বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০১৪

মালয়েশিয়ার পথে নিখোঁজ অসংখ্য বাংলাদেশি

Home Page » প্রথমপাতা » মালয়েশিয়ার পথে নিখোঁজ অসংখ্য বাংলাদেশি
বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০১৪



malashea-tttttttttttt.jpgতরিকুল,বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ মেহেরপুর : দালাল চক্রের প্রলোভনে মালয়েশিয়া যাওয়ার লোভে সাগরে ডুবছে এবং সর্বস্বান্ত হচ্ছে একের পর এক বেকার যুবক। এরপরও থেমে নেই দালাল চক্রের তৎপরতা। পুলিশ বলছে, তাদের কাছে কেউ অভিযোগ করে না।সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি দালালদের মাধ্যমে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে প্রাণ হারিয়েছেন মেহেরপুর জেলার সদর উপজেলার তিনজন। ঝাঁঝাঁ গ্রামের আনারুল ইসলাম (৪০), পাটকেলপোতা গ্রামের আলামিন হোসেন (৩২) ও সিংহাটি গ্রামের আতিয়ার রহমান (৩৮)। এদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে জানা যায়, নিখোঁজ রয়েছেন আরও তিনজন। সিংহাটি গ্রামের ইসলাম আলী (৪০), পাটকেলপোতা গ্রামের দেলোয়ার হোসেন (২৮) ও মাসুদ রানা (৩৫)। জেলার অন্যান্য গ্রামেও এ রকম অনেক ভুক্তভোগী রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আবার অবৈধভাবে মালয়েশিয়া গিয়ে চরম বিপাকে রয়েছেন আরও অনেকে। নিঃস্ব হয়ে অথৈ সাগরে ভাসছে তাদের পরিবার।

নিখোঁজ মাসুদ রানার বাবা সিংহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মুন্নাফ আলীসহ ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিংহাটি গ্রামের ইমারুল ইসলাম ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায় সম্পূর্ণ বৈধ পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব অনুযায়ী টাকা দিতে হবে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর।এই প্রস্তাবে রাজি হন পাটকেলপোতার রাজমিস্ত্রি আলামিন, কৃষক দেলোয়ার হোসেন ও মাসুদ রানা এবং সিংহাটি গ্রামের কাঠমিস্ত্রি মিয়ারুল ও আতিয়ারসহ অনেকে।

এরা সবাই ১৭ মার্চ ইমারুলের সাথে রওনা হন কক্সবাজারের উদ্দেশে। কক্সবাজারে সাগরের কাছে একটি নোংরা ঘরে সবাইকে আটকে রেখে তাদের পরিবারের কাছে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা করে দাবি করেন ইমারুল ইসলাম।

সিংহাটি গ্রামের ইসলাম আলীর বাবা গনি আলম, মাসুদ রানার বাবা শিক্ষক মুন্নাফ আলী, দেলোয়ারের স্ত্রী আলমিনাসহ অনেকেই ২ লাখ ৩০ হাজার করে টাকা দেন ইমারুলের হাতে।

মুন্নাফ আলী বলেন, ‘এর কয়েক দিন পরে মাসুদ রানা আমাকে থাইল্যান্ড থেকে ফোন দেয়। তাদের সাগরপথে কক্সবাজার থেকে থাইল্যান্ড নেওয়া হয়েছে। মাসুদ জানায়, সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি ও বার্মার একটি দালাল চক্র অনেক বাংলাদেশিকে মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে আটকে রেখেছে।’

থাইল্যান্ড থেকে মুঠোফোনের মাধ্যমে দালাল চক্র আবার ২ লাখ ১০ হাজার টাকা করে দাবি করে বলে জানান ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।

মাসুদসহ অন্যরা তাদের পরিবারে ফোন করে জানান, ইমারুল ইসলাম মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের দালালদের কোনো টাকাই দেননি। তাদের এখন নতুন করে টাকা দিতে হবে বলে জানান ইমারুল, আনারুল ও অন্যরা। এই প্রেক্ষাপটে সিংহাটি গ্রামের বিল্লালের ছেলে ও মালেশিয়া প্রবাসী ইমাদুলের শ্যালক রিপনের কাছে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা করে পৌঁছে দেয় দেলোয়ার হোসেন, মাসুদ রানা ও মিয়ারুল ইসলামের পরিবার।

মাসুদ রানার বাবা মুন্নাফ আলী দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘টাকা না দিলে দালালরা তাদের নির্যাতন করত বলে মাসুদ জানিয়েছে।’

মাসুদ এখন দুই মাস ধরে নিখোঁজ বলে জানান মুন্নাফ আলী। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘মাসুদ বলল, দালালরা তাদের থ্যাইল্যান্ডের একটি ঘরে রেখে খুব নির্যাতন করছে। আপনি সিংহাটি গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী ইমাদুলের শ্যালক চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা অফিসে কর্মরত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার রিপনের হাতে আবার টাকা দেন। তা না হলে আমরা মালয়েশিয়া যেতে পারব না। ছেলের কথামতো আবার আমি আমার এক বিঘা জমি তিন লাখ টাকায় বিক্রি করে রিপনের হাতে টাকা তুলে দিই।’

এর কিছুদিন পরে মাসুদ রানা ও দেলোয়ার ফোন করে জানায়, আনারুল ও আতিয়ারকে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

মুন্নাফ আলী জানান, এরপর মালয়েশিয়া প্রবাসী ইমাদুল মালয়েশিয়া থেকে ফোন করে বলেন, ‘মাসুদসহ ৭০ জনকে আমি মালয়েশিয়ায় নিয়ে আসার সময় মালয়েশিয়ান পুলিশ তাদের আটক করেছে।’

মুন্নাফ আলী দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘গত দুই মাস যাবৎ ছেলের সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ নাই। দালাল ইমারুল পালাতক রয়েছে।’

ইমারুল ইসলামের ভাবি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘সে টাকা নিয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে।’

রিপন দ্য রিপোর্টের কাছে মাসুদ রানা ও দেলোয়ারের পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমি টাকা নিয়ে ইসলামী ব্যাংকের ঢাকার কাকরাইল শাখায় এম আর ট্রেডার বরাবর এবং একই ব্যাংকের কক্সবাজারের কোর্টবাজার শাখায় লাইলা খাতুন নামের এক মহিলার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিয়েছি। এরপর আর কিছু জানি না।’

এম আর ট্রেডার বা লাইলা খাতুনের সাথে রিপনের কোনো সম্পর্ক নেই বলে রিপন জানান। তিনি বলেন, তিনি শুধু তার ভগ্নিপতি ইমাদুলের অনুরোধে টাকা নিয়ে সেটা ব্যাংকে জমা দিয়েছেন।

এ বিষয়ে স্থানীয় বাড়াদী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এএসআই বিশ্বনাথ মণ্ডল দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো খবর আমার জানা নেই।’ পিরোজপুর ইউপি চেয়ারম্যান আলম হোসেন বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কাছে কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি।’ তিনি এ ধরনের কোনো ঘটনা জানেন না বলে জানান।

মেহেরপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ আতিয়ার রহমান জানান, বিষয়টি তিনি তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনবেন।

মেহেরপুর সদর উপজেলার ঝাঁঝাঁ গ্রামের দিনমজুর আনারুল ইসলাম একই ফাঁদে পা দিয়ে জীবন হারিয়েছেন। নিহত আনারুল ইসলামের স্ত্রী কদভানু দ্য রিপোর্টকে জানান, দিনমজুরের কাজ করে চলছিল তাদের সংসার। পাশের ইছাখালী গ্রামের মৃত সুরমান আলীর ছেলে সাদের আলী আর আব্দুস সাত্তারের ছেলে সিদ্দিক মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তাব দেন। এরা দুজন গাংনী উপজেলার কসবা গ্রামের বদর উদ্দিনের ছেলে আব্বাস আলীর সহযোগী।

কদভানু জানান, এক লাখ টাকা নগদ এবং বাকি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা মালয়েশিয়া গিয়ে কাজ করে পরিশোধ করার কথা ছিল। প্রস্তাবে রাজি হয়ে গরু-ছাগল বিক্রি করে এক লাখ টাকা দেন সাদের আলীকে। এরপর আনারুল ও হেকমত আলীসহ একই গ্রামের আরও কয়েকজনকে সাথে করে নিয়ে যান সিদ্দিক ও সাদের আলী।

কয়েক দিন পরে একই প্রক্রিয়ায় তাদের সবার পরিবারে ফোন করে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা দাবি করে দালাল চক্র। টাকা না দিলে তাদের পাঠানো হবে না বলে জানানো হয়।

কদভানু বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে আমি আবার ধারদেনা ও সমিতি থেকে লোন নিয়ে বাকি টাকা গ্রামের কয়েকজন মণ্ডলকে নিয়ে সাদের আলী ও সিদ্দিকের হাতে তুলে দিই।’ টাকা দেওয়ার সময় আনারুলের বড় ভাই আমিরুল ইসলাম ও গ্রামের মণ্ডল রমজান আলী ও হাসেম খাঁ উপস্থিত ছিলেন বলে স্বীকার করেছেন।

টাকা দেওয়ার পর ২৭ দিন ধরে নদীপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় আনারুল মারা যান বলে জানিয়েছেন একই গ্রামের হেকমত আলী। হেকমত আলী কদভানুকে মালয়েশিয়া থেকে ফোন করে বলেন, ‘আনারুলের লাশ মালয়েশিয়া সীমান্তের একটি জঙ্গলের মধ্যে কাগজে জড়িয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে।’

এ ঘটনার সাথে জড়িত সাদের আলী ও সিদ্দিকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু বাড়ি বা এলাকায় তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের মুটোফোনও বন্ধ রয়েছে।

মালয়েশিয়ায় অসুস্থ হেকমত আলীর ভাই আব্দুস সালাম দ্য রিপোর্টকে জানান, শুধু আনারুল নয়, একইভাবে দালালের প্রলোভনে পড়ে একই গ্রামের মওলা বকসের ছেলে আসলাম (৪৫), বজলুর ছেলে মজনু (৩৫), রুহুল আমিনের ছেলে উজ্জ্বল আলী (৩৫), মোসলেমের ছেলে এরশাদসহ (৩৮) আশপাশের গ্রামের আরও অনেক সহজ-সরল মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে। যারা মালয়েশিয়ায় পৌঁছাতে পারছে, শারীরিকভাবে তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার ওপর রয়েছে কারাভোগের আশঙ্কা। অবৈধ হওয়ায় তারা বেতনও পান অতিসামান্য, যা দিয়ে মালয়েশিয়ায় ঠিকমতো থাকা-খাওয়াই চলে না।

হেকমত আলী এখনও অসুস্থ বলে কাজও খুঁজতে পারছেন না। খাওয়া-দাওয়া ও চিকিৎসার জন্য তাকে বাড়ি থেকে টাকা পাঠাতে হচ্ছে বলে জানান আব্দুস সালাম।

এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার শেখ জানান, প্রতারক চক্রের সদস্যদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
-

বাংলাদেশ সময়: ২১:৫১:২১   ৪৮১ বার পঠিত