বুধবার, ১৬ জুলাই ২০১৪
হাত বাড়ালেই ফরমালিন
Home Page » এক্সক্লুসিভ » হাত বাড়ালেই ফরমালিনস্থান: মিটফোর্ডের একটি কেমিক্যাল সামগ্রীর দোকান।
যুবক: ভাই, ফর্মালডিহাইড আছে?
বিক্রেতা (কিছুক্ষণ তাকিয়ে): ফর্মালডিহাইড মানে কি? ফরমালিন?
যুবক: হুমম… আছে? আমার দরকার।
বিক্রেতা: আছে..কিন্তু দেয়া যাবে না।
যুবক: কেন ভাই?
বিক্রেতা: ফরমালিন নিয়ে কত কিছু হইতেসে জানেন না? পুলিশ খুব ডিস্টার্ব দিতেসে।
যুবক: ভাই, আমার দরকার আছে।
বিক্রেতা:(কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ) আপনি কি করেন?
যুবক: আমি ছাত্র।
বিক্রেতা: আইডি কার্ড দেখান।
যুবক: কার্ড তো নাই ভাই, হারায়া গেসে।
বিক্রেতা: মিয়া, আইডি কার্ড নাই..ফরমালিন কিনতে আসছেন! পুলিশ ধরলে তো আপনিও বিপদে পড়বেন, আমিও বিপদে পড়ব।
যুবক: আপনি বিপদে পড়বেন কেন?
বিক্রেতা: আপনি যদি পুলিশকে বলেন আমার দোকান থেকে ফরমালিন কিনসেন তাইলে বিপদে পড়ব না? আপনি কোন সাবজেক্টে পড়েন?
যুবক : মাইক্রোবায়োলজি।
বিক্রেতা: আপনার কোন টিচারের কাছ থেকে লিখিত কিছু নিয়ে আসেন।
যুবক: উনি (শিক্ষক) দেশের বাইরে আছেন। কবে ফিরবেন ঠিক নাই।
বিক্রেতা: আপনার কতটুকু লাগবে?
যুবক: ১ লিটার হলেই চলবে।
বিক্রেতা: আমার তো দিতে সমস্যা নাই, কিন্তু পুলিশ যদি আপনাকে ধরে তাহলে তো আমি ফেঁসে যাব।
যুবক: আপনার নাম বললে তো আপনি ফাঁসবেন। আমি তো কাউকে আপনার নাম কিংবা দোকানের নাম বলব না।
বিক্রেতা: (আবার কয়েক সেকেন্ড চুপ) আচ্ছা ঠিক আছে। আমি জিনিস দিতে পারব, কিন্তু কোন মেমো দিতে পারব না।
যুবক: মেমোর দরকার নাই। আমার জিনিস পাইলেই হইল। শুধু ডাইলুশানটা(আনুপাতিক মিশ্রণ) ঠিক করে দিয়েন।
বিক্রেতা: ঠিক আছে। (একটি এক লিটার ফরমালিনের বোতল বের করার পর হাতে দিয়ে) পুলিশ ধরলে বইলেন, ভেতরে লোশন পানি আছে। ঠিক আছে?
যুবক: আচ্ছা।
শিক্ষার্থী সেজে এইভাবেই মাছ, সবজি ও ফলে প্রয়োগের উপযোগী করে তৈরি ফরমালিন কেনেন এই প্রতিবেদক। শুক্রবার ফরমালিন কেনার পরেরদিন একজন ফল ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একই প্রতিবেদক জেনে নেন ফরমালিন ব্যবহারের মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা।
স্থান: মোহাম্মদপুর কৃষিবাজারের একটি ফলের দোকান
প্রতিবেদক: ভাই কি খবর? কেমন আছেন?
বিক্রেতা: (হাসিমুখে) এই তো ভাই, অনেকদিন পরে আইলেন।
প্রতিবেদক: (সামনে সাজিয়ে রাখা আম দেখিয়ে)হ আইলাম আরকি। আম নিমু। আপনের আমে আবার ফরমালিন নাই তো?
বিক্রেতা: নাহ, নাই। লয়া যান। আম ফেরেশ (ফ্রেশ)।
প্রতিবেদক: ভাই, রোজা রমযানের দিন..মিছা কথা কয়েন না।
বিক্রেতা: ভাই, আমরা তো ফরমালিন মিশাই না। বাগানের ইজারাদাররা আম গাছে থাকতেই ফরমালিন দেয়। দোষ হয় আমাগোর।
প্রতিবেদক: যে ই মিশাক, আপনের আম খায়া তো মরুম আমি। তখন আপনারে কই পামু আর ইজারাদাররেই কই পামু।
বিক্রেতা: আপনে কয় কেজি আম নিবেন?
প্রতিবেদক: তিন কেজি।
বিক্রেতা: নিশ্চিন্তে নিয়া যান। আইজ সকালে এই আম আইছে। এই আম ফেরেশ।
প্রতিবেদক: কেমনে ফ্রেশ হইল?
বিক্রেতা: এখন বৃষ্টির সিজন। বৃষ্টির পানিতে ফরমালিন ধুইয়া যায়।
প্রতিবেদক: ঠিক আছে, দেন তাইলে….আচ্ছা ভাই, ফরমালিন দেয় কেমনে, জানেন নাকি?
বিক্রেতা: শুনসি পানিতে মিশায়া তারপর ছিটায়।
প্রতিবেদক: ভাই মনে করেন, আমার কাছে এক লিটার ফরমালিন আছে। আমি এইটা কয়টা আমে দিতে পারুম?
বিক্রেতা: (আম মাপতে মাপতে) পানিতে মিশায়া আড়াইশ আম গাছের আমে আপনে দিতারবেন।
স্থান: মোকাররম ভবন, কার্জন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা।
ফরমালিনের প্রয়োগ ও ব্যবহার বিধি প্রসঙ্গে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র ভৌমিকের সঙ্গে। (ফরমালিন সংগ্রহের তৃতীয় দিন)
প্রতিবেদক: (নিজের পরিচয় দেয়ার পর) স্যার, ফরমালিন নিয়ে আজকাল অনেক লেখালেখি হচ্ছে। আমি এই বিষয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদনের কাজ করছি। আপনার সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল।
ড. সীতেশ: আচ্ছা, খুব ভাল। কি সহযোগিতা চান?
প্রতিবেদক: আমার এ বিষয়ে কিছু প্রশ্ন ছিল।
ড. সীতেশ চন্দ্র: বলুন।
প্রতিবেদক: ফরমালিন বিষয়টি সম্পর্কে আমরা খুব বেশি কিছু জানি না। এ ব্যাপারে যদি কিছু বলেন…
ড. সীতেশ: ফর্মালডিহাইড বা ফরমালিন এমন একটি রাসায়নিক তরল, যা কোন পচনশীল বস্তুর পচন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করে। এই কারণেই বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন গবেষণার কাজে ফর্মালিন প্রয়োজন হয়। গবেষণার ধরন ও প্রয়োজন অনুযায়ী পানির সঙ্গে বিভিন্ন অনুপাতে ফরমালডিহাইড মিশ্রন করা হয়।
বিশুদ্ধ ফর্মালডিহাইডে নামের রাসায়নিক তরলে ঘনীভূত (কনসেনট্রেটেড) অবস্থায় ৩৭ % ফরমালিন থাকে।
প্রতিবেদক: সেক্ষেত্রে শহরের কাঁচাবাজারগুলোতে অধিক সময় মাছ কিংবা ফল তাজার রাখার জন্য কি মাত্রায় ফরমালিন প্রয়োগ করা হয়?
ড. সীতেশ: আমি যদ্দুর জানি- মাছ, শাকসবজি ও ফলমূল দীর্ঘসময় তাজা দেখানোর জন্য ব্যাবসায়ীরা সাধারণত শতকরা দশমিক ৫ থেকে ১০ ভাগ ডাইলিউটেড ফরমালিন (ফরমালিন মিশ্রিত পানি) প্রয়োগ করে থাকেন।
প্রতিবেদক: ফরমালিনযুক্ত মাছ, ফলমূল যদি ঠিকমতো ধোয়া হয়, কিংবা রান্না করা হয়, তাহলে কি এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়?
ড. সীতেশ: দেখুন, পানি দিয়ে ভালমত ধোয়া হলে কোন জিনিসের উপরের আবরনে যে ফরমালিন তা কিছুটা ধুয়ে যায় বটে, কিন্তু ফরমালিনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটা পেনিট্রেট করে। প্রয়োগের সাথে সাথেই মাছ কিংবা ফলের বাইরের আবরণ ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে থাকে। তাই ফরমালিনযুক্ত জিনিসের ভেতরে যে ফরমালিনটা থাকে সেটা যতই ধোয়া হোক, কিংবা যে তাপেই রান্না করা হোক না কেন থেকে যাবে।
প্রতিবেদক: আপনি যে ফরমালিনের যে পরিমানটা বললেন, এই পরিমান ফরমালিনযুক্ত খাবার খেলে শরীরে কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে?
ড. সীতেশ: একদিন, দুদিন বা একসপ্তাহ খেলে ওই ভাবে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেবে না। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে দীর্ঘদিন ধরে যদি এই মাত্রার ফরমালিন যুক্ত খাবার কেউ গ্রহণ করে তাহলে তার ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়, কিডনি অকার্যকর হতে থাকে।
ঢাকা শহরে বর্তমানে প্রতিদিন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ছে- এর অন্যতম প্রধান কারণ নিয়মিত আমরা ফর্মালিন মিশ্রিত খাবার খাচ্ছি।
প্রতিবেদক: আমার কাছে এক লিটার ফরমালিন আছে। এখানে ফরমালিনের শতকরা হার কত তা কি আমি এই ফার্মেসি বিভাগে টেস্ট করিয়ে দেখতে পারি?
ড. সীতেশ: আমি খুবই দুঃখিত, আমাদের ল্যাবে যে যন্ত্রটি দিয়ে এ টেস্টটা করা হয়, তা এখন কাজ করছে না। আপনি বেটার বিসিএসআইআর এ যান, সেটা ভাল হবে।
প্রতিবেদক: আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. সীতেশ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
এরপর প্রতিবেদক বিসিএনআইআর এর ডেজিগনেটেড রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্ট (ডিআরআইসিএম) নমুনাটি পরীক্ষা করে দেখতে যান। এক দিনের মধ্যেই ফর্মালডিহাইড টেস্টের ফলাফল তৈরি হয়ে গেলেও নিয়ম কানুনের জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে ওই টেস্টের চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রতিবেদকের হাতে পৌঁছাতে তিন দিন সময় লাগে।
রিপোর্টে দেখা যায়, স্যাম্পলটিতে দশমিক শতকরা ৫ ভাগ ফরমালিন রয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর আরআইসিএম এর প্রজেক্ট কো অর্ডিনেটর ড. মালা খানের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়।
প্রতিবেদক: আপা, আমার হাতে যে স্যাম্পলটা রয়েছে সেটা যদি আমি মাছ কিংবা ফলে প্রয়োগ করতে চাই তাহলে কীভাবে করতে পারব?
ড. মালা খান: আপনি কোনরকম ডাইলিউশন ছাড়া সরাসরিই প্রয়োগ করতে পারবেন। সেরকম করেই এটা ডাইলিউট করা হয়েছে।
প্রতিবেদক: যদি এটা আমি মাছে দিই, তাহলে মাছ কতক্ষণ তাজা দেখাবে?
ড. মালা খান: স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ১৯ ঘন্টারও বেশি সময়।
বাংলাদেশের আরো খবর
বাংলাদেশ সময়: ১২:৩৭:২৫ ৫৮৩ বার পঠিত