বৃহস্পতিবার, ১০ জানুয়ারী ২০১৩
২৬ হাজার স্কুলের দায়িত্ব সরকারের
Home Page » জাতীয় » ২৬ হাজার স্কুলের দায়িত্ব সরকারেরশিক্ষকদের প্রায় দুই দশকের আন্দোলনের পর দেশের ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের চূড়ান্ত ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।এখন যত্রতত্র স্কুল গড়ে তুললে হবে না। প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিভাবে হবে। কোথায় প্রাথমিক বিদ্যালয় হবে তা আমরা দেখব। যেগুলো বেসরকারি আছে, সেগুলো থাকবে।
বুধবার জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের এক মহাসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “২৬ হাজার ২০০ বিদ্যালয়ের এক লাখ চার হাজার বেসরকারি শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ হয়ে গেল।”
এর মধ্যে ২২ হাজার ৯৮১টি বিদ্যালয়ের ৯১ হাজার ২৪ জন শিক্ষক চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকেই সরকারের আওতায় চলে আসলেন। এজন্য ২০১২-১৩ অর্থবছরে সরকারের বাড়তি খরচ হবে একশ কোটি টাকা।
শেখ হাসিনা বলেন, “আপনারা চেয়েছিলেন শুধু রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ। আমরা যে শুধু রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করছি তা নয়। আমরা স্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এমপিও বহির্ভূত কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সরকারি অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত এনজিও বিদ্যালয়, পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত বিদ্যালয় এবং স্থাপিত কিন্তু চালুর অনুমতির অপেক্ষাধীন বিদ্যালয়সমূহ সরকারি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।”
স্থায়ী/অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত, কমিউনিটি এবং সরকারি অর্থায়নে এনজিও পরিচালিত দুই হাজার ২৫২টি বিদ্যালয়ের নয় হাজার ২৫ জন শিক্ষককে ১ জুলাই থেকে এবং পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত এবং পাঠদানের অনুমতির অপেক্ষায় থাকা ৯৬০টি বিদ্যালয়ের তিন হাজার ৭৯৬ জন শিক্ষককে তৃতীয় ধাপে আগামী বছর ১ জুলাই জাতীয়করণের আওতায় আনা হবে।
দ্বিতীয় ধাপের জাতীয়করণের জন্য ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে সরকারের বাড়তি ৩৭১ কোটি টাকা এবং তৃতীয় ধাপে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬৫১ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
শিক্ষক সমাবেশে শেখ হাসিনা বলেন, “এখন যত্রতত্র স্কুল গড়ে তুললে হবে না। প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিভাবে হবে। কোথায় প্রাথমিক বিদ্যালয় হবে তা আমরা দেখব। যেগুলো বেসরকারি আছে, সেগুলো থাকবে।”
বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে এই মহাসমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী আফসারুল আমিন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সচিব এম এম নিয়াজউদ্দিন এবং সংগঠনের মহাসচিব মনসুর আলী।
প্যারেড স্কোয়ারে নির্মিত বিশাল শামিয়ানা ছাড়িয়ে হাজার হাজার শিক্ষক দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার এই বক্তব্য শোনেন।
বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির অধিকাংশ সদস্য এই সমাবেশে অংশ নেন বলে সংগঠনের মহাসচিব মনসুর আলী জানান।
বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর জাতীয়করণের এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই সমিতি বিলুপ্ত হলো। এই সমিতির সকল সদস্য এখন থেকে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সদস্য।”
শিক্ষকদের জাতি গড়ার মূল কারিগর অভিহিত করে শেখ হাসিনা বলেন, শিক্ষকরাই একটি জাতিকে গড়ে তুলতে পারেন।
“স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৩ জন শিক্ষক-কর্মচারীসহ ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে জাতির পিতা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারলে, আমরা কেন পারবো না”, বলেন তিনি।
শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, “১৯৯১ সালে শিক্ষকরা এই দাবিতে অনশন করেন। আন্দোলনে একজন শিক্ষক যখন মারা গেলেন তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী যিনি এখনকার বিরোধীদলীয় নেতা তার সুগন্ধা কার্যালয়ে একটি উৎসব করছিলেন।”
তিনি দাবি করেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার স্বাক্ষরতার হার বাড়িয়ে গেলেও পরে বিএনপি আমলে তা কমে যায়। ভর্তির পর ঝরে পড়া রোধ করতে শিশুদের উপবৃত্তি দেয়ার কথাও মনে করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী।
নিজ উদ্যোগে স্কুল ফিডিং কার্ক্রম আরো জোরদার করার তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা হাত পাততে চাই না, আত্মনির্ভশীল হতে চাই।”
“শুধু পড়ালেই হবে না। শিক্ষার মান বাড়াতে হবে”, শিক্ষকদের বলেন তিনি।
২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং ক্রমান্বয়ে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ার কথাও সমাবেশে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, এ পর্যন্ত ৫৬ হাজার ৭২০টি বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শাখা খোলা হয়েছে। চলতি বছর থেকে শতভাগ বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালুর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় আছে।
শিক্ষার উন্নয়নে তার সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা এবং অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা চালু করার কথাও উল্লেখ করেন সরকার প্রধান।
তিনি বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে মূল বেতনের ১০০ শতাংশ প্রদান করা হচ্ছে।
আর ২০১০-১১ অর্থবছরে ২৩৯টি নতুন রেজিস্টার্ড বেসরকারি বিদ্যালয়ের ১ হাজার ৪০৫ জন শিক্ষক এবং কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩১৯ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে এমপিওভুক্তি করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “চাকরি জাতীয়করণ রেজিস্টার্ড বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বহুদিনের দাবি। আমরা জানি, এর একটা যৌক্তিকতা রয়েছে। তা আমি উপলব্ধি করতে পারি। কিন্তু আপনারা জানেন, এজন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন।”
প্রাথমিক শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এখন সরকারি হয়ে গেছে বলে স্কুলে না গিয়ে বাসায় বসে থাকবেন- তা হবে না। আপনাদের মনে রাখতে হবে, আপনরা যে টাকা পাচ্ছেন- তা জনগণের টাকা।”
“আমি আশা করছি, আপনাদের প্রতি সরকারের এ আন্তরিকতার প্রতিদান দিতে আপনারা আপনাদের সর্বোচ্চ শ্রম ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করবেন”, বলেন তিনি।
দুই দশকের আন্দোলনের ফল
শিক্ষকরা জানান, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে ১৯৯১ সাল থেকে আন্দোলন শুরু করেন।
এ দাবিতে ১৯৯৭ সালে ঢাকার ওসমানী উদ্যানে শিক্ষকরা আমরণ অনশন করেন। শিক্ষকদের কর্মসূচির নবম দিনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া শিক্ষকদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তাদের অনশন ভাঙান।
এরপর ২০০০ সালের ১০ সেপ্টম্বর ওসমানী উদ্যানে শিক্ষকরা শিক্ষক মহাসমাবেশের আয়োজন করেন। ওই সমাবেশেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থেকে শিক্ষকদের দাবি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দেন।
পরে শিক্ষকদের আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে।
২০১১ সালের নভেম্বর মাসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী আফছারুল আমীন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জাতীয়করণে সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। এ খবরে শিক্ষকদের মধ্যে অসেন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।
একই দাবিতে ওই বছরের ২১ থেকে ২৭ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষক।
এতেও দাবি আদায় না হওয়ায় গত বছরের ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি দেশের সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে ধর্মঘট পালন করেন তারা। দাবি আদায়ে ১৭-১৯ জানুয়ারি কর্ম বিরতিও পালন করেন শিক্ষকরা।
এরপরেও সরকার তাদের অবস্থানে অনড় থাকলে শিক্ষকরা গত বছরের ১৩ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা, স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। এসব কর্মসূচি পালনের সময় পুলিশের পিটুনিতে আহত এক শিক্ষক মারা যান।
শিক্ষকদের আন্দোলন অব্যাহত থাকলে ২০১২ সালের ১৬ মে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী আফছারুল আমীনের আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করেও আরো দুই দিন আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা।
২০১২ সালের ১৮ মে শিক্ষকরা ৩১ মের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষক নেতাদের বৈঠকের সময় বেধে দেন। এ সময়ের মধ্যে ঘোষণা না এলে একই বছরের ১৬ জুন থেকে দেশের সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনিদির্ষ্টকালের জন্য তালা ঝোলানোর হুমকি দেন তারা।
এরপর গত বছরের ২৭ মে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষকদের ১৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের আশ্বাস দেন শিগগিরই শিক্ষক মহাসমাবেশ থেকে বেসরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকদের জাতীয়করণের ঘোষণা দেয়া হবে।
শিক্ষকদের প্রায় দুই দশকের আন্দোলন সংগ্রামের পর প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্য দিয়ে তাদের দাবির চূড়ান্ত বাস্তবায়ন হলো।
সুত্রঃ bdnews24.com
;
বাংলাদেশ সময়: ৯:১১:৫১ ৬৯৮ বার পঠিত