণ্যের সাথে ঠিক পাল্লা দিতে পারছি না। কিন্তু যখনই আলাপছলে এদের কাব্যসিদ্ধির পরিধি নিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হয়েছি, তখনই জানতে পেরেছি এরা এমনকি ছন্দ সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণাও রাখে না। ছন্দের দুর্বলতা ঢাকতে অনেকেই গদ্যছন্দকে অবলম্বন করে, যা লিখছে সেটাকেই আধুনিক কবিতার সাম্প্রতিক আঙ্গিক বলে চালাতে চাইছে। গদ্যেরও যে একটা বহমানতা বা ছন্দ আছে এটাও এদের আয়ত্তে নেই। অথচ এরা এদের নিকট-দূর প্রায় সব পূর্বসূরিরই সমালোচক। সবার কৃতিত্বকেই এরা অস্বীকার করে। অস্বীকারের মধ্যেই এরা এদের সাহিত্যপ্রতিভার বিজয় দেখতে পায় এই বিজয়ের জন্য এরা এমন কোনো কাজ নেই যা করতে পারে না। জীবনের কোনোরূপ জিজ্ঞাসা এদের আকুল করে না। এরা সব সময়েই দলবদ্ধ অবস্থায় থাকে এবং দলবদ্ধ কাব্যরুচিতে আস্থাশীল। সাহিত্যের জন্য, ভাষা শিল্পের গতি ও কাব্যে উপমার জন্য যে কবিকে সম্পূর্ণ এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঞ্চয় ব্যয় করতে হয়, এরা তা জানে না কিংবা বলা যায় জানলেও এর ধার ধারে না। এরা সাহিত্যকে একটা সহজ সাফল্যের বিষয় হিসেবে ধরে নিয়েছে। এখন এ সময় কবিতা রচনা হলো একদল বিশ্ববিদ্যালয় পড়-য়া গ্রাম্যবালকের এ শহরের চৌহদ্দিতে নাগরিক বখাটেপনার সর্বশেষ উপায় মাত্র। এদের সার্থকভাবে কবি মাত্রই প্রতিরোধ করতে চাইবেন। কিন্তু প্রকৃত কবিদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভক্তির সুযোগে এরা অতি সহজেই কবিদের দ্বিধাবিভক্ত সংগঠনের অভ্যন্তরে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। শুধু প্রবেশাধিকারই নয় পিঠ চাপড়ানি, লিখিতভাবে কবি স্বীকৃতি ও প্রকাশ্য মঞ্চে ধীমান কবিদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের আজীবন পরিশ্রমে সঞ্চিত সাহিত্যিক মূল্যবোধকে তুচ্ছজ্ঞানে পাশে ঠেলে শুয়োরের মতো হেঁড়ে গলায় খেউড় পাঠ করে হাত তালিতে নেচে উঠছে। এই হলো আমাদের সমকালীন সাহিত্যের সামান্য পরিণাম।
হয়তো আমার এই রচনা পাঠ করে কারো কারো ধারণা হতে পারে আমি বুঝি ক্ষোভ ও হতাশার কথা বলতেই এই তির্যক প্রবন্ধ রচনায় হাত দিয়েছি। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, আমার কবিজীবন ও ব্যক্তিগত জীবন কোনোভাবেই হতাশাগ্রস্ত নয়। বরং সব কিছুরই মধ্যে আশাকে নিয়ে বেঁচে থাকাই আমার অভ্যেস।
চিরকালই আমি আমার ব্যক্তিগত বসবাসের কুঠুরিতে একটি উন্মুক্ত বাতায়নের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি।
আর সেই জানালা দিয়ে দেখতে পাই অপেক্ষমাণ প্রকৃত কবিদের মুখ, হট্টগোল থেকে তারা তাদের দূরে সরিয়ে রেখেছেন। আমার মত নিরুপায়ভাবে তারা বিভক্তির শিকার নন কিংবা নিজস্ব আদর্শগত অভিমতের জন্য তারা বিচ্ছিন্নও নন। তবুও তাদের হাতেই আমাদের আধুনিক কবিতার ভবিষ্যৎ একদিন উজ্জ্বল হয়ে উঠবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
বাংলাদেশ সময়: ২২:৫৪:৪০ ৩৮২ বার পঠিত