মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০১৩
বিভিন্ন দেশের অতিথিপরায়নতা
Home Page » ফিচার » বিভিন্ন দেশের অতিথিপরায়নতাতানিয়া সুলতানা বঙ্গ-নিউজ ডটকম:বিভিন্ন দেশের অতিথিকে বরণ করার রীতিনীতি আর ইতিহাসে রয়েছে বৈচিত্রের সমাহার, তাই অতিথিপরায়নতার পদ্ধতিও ভিন্ন আর সংস্কৃতি নিরপেক্ষ একটি বিষয়। তাই আপনারা যারা ভ্রমন পিপাসু বন্দ্বু আপনাদের জন্য বলছি, আপনি যখন কোনো নতুন জাতি-সংস্কৃতি এলাকায় ভ্রমণ করতে চান তাহলে শুরুতেই সেই সংস্কৃতির অতিথি আপ্যায়নের রীতিনীতি কিছুটা জেনে নেওয়া মন্দ নয়, কেননা তাতে আপনি সহজেই ঐ সংস্কৃতির সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে পারেন।
যেমন, আফগানিস্তানে অতিথির ভোজনের পরিমান অর্থাত্ তিনি যত বেশি খাবেন, গৃহকর্তা তত বেশি খুশি হবেন। সুতরাং আপনি ভোজন রসিক হয়ে থাকলে সহজেই আফগানিস্থানে কোনো গৃহকর্তার মন জয় পারবেন, বিনিময়ে আপনি ঐ গৃহকর্তাকে তাঁর আন্তরিকতার অতিথি আপ্যায়নে বেশ একটা সুযোগ তৈরী করে দিলেন। আপনি যদি বলেন যে, আমি যথেষ্ট খেয়েছি, আর খেতে পারছি না বা দয়া করুন আর পারবো না, গৃহকর্তা এমন একটা ভাব করবে যেন আপনার কোনো কথাই সে শুনতে পায় নি এবং আপনাকে আরো বেশি খাবার পরিবেশন করতে থাকবে। বাধ্য হয় আপনাকে আরো বেশি খেতে হবে। এটাই হল ভদ্রতা এবং অতিথি আপ্যায়নের সংস্কৃতি। অর্থাত্ আপনি যদি স্বল্প ভোজন করে থাকেন তাহলে তো গৃহকর্তার মনটাই ভেঙ্গ দিলেন। আমি একটি দেশের কথা বলি, এ দেশের আপ্যায়নের রীতিনীতি ঠিক আফগানিস্তানের বিপরীত। দেশটি হল ব্রুনেই। ব্রুনেই-এর আপ্যায়নের রীতিতে খাওয়ার পরিমানটা সম্পূর্ণ অতিথির ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে। বেশি বা কম খাওয়া হোক, অতিথি খুশি কিনা সেটাই হচ্ছে গৃহকর্তার চোখে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্রুনেই-এ কোনো বাসায় অতিথির আগমন ঘটলে, সে পূর্ব-পরিচিত হোক বা না হোক গৃহকর্তা কিন্তু খুব আন্তরিকতার সাথেই আপনাকে গ্রহন করবেন মজার মজার সুস্বাদু যত আছে সব অতিথির সামনে পরিবেশন করবেন। তবে কি পরিমানে আর কতটা খাবেন তা অতিথিই পছন্দ করে নিতে পারেন। ব্রুনেই-এর মানুষ মনে করেন এ ব্যাপারে অতিথির ইচ্ছাকে সম্মান করা উচিত। এখন আমরা সুইজারল্যান্ডের কোনো বাসায় বেরাতে যেতে পারি। সুইজারল্যান্ডে অতিথি আপ্যায়নের একটি বিশেষ রীতি হচ্ছে অতিথিকে একটি নির্দিষ্ট পরিমান এবং আইটেমের খাবার পরিবেশন করা হবে। অতিথি যদি এর বেশি খেতে চায় তবে তাকে নিজেকেই কিনে খেতে হবে। সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশের মানুষের একটি সাধারণ প্রবণত হচ্ছে অতিথিদের কোনো রেস্টুরেন্টে দাওয়া দিয়ে আপ্যায়ন করানো। যদিও সুইজারল্যান্ড হল বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশের অন্যতম, তথাপিও সুইজারল্যান্ড মানুষ অপব্যয় করে না। আমরা জানি অনেক আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজিত হয় এ দেশে। এমন উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনেও অতিথিদের আপ্যায়নে সেট মিল বা নির্দিষ্ট আইটেম ও পরিমানের খাবার প্রদান করা অথবা ঐ পরিমান খাবারের নগদ মূল্য অতিথিদেরকে বিতরণ করা হয়। ফলে এ টাকা নিয়ে যে কোনো রেস্তরায় খেতে পারেন। প্রত্যেককে বিনা খরচে এক কাপ চা দেওয়া হবে। কেউ যদি সেট মিলের বেশি খেতে চায়, তাহলে নিজের খরচে কিনে খেতে হবে। দেশ ও বিদেশের সবাইকে এ নিয়ম মেনে নিতে হবে।
সংস্কৃতি ভিন্ন হলে খাবারের রীতিনীতির অনেক পার্থক্য হয়ে যায়। যদি আপনি কোনো অস্ট্রেলিয়ানের সাথে দুপুরের খাবার খান, তাহলে বিশেষভাবে কে এ খাবারের মূল্য পরিশোধ করবে, এ ব্যাপারটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এবং যত বেশি খাবারের ওর্ডার করবেন, ততবেশি খেতে হবে, কোনো অপচয় করা যাবে না, কারন অপচয় করা ভালো চোখে দেখা না। এ ক্ষেত্রে জার্মানদের সাথে অস্ট্রেলিয়ানের মিল রয়েছে। তারাও অপব্যয় পছন্দ করে না। তাই জার্মানদের সাথে খাবার খেলে নিশ্চয়ই এটা মনে রাখবেন। অর্থাত্ আপনি ততটাই অর্ডার করুন যতটা খেতে পারেন, ভুলেও বেশি অডার্র করবেন না। আপ্যায়নের রীতিনীতি সত্যি খুব মজার বিষয়, তাই না? অতিথিপরায়নতার ক্ষেত্রে খাবার আপ্যায়ন বা পরিবেশনের রীতিনীতি ছাড়াও আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাহলো সামাজিক রীতিনীতি বা আদব কায়দা। এক্ষেত্রে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের রীতিনীতির মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। তবে মার্কিনীদের চেয়ে ইউরোপীয়ানদের কিছুটা রক্ষণশীল মনে হবে। তাই তারা আদবকায়দার ওপর আরো বেশি গুরুত্ব দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে চুংগাম খেতে খেতে কথা বলা, প্যান্ট বা পাজামার পোকেটে হাত রেখে অন্যের সঙ্গে কথা বলা ইত্যাদি আচরণ যদিও ভদ্র নয়, তবে ততটা খারাপ নয়, কিন্তু ইউরোপীয়নরা এটা কোনমতেই সহ্য করতে পারে না। এ ছাড়া কোনো অভিসারে যাওয়া বা অফিসিয়াল অথবা বাণিজ্যিক লেনদেন বা ভ্রমনে নির্ধারিত সময় সূচী অবশ্যই মেনে চলতে হবে বা সময় মত পৌঁছুতে হবে। বিশেষ করে উত্তর ইউরোপীয় দেশ সমূহে এটা মানতেই হবে। সে দেশে খাবার খাওয়ার সময় সিগারেট খাওয়াও খুব বিরক্তিকর একটি আচরণ। তাই ইউরোপীয়ন দেশের মানুষের সঙ্গে খাবার খেতে গিয়ে কোনমতেই সিগারেট ধরাবেন যেন। যদি সত্যি খেতেই চান, তাহলে খাবার শেষে মদ খাওয়া বা কফি খাওয়ার সময় খেতে পারেন। যদি আপনি ইউরোপীয়ানদের কোনো কিছু উপহার দিতে চান, তাহলে ফুল হচ্ছে সবচেয়ে ভালো পছন্দ। আর পোশাকের ক্ষেত্রে বিষয়ে ইউরোপীয়ানদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফর্মাল পোশাক অর্থাত্ স্যুট-টাই ইত্যাদি। এদিকে ফরাসিরা খুব কম অন্যের বাসায় বেড়াতে যায়। কেবল গৃহকর্তা যদি বার বার অতিথিকে নিজের বাসায় আসার আমন্ত্রণ করে তাহলেই তারা বাসায় যাবেন, অন্যথায় নয়। মনে রাখবেন এমন আমন্ত্রণে আপনি অবশ্যই গৃহকর্তা বা কর্তীর জন্য জন্য সুন্দর ফুল বা চকলেট নিয়ে ভূলবেন না। এতে গৃহকর্তা খুশী হবেন। ফ্রান্সে আড্ডার সময়ে ব্যক্তিগত বিষয়, রাজনীতি বা অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন না কখনোই। এগুলো তাদের কাছে বিরক্তিকর একটি বিষয়।এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আর ফরাসিরা প্রায় একই রকম। তাদের আড্ডার শুরু সাধারণত আবহাওয়া নিয়ে হয়ে থাকে। কিন্তু তারা কখনোই ধর্মের বিষয়ে নিয়ে আলাপ করবে না। যদি আপনি আলাপের শুরুতেই তাদেরকে “তুমি কি চাকরি করো?” এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন, তাহলে তারা মোটেই খুশি হবে না এবং খুব সম্ভবত আপনি এর উত্তর নাও পেতে পারেন। কারণ তারা মনে করেন এটা হল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার। ইউরোপীয় দেশে ব্যক্তিগত তথ্য ও বিষয়ের ওপর খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।আর আমরা জানি ইতালি মানুষ খুব আবেগপূর্ণ এবং অতিথিপরায়ন। তাই যদি কোনো ইতালি মানুষ আপনাকে আমন্ত্রণ করেন, তাহলে নিশ্চয়ই তা প্রত্যাখ্যান করবেন না। কারণ তারা সত্যি আশা করেন আপনি আসবেন। ইতালিয়ানরা দিনের মধ্যে দুপুরের খাবারকে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ খাবার হিসেবে মনে করে থাকে। তারা এই খাবার প্রায় দুই থেকে তিন ঘন্টা ধরে খেয়ে থাকে। খাবার খেতে খেতেই আলাপ-আলোচনা, ঠাড্ডা আর মদ খাওয়া এগুলোই হচ্ছে এ সময়ে তাদের সবচেয়ে পছন্দের বিষয়। পরস্পরকে উপহার দেয়াও খুব স্বাভাবিক ব্যাপার সে দেশে। এ ছাড়া আপনি যদি ইতালি মানুষের সঙ্গে কখনো আলাপ করেন, তাহলে তাদের সবচেয়ে প্রিয় টপিকের মধ্যে রয়েছে: ফুটবল, পারিবারিক ব্যাপার, বিজনেস এবং স্থানীয় সংবাদ ও খবর। তবে আমেরিকা ফুটবল এবং রাজনীতি তাদের পছন্দের নয়। তাই এই বিষয় নিয়ে কথা বলবেন না যেন।
জার্মানির গ্রামীণ দৃশ্য, ব্যক্তিগত শখ এবং ক্রীড়া সবই তাদের প্রিয় টপিক। কিন্তু তারা বেসবল, বাসকেটবল এবং আমেরিকান ফুটবলের বিষয় পছন্দ করেন না। এবং যদি কেউ আপনাকে তাদর বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান, তাহলে গৃহকর্তার স্ত্রীকে ফুল নিতে ভুলে যাবেন না। তবে ভুলেও লাল গোলাপ দেবেন না, কারণ তারা মনে করেন লাল গোলাপ হচ্ছে প্রেমের প্রতীক। তাই গৃহকর্তার স্ত্রীকে লাল গোলাপ উপহার দেয়াটা আপনার জন্য সুখকর নাও হতে পারে।
এবারে আমরা মধ্যপ্রাচ্যের অতিথিপরায়নতার রীতিনীতি নিয়ে কিছু বলবো। যেন ইরানে, সরাসরি নাম ধরে ডাকা সভ্য আচরন নয়। তাদেরকে পদবি ধরে তাদেরকে ডাকতে হয়। যেমন ডাক্তার, ম্যানেজার, পরিচালক ইত্যাদি। ইরানে কোনো বাণিজ্যিক বৈঠকে সময় মত উপস্থিত হলে অন্যরা আপনাকে সম্মান করবেন, কিন্তু যদি দেরি হয় তাবে তা কোনো বড় ব্যাপার নয়, এতে বিরক্ত হবেন না। আর ইরাকের রীতিনীতি অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্য দেশের তুলনায় একটু ভিন্ন। সে দেশে আপনি দেখতে পাবেন যেকোনো ভোজে নিশ্চয়ই মদ থাকবে। এবং যদি কোনো অনুষ্ঠানে যেতে দেরি হয় সে ক্ষেত্রে তারাও বিরক্ত হবেন না।
সৌদি আরবে আপনি কখনো কোন স্থানীয় মানুষের সঙ্গে হাটাহাটি করেন, আর তিনি যদি আপনার হাত ধরেন তা হলে তাত্ক্ষণিক ভাবে আপনার হাত ছাড়িয়ে নিবেন না। কেননা এর মানে হচ্ছে তিনি আপনাকে পছন্দ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:৫৯:৫৬ ৭৭৪ বার পঠিত