মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট ২০১৪
বিচারপতি নিয়োগ কমিশনের ভারত মডেল
Home Page » বিবিধ » বিচারপতি নিয়োগ কমিশনের ভারত মডেলবঙ্গনিউজ
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা একটি উদার গণতান্ত্রিক ধারণা। আধুনিক গণতন্ত্র মানে এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে স্বাধীন বিচার বিভাগ তার স্বমহিমায় উদ্ভাসিত।
‘স্বাধীন বিচার বিভাগ’র ধারণাটি যেসব রাষ্ট্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, আদতে তারাই প্রকৃত গণতন্ত্রের সুফল ভোগ করছে।
আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত স্বাধীনতার পর থেকেই গণতন্ত্র চর্চ্চা করে আসছে। তবে আজকের যে শক্তিশালী গণতন্ত্র সেখানে বিরাজ করছে তা একদিনে হয়নি। ক্রমাগত চর্চ্চা ও পরিশীলনের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক গণতান্ত্রিক ভারত।
স্বাধীন বিচার বিভাগই ভারতের গণতান্ত্রিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। সেখানে বিচার বিভাগ এর কার্যক্রমে নির্বাহী বিভাগ ও আইন বিভাগ থেকে প্রভাবমুক্ত থাকতে পারে। রাষ্ট্রপতি বিচার বিভাগের অভিভাবক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।
বিচার বিভাগের জবাবদিহিতাও রাষ্ট্রপতির কাছে (পরোক্ষভাবে নির্বাহী বিভাগের কাছে) কারণ, রাষ্ট্রপতি নির্বাহী বিভাগেরই অধীন। এভাবে বললে, বিচার বিভাগ নিবার্হী বিভাগের কাছে দায়বদ্ধ। বর্তমান ভারতের রাজনীতি চায়, এ দায়বদ্ধতাকে আরো পাকাপোক্ত করতে।
সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান করেছে। তবে এই নিয়োগ কি ভিত্তিতে হবে সেটিও সংবিধানেই বলা আছে।
কাজেই রাষ্ট্রপতি সংবিধানের আলোকেই বিচারপতি নিয়োগ দেন। কেবল সুপ্রিম কোর্টই নয়, হাইকোর্টের বিচারপতিদেরকেও রাষ্ট্রপতিই নিয়োগ দেন। তবে উভয় ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপতিকে প্রধান বিচারপতি, রাজ্যের গর্ভনর ও হাইকোর্টের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পরামর্শ গ্রহণ করতে হয়।
পরামর্শ গ্রহনের বিষয়টি রাষ্ট্রপতির জন্য বাধ্যকর হলেও তা একইভাবে রাষ্ট্রপতির জন্য সহযোগী ভূমিকা পালন করে। কারণ, রাষ্ট্রপতি যাতে বিচার বিভাগের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে পারেন ও সে উদ্দেশে যোগ্য বিচারপতি নিয়োগ দিতে পারেন সেই জন্যই পরামর্শ গ্রহণ করার বিধান।
আবার, রাষ্ট্রপতি পরামর্শ গ্রহণ করেছেন কিনা বা কতটুকু গ্রহণ করলেন সেটি একান্ত রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। এ এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন করার এখতিয়ার কারো নেই।
পাশাপাশি বিচারপতিদের নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ক পরামর্শ দেখভাল করার জন্য ভারতে রয়েছে একটি জাতীয় কমিশন।
বিচারপতি নিয়োগের দুই দশকের এ রেওয়াজটিতে সম্প্রতি ছেদ টানতে যাচ্ছে লোকসভা। বিচারপতি নিয়োগের জন্য একটি নতুন আইন পাশ করা হয়েছে। নতুন আইনে বিচারপতি নিয়োগ করবেন জাতীয় বিচার বিভাগীয় কমিশন (National Judicial Commission)। অর্থাৎ আইনানুযায়ী নতুন একটি কমিশন গঠন করার কথা বলা হচ্ছে।
বর্তমানে বিচারপতি নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। তবে সেখানে পরামর্শের একটি বিধান আছে কিন্তু নির্বাহী বিভাগের কোনো ভূমিকা নেই।
নতুন আইনানুযায়ী কমিশেন নির্বাহী ও বিচার বিভাগের সদস্যরা থাকবেন। সহজ কথায়, নির্বাহী বিভাগের অন্তভূক্তি হয়েছে এই আইনে যা আগে ছিল না।
কমিশনের প্রধান হিসেবে প্রধান বিচারপতিকে রেখে তারই অধ:স্তন আরো দুইজন বিচারপতি, আইনমন্ত্রী ও রাষ্টপ্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত আরো একজন সদস্য নিয়ে কমিশন গঠন করা হবে।
২০০৩ সালের আইন ও পরবর্তীকালের দ্বিতীয় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবও একই রকম ছিল। সংস্কার কমিশনের মধ্যও নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের যৌথ ভূমিকার কথা বলা আছে।
সেখানে প্রধান বিচারপতির মাধ্যমেই হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ দেয়ার কথা বলা আছে। কাজেই, বর্তমান প্রস্তাবিত জুডিশিয়াল কমিশনও আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সদস্যদের নিয়েই গঠিত।
বিচারক নিয়োগের এ পদ্ধতি ভারতে নতুন হলেও অনেক দেশেই প্রচলিত। যুক্তরাজ্য, আমেরিকা ও ফান্সে বিচারপতি নিয়োগ করা হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। কখনো কখনো সিনেট ও রাষ্ট্রপতি সরাসরি এ নিয়োগ প্রদান করেন।
তবে, নিয়োগ হওয়ার পরে বিচারকরা কখনো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবান্বিত হন না। সিনেট বা দলগুলো সে চেষ্টাও কখনো করে না। আর বিচারকরা নিজেরা স্বাধীনতার চর্চ্চা করেন। ফলে এ নিয়ে কখনো বড় বিতর্ক হতে দেখিনা। কারণ, বিচার বিভাগের মর্যাদার প্রশ্নটি উপলব্ধির বিষয়, শক্ত আইন করেও এর মর্যাদা রক্ষা করা যায় না। আবার জনগণ ও দেশের রাজনৈকিত সংস্কৃতি এ মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন করতে পারে, আইনের কিছু ব্যত্যয় সেখানে থাকলেও।
সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রুমা পাল বিচারপতি নিয়োগের আগের পদ্ধতির সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘the process by which a judge is presently appointed to the high court or the Supreme Court is “one of the best kept secrets in the country”. তবে ভিএন খারে এর সাথে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন।
১৯৯৩ সালের আগে নিয়োগ ক্ষমতা যখন নির্বাহী বিভাগের কাছে ছিল তখনও অনেক বিখ্যাত ও বিজ্ঞ বিচারক নিয়োগ হয়েছে। বিচার বিভাগ সমৃদ্ধ হয়েছে। কাজেই খারে ও রুমা পাল ভিন্ন মত পোষণ করলেও বিচারক নিয়োগের আগের দুটি পদ্ধতিই সফল ছিল।
কাজেই, নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ ছাড়া যেমন এতদিন ভালো বিচারক নিয়োগ হয়েছে, তেমনি ১৯৯৩ সালের আগে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপেও ভালো বিচারক নিয়োগ পেয়েছে।
তাই, ভারতে বিচারক নিয়োগের পদ্ধতিটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেখানে বিচার বিভাগের গুরুত্ব ও মর্যাদা অন্য সব বিভাগগুলো উপলব্ধি করতে পারে।
প্রস্তাবিত National Judicial Appointments Commission (NJAC) গঠনের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাহী ও বিচার বিভাগের সমান অধিকার প্রয়োগের পথ প্রশস্ত হলো। আবার অন্যভাবে বললে, নির্বাহী বিভাগের খবরদারীও বাড়লো। এখন প্রশ্ন হলো, ভারতের নির্বাহী বিভাগ বা রাজনৈতিক দলগুলো এ ক্ষমতা কীভাবে প্রয়োগ করবে? ক্ষমতা প্রয়োগের এই রকমফেরের ওপরই নির্ভর করে আগামী দিনের ভারতের বিচার বিভাগ।
কারণ, নির্বাহী বিভাগ নিয়োগের ক্ষেত্রে হ্যা বা না ভোট দিতে পারবে। শুধু তাই নয়, প্রধান বিচারপতির নিয়োগও প্রদান করতে পারবে এই কমিশন। সেই সাথ তাদের অপসারণ ও বদলির ক্ষমতাও থাকবে কমিশনের হাতে।
কমিশনের ৬ সদস্যদের মধ্যে তিন জন নির্বাহী বিভাগের অর্ন্তভূক্ত। ৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিশনের প্রধান থাকবেন প্রধান বিচারপতি, তার পরের দু্ই জন বিচারপতি, আইনমন্ত্রী ও অন্য দুই জন নাগরিক। আর দুই জন্য নাগরিক নির্ধারণ করবেন প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী। এই দুই দজনের মেয়াদ হবে তিন বছর, তাদের মধ্যে একজন হবেন নারী, অথবা তফশিলিভুক্ত সম্পদ্রায়ের অথবা সংখ্যালঘূ সদস্য।
হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে বার কাউন্সিল, সিনিয়র আইনজীবী, সম্মানিত নাগরিক ও হাইকোর্টের অন্যান্য বিচারকদের সাথে পরামর্শ করার পথ প্রশস্ত আছে।
তারা সবাই কমিশনের কাছে প্রস্তাব করতে পারে। রাজ্যের গর্ভনর ও মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করাও বাধ্যতামূলক। কাজেই, হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগের কব্জায়। সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রে এখন সেই পথটি অনুসরণ করার চেষ্টা হচ্ছে।
তবে, এই সংশোধনীতে যে মৌলিক সাংবিধানিক প্রশ্নটি এসেছে, তাহলো, সংশোধনীর ফলে সংবিধানের মৌল কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি-না। রাষ্ট্রীয় মৌলিক কাঠামোর মধ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বিচারিক পর্যবেক্ষণের Judicial review) বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত।
এই প্রশ্নে বিচারক নিয়োগ ও বদলির বিষয়টি অবশ্যই রাষ্ট্রের সেই মৌলিক কাঠামোক আঘাত করে। আর সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে বিচার বিভাগকেই এ প্রশ্নের সমাধান করতে হবে।
আর অন্যদিকে নতুন প্রস্তাবটির বৈধতা বা যুক্তি প্রমান করতে হলে অবশ্যই নির্বাহী বিভাগকে প্রমান করতে হবে কেন এই পরিবর্তন? সেই সাথে প্রশ্ন আছে, বিচার বিভাগ কি এতোদিনের প্রচলিত পন্থায় নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে? যদি না হয়, তবে কেন এ পরিবর্তন।
Kesavananda Bharati vs State of Kerala (যে মামলার মাধ্যমে রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো বিষয়টি সুরাহা হয়) মামলায় বলা হয়, Judicial appointments commission without consulting the court may invite judicial wrath, and even lead to a constitutional crisis.” ভবিষ্যতে এ আইনটি আদৌ কোনো সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক সমস্যার সৃষ্টি করে কিনা তা সময়ই বলে দেবে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কোনো হানি না করে নিবার্হী বিভাগের ক্ষমতার চর্চ্চাই এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে পারে। আর এ কাজটি করতে হলে, বিচার বিভাগকে আস্থায় আনার কোনো বিকল্প নেই।
এদিকে, বিলটির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টেই রিট করা হয়েছে। বিচারপতি আর দেব, চিলামেশ্বর ও একে সিক্রির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ আবেদনটি নাকচ করে দিয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নতুন আইনে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কালক্ষেপণ হবে না। সম্পর্কের ভিত্তিতে বিচারক নিয়োগ বন্ধ হবে।
আইনটির ধারা ৫ ও ৬ অনুযায়ী শুধু সবচেয়ে সিনিয়র বিচারপতিকেই প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করার পথ রুদ্ধ হলো। যদি তিনি যোগ্য না হন তবে তিনি প্রধান বিচারপতি হতে পারবেন না।
আদালত বলছে, বিষয়টি নিয়ে এখনো রিট করার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়নি। তবে, ভবিষ্যতে এ নিয়ে আবেদন গ্রাহ্য হতে পারে।
তার মানে বিচার বিভাগ তার নিজের স্বাধীনতা খর্ব হবে বলে এখনো মনে করছে না। কারণ, আদালত যদি মনে করে তার নিজের স্বাধীনতা খর্ব হতে যাচ্ছে তবে কোনো বিল পাশ হওয়া অবস্থাতেই তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে। ১৯৭৮ সালে একটি মামলায় এমন সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট নিশ্চয় সে রায় ভুলে যায়নি।
তাই, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিচার বিভাগের নিয়োগ সংক্রান্ত এমন একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কি উদারতার পরিচয় দিচ্ছে নাকি বিষয়টি ভারতের মজবুত গণতান্ত্রিক চেতনারই বহি:প্রকাশ তা সময়ই বলে দেবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৪
বাংলাদেশ সময়: ১৯:২২:৫৪ ৪১০ বার পঠিত