শুক্রবার, ২ মে ২০১৪
সাতজনকে খুনের পর ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে নারায়ণগঞ্জ
Home Page » প্রথমপাতা » সাতজনকে খুনের পর ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে নারায়ণগঞ্জবঙ্গ-নিউজঃঅপহরণ করে একসঙ্গে সাতজনকে খুনের পর ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে নারায়ণগঞ্জ।বৃহস্পতিবার জানাজা শেষে কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে দাফনের পর তার সমর্থকরা আবার সড়কে নামে।
সকালে পুড়িয়ে দেয়া হয় আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনের কার্যালয়, রাতে ভাংচুরের পর আগুন দেয়া হয় হাজি মো. ইয়াসিনের বাড়ি সংলগ্ন কার্যালয়।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর নজরুল অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডে এই দুই নেতা জড়িত ছিলেন বলে নিহতের পরিবারের অভিযোগ।
অপহৃত সাতজনের মধ্যে বুধবার শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ছয়জনের লাশ উদ্ধারের পর বৃহস্পতিবার সকালে বাকি লাশটিও পাওয়া যায়।
এদিকে আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আগামী রোববার নারায়ণগঞ্জে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে জেলা আইনজীবী সমিতি।
নারায়ণগঞ্জের এই ঘটনা সারাদেশেই আলোড়ন তুলেছে। বৃহস্পতিবার মে দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার জনসভায়ও গুম-গুপ্তহত্যার বিষয়টি আসে।
খালেদা জিয়া এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করলেও তার পাল্টায় শেখ হাসিনা দুষেছেন বিএনপিকে।
গত রোববার নজরুল ও চন্দন সরকার ছাড়াও অপহৃত হন শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমিটির সহসভাপতি তাজুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জের ৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগকর্মী মনিরুজ্জামান স্বপন ও লিটন, চন্দনের গাড়িচালক মো. ইব্রাহিম এবং নজরুলের গাড়িচালক মো. জাহাঙ্গীর।
তিন দিন পর বুধবার দুপুরের পর বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের শান্তিনগর এলাকা সংলগ্ন শীতলক্ষ্যা নদীতে হাত-পা বাঁধা ছয়টি লাশ ভেসে ওঠে।
ওই দিন পাঁচটি লাশ সনাক্ত হলেও ষষ্ঠ লাশটি লিটনের বলে ধারণা করা হচ্ছিল। জাহাঙ্গীরের লাশ সেদিন মেলেনি বলে জানানো হয়েছিল।
কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে নদীর ওই এলাকা থেকে আরেকটি লাশ তোলার পর তা লিটনের বলে সনাক্ত করেন তার স্বজনরা।
বন্দর থানার ওসি আক্তার মোর্শেদ বলেন, “আগেরদিন যেখান থেকে ছয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল, একই জায়গায় এই লাশটি পাওয়া যায়। হাত-পা বাঁধা ছিল, ইট বেঁধে লাশটি ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল।”
সবশেষ উদ্ধার করা লাশটি লিটনের হলে মর্গে থাকা অন্য লাশটি জাহাঙ্গীরের বলে ধারণা করা হচ্ছে। গলে যাওয়ায় নিহত কাউকেই চেনা যাচ্ছিল না। স্বজনরা পোশাকসহ ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিস দেখে লাশ সনাক্ত করেন।
বেলা পৌনে ১২টার দিকে সানারপাড়ের মিজমিজির পশ্চিমপাড়ার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুলকে।
এর আগে ১১টায় সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় বাসস্ট্যান্ডের কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তার জানাজায় অংশ নেয় হাজার হাজার মানুষ। এই সময় মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল।
জানাজা ও দাফনের পর কয়েকশ মানুষ শিমরাইল মোড়ে ট্রাক টার্মিনালের ভেতরে একটি ভবনে নূর হোসেনের কার্যালয়ে হামলা চালায়। এরপর আগুন ধরিয়ে দেয়া হলে কার্যালয়টি পুরোপুরি পুড়ে যায়।
একই সময়ে ওই কার্যালয়ের পাশে একটি যাত্রা প্যান্ডেলেও আগুন দেয়া হয় বলে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের এডিসি শহিদুল ইসলাম জানান।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক এবিএম মোস্তাক জানান, আগুনের খবর পেয়ে অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা দ্রুত গিয়ে তা নিভিয়ে ফেলে।
নূর হোসেন সিটি কর্পোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।
এরপর নজরুল সমর্থকরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দফায় দফায় বিক্ষোভ করে। তারা সড়কে আগুনও জ্বালায়।
সন্ধ্যার দিকে মহাসড়কে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও রাতে হামলা হয় মিজিমিজি পশ্চিমপাড়ায় হাজি ইয়াসিনের বাড়িতে হামলা হয়। ওই সময় বাড়ির সামনে তার কার্যালয় ভাংচুরের পর অগ্নিসংযোগ হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে।
নজরুলের এলাকার বাসিন্দা ইয়াসিন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বুধবার লাশ পাওয়ার পর বিক্ষুব্ধ নজরুল সমর্থকরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তার পেট্রোল পাম্প জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
অপহরণের পরপরই নূর হোসেন ও ইয়াসিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। মামলায় তাদের আসামিও করা হয়।
সেলিনার বক্তব্য অনুযায়ী, চলতি বছর সিটি কর্পোরেশনের একটি রাস্তা প্রশস্তকরণ কাজকে কেন্দ্র করে নূর হোসেনের ফুফাতো ভাই মোবারকের সঙ্গে নজরুলের বিরোধ ও বাগবিতণ্ডা হয়।
ওই ঘটনার পর মোবারক সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই মামলায় নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে জামিন নেয়ার পরপরই নজরুল অপহৃত হন।
অপহরণের পর থেকে এই দুই আওয়ামী লীগ নেতার কেউই প্রকাশ্যে আসছেন না।
অপহরণের দিন নূর হোসেনের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নজরুলের স্ত্রীর অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি এই ঘটনায় কোনোভাবে সম্পৃক্ত নই।”
সেলিনার দাবি, “নূর হোসেন ও ইয়াসিন এলাকায় জমি দখল, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি করে আসছিলেন। আমার স্বামী এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করার কারণে তাকে কয়েকবার হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছিল।”
এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বুধবার রাতে বলেন, “এটা রাজনৈতিক কারণে ঘটেনি। যতদূর জেনেছি, জমিজমাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে।”
যাদের নাম এসেছে, তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে প্রতিমন্ত্রী বললেও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কাউকে আটক করেনি পুলিশ।
পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী এ বি সিদ্দিককে অপহরণের দুই সপ্তাহের মধ্যে এই ঘটনার পর নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলামকে সরানো হয়।
বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে নরসিংদীর পুলিশ সুপার খন্দকার মুহিদ উদ্দিনকে নারায়ণগঞ্জের দায়িত্বে পাঠানো হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য নজরুল সিটি কর্পোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন।
আওয়ামী লীগের এই নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় জোড়া খুনের অভিযোগসহ অন্তত ১৫টি মামলা এবং বহু সাধারণ ডায়রি (জিডি) রয়েছে।
ঢাকার ধানমণ্ডিতে অ্যাডভোকেট বাবর আলী হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে নজরুলের ফাঁসির দণ্ড হলেও উচ্চ আদালত থেকে তিনি বেকসুর খালাস পান।
গত রোববার একটি মামলায় নারায়ণগঞ্জের আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন নজরুল। দুপুরের পর তিন সঙ্গীকে নিয়ে প্রাইভেটকার নিয়ে বের হন তিনি, গাড়ি চালাচ্ছিলেন জাহাঙ্গীর।
আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে ওঠার পরপরই এই পাঁচজনকে অপহরণ করা হয়। ওই সময় থেকে নিখোঁজ ছিলেন অ্যাডভোকেট চন্দন ও তার গাড়িচালক।
আইনজীবীর গাড়িটি নজরুলের গাড়ির পরপরই আদালতপাড়া থেকে বেরিয়েছিল জানিয়ে চন্দনের পরিবার ধারণা করে আসছিল, কাউন্সিলের অপহরণের ঘটনা দেখে ফেলায় হয়তো তাদেরও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
অপহরণের রাতে নজরুলের গাড়িটি গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে শালবনের পাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। চন্দন সরকারের গাড়ি পাওয়া যায় পরদিন ঢাকার গুলশানে।
বাংলাদেশ সময়: ১০:০৩:১৩ ৪৭৫ বার পঠিত