বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০১৪
উতল অপেক্ষা-রোকসানা লেইস
Home Page » মুক্তমত » উতল অপেক্ষা-রোকসানা লেইসজামির খুব মন খারাপ জীবনের পঁচিশ বসন্ত কেটে যায় অথচ এখনও কোন মন মতন সঙ্গী পেলনা। ও দেখতে ভালো, বেশ হ্যাণ্ডসাম। পড়ালেখায় ভালো । গ্রাম থেকে এসেছে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। ঢাকা শহরের চকচকে জৌলুসপূর্ণ জগতে মানিয়ে নেয় নিজেকে, সচেতনতায় বুদ্ধি দিয়ে খুব দ্রুত। পোষাকের চেহারা বদলে ফেলল। বাড়ি থেকে আসা টাকায় কুলাতো না, সাধ্যমতন পরিপাটি থাকার। অল্প সময়ে দুটো টিউশনি করা শুরু করে ছিল। যা স্বচ্ছল এবং চৌকস চলার সহায়ক হয়েছিল। পুরানো ক্ষেতুস মার্কা পোষাক ফেলে বেশ কয়েকটা নতুন ডিজুস মার্কা ড্রেস, সানগ্লাস কিনে ফেলার পর চেহারার চাকচিক্য আরো খুলতাই হলো। প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে দু তিনবার চুলে তেল ব্যবহার করত। এখন শ্যাম্পু করে, মাঝে মাঝেই স্যালুনে গিয়ে বিভিন্ন কায়দায় চুল কাটে।ক্লাসে মেয়েরা বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখে জামিকে। কেউ কেউ কথা বলতেও আগ্রহি হয়। বিকাল থেকে সন্ধ্যা টিএসসি থেকে মেয়েদের হলের সামনে কাটানো নিত্যদিনের রুটিন হয়ে গেলো। প্রতি বছর নতুন মেয়ে আসে, কথা হয় দেখা হয় কিন্তু কারো মনের ভিতর কোন রেখাপাত করতে পারল না জামি। যদিও অনেকেই ওর রাতের ঘুম কেড়ে নিল। কত রাত এক এক জনের সাথে সুখময় স্বপ্নময় সময় ভাবতে ভাবতে রাত কাবার করে দিয়েছে। সকালে অনেক সময় দ্বন্ধে পরে গেছে কোনটা সত্যি ভেবে; রাতের ভাবনায় কাছে এসে একাকার হয়ে যাওয়া না কি এই দিনের বেলা,মেয়েটির অচেনার ভান করে পুরাপুরি এড়িয়ে যাওয়া জামিকে। এই দ্বৈত ভাবনা, রাত দিনের পার্থক্য, স্বপ্ন না কল্পনা দিনের পর দিন জামিকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে বাঁধছে। স্বাভাবিক জীবন যাপনে, গভীর গোপনে বয়ে বেড়াচ্ছে অস্বাভাবিকতা। যা আসলে নিজেও বুঝতে পারে না, যে বিষয়টা অস্বাভাবিক।
ওর জীবন যাপনে এটাই স্বাভাবিকতা। সকালে উঠে ক্লাসে যাওয়া। দুপুরে একটা টিউশনি সেরে হলে ফিরে এসে খেয়ে খানিক বিশ্রাম সাথে পড়া শেষ করে,উসখুস করতে থাকে আরেকটু বেলা পরার, যখন মেয়েদের হলের সামনে মেলা জমে উঠবে বেশ। ক্লাসের মেয়েদের চেয়ে এখন হলের সামনে নতুন মেয়েদের দেখতেই ওর বেশী ভালোলাগে।
প্রথম প্রথম মেয়েদের চোখ, মুখ চুল দেখত। এখন দেখে শরীরের বাঁক, এখন দেখে বুক আর নিতম্ব, কোমরের ভাঁজ। ওকে নেশায় পেয়ে যায়। এক একটি মেয়ের শরীরের মাপ জোখের হিসাব নিকাশের অংক কষতে থাকে আপন মনে। সন্ধ্যায় হলের গেইট বন্ধ হয়ে গেলে আকেটিট টিউশনি করতে যায়। ঘন্টা খানেক ছাত্র পড়ায়। কিন্তু ওর মন উঁকি ঝুঁকি দিতে থাকে ছাত্রটির মায়ের দেখা পাওয়ার জন্য। অসম্ভব সুন্দরী মহিলা। প্রতিদিন একবার নিজের হাতে চা নাস্তা নিয়ে আসেন। সেইটুকু সুখে ভাসতে ভাসতে ফিরে আসে হলে।
দেশের বাড়িতে গ্রামে যেতে ওর এখন তেমন ভালোলাগে না। গ্রামের মেয়েগুলোকে কেমন পানসে মনে হয়। নিজেরই হাসি পায়, আগে কী ভাবে মিয়াবাড়ির সফুরার জন্য সে পুকুর পাড়ে বসে কাটাত। আম পেড়ে হাতে তুলে দেয়ার জন্য কত অপেক্ষার কাল কাটিয়েছে। সফুরা আরো বড় হয়েছে হয়ত বা সুন্দরীও কিন্ত ওর চালচলনে কেমন গেঁওপনা। সাজ সজ্জা দেখলে কেমন বিশ্রী লাগে জামির।
তবু একটা সময় সফুরাই ওকে একটু পাত্তা দিয়েছিল। ভালোবাসার প্রথম সুত্রপাত ওর সাথেই। এখনও সফুরা অপেক্ষা করে ওর জন্য। কিন্তু সফুরা ওকে আর টানে না। ওর নিটোল কাদা মাটির শরীর বড় নিঃশপ্রাণ মনে হয়। জামি এখন চায় চৌকস, ঝলমলে জীবন। অনলাইনে এখন অনেক কিছু খুব সহজে পাওয়া যায়। কত সুন্দর মুখ, চোখ, বুক, শরীর। জামির র্হাড ডিস্কে অসংখ্য নাম নাজানা সুন্দরীর ভীড়।
অবকাশে এক এক সময় এক একজনের সাথে কত রকম ক্রিয়ায় মাতে। কিন্তু এই সব বায়বীয় খেলায় ক্লান্ত লাগছে। জামি চায় এখন সত্যিকারের রক্তমাংস মানবী।
পহেলা বৈশাখ নববর্ষ একটি ভালোবাসা যোগার করতেই হবে এবার। পঁচিশ বছরের যৌবন, টগবগে উচ্ছাস বইয়ে দিতে হবে নবীন ডগমগে সতেজতায়।
ওর অনেক বন্ধু কিন্তু অন্তরের কথা বলার মতন আন্তরিক কোন বন্ধু কেউ নেই। কারো সাথে আপনমনে ভাবনার অতলে হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কথা বলা হয়নি। নিজের অস্থির জীবনের এক গোপন যন্ত্রনা। কারো কাছে বলতে পারে না। কোন কাছের বন্ধুদের সাথেও না। জমজমাট আড্ডায় বসে বন্ধুদের কথাবার্তা মন দিয়ে শোনে কিন্তু নিজে তেমন কিছু বলে না। ওর সব ভাবনা এবং বলা নিজের সাথে। প্রতি রাতে ভালোলাগার এক একটি নতুন মেয়েকে নিয়ে ভাবনায় কাটিয়ে দেয় রাত।
কিন্তু বাস্তবে ও সবার সাথে বড় অমায়িক। মেয়ে বন্ধুরা ওকে সহজে বিশ্বাস করে, নির্ভর করে। যেন জামির মতন ভালো ছেলে আর দুটি নেই ওদের বন্ধু।
জামি কাউকে মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলতে পারে না। ওর মনটা আকুলি বিকুলি করে কারো হাত ধরে হাঁটার জন্য। কিন্তু কেউ সে ভাবে জামিকে কেন যে নেয় না, ভাবে না। ও নিজেও প্রকাশ করতে পারেনা, মনের কথা কারো কাছে শুধু ভাবে মনে মনে।
ভাবনা আর বাস্তবতার দ¦ন্ধে মাঝে মাঝে নিজেই এলোমেলো হয়ে যায়।
আজ বড় বেশী মেজাজ খারাপ হয়ে আছে ওর। কাল পহেলা বৈশাখ রমনায় জড়ো হবে জোড়া জোড়া কপোত কপোতি। এছাড়া আসবে সুন্দরী সব মেয়ে অথচ ও থাকবে একা।
সব বন্ধুরা র্গাল ফ্রেণ্ড নিয়ে ঘুরবে জামি শুধু একা এই নববর্ষের দিন। বন্ধুরা যেহেতু বান্ধবীর সাথে ঘুরবে। জামি তাই মোটামুটি একা হয়ে থাকবে। এত মানুষের ভীড়ে এমন একা থাকটা বড় কষ্টের। কিন্তু কেমন করে এই পথ পাড়ি দিবে জামি। যতই ভাবে মনটা আরো বেশী ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে যায়।
সফুরার বাবার বাড়িতে এখন ওর বেশ দাম হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাশ দেওয়া ছেলে, কৃষক পরিবারে অফিসার জামাই পাবার আশা তারা করতেই পারে।যদিও এখনও ওর চাকরি বাকরি কিছু নাই। তবে ওরা মনে করে এতগুলো পাশ দেয়া ছেলে ভালো কামাইত করবেই। চাইলে সম্পর্ক হতে পারে এখন আগের পাত্তা না দেওয়া পরিবারটির সাথে। ছুটিছাটায় দু চারদিনের জন্য গ্রামে গেলে সফুরার বাড়ির ছেলেরা বেশ মুগ্ধ নয়নে ওকে পরখ করে। ওর সানগ্লাস থেকে পোষাকের ভাঁজ চুলের কারুকাজ ওদের চমকৃত করে। তিনদিন থাকলে ছয়বার পোষাক পরিবর্তন করে। সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়ার সব সুযোগের যথাযথ ব্যবহার করে। ও বাড়িতে দাওয়াতও করে জামিকে। সফুরার মা বেশ যত্ন করে নিজ হাতে, নানা রকম আয়োজনের খাবার বেড়ে দেন। দুপুরে খাবার পর বাড়ির পিছনে পুকুরের দিকে সফুরার সাথে একা হেঁটে গেলে কেউ তেমন নজর করে না। বরঞ্চ একটু প্রশ্রয় দেয়া হয় যেন, চেনাজানা কাছে আসার, নির্বিকার ভাব করে। মা ও চাচ্ছে একটা সম্পর্ক হোক। ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে। এত্ত পড়ালেখা করে কী হবে। এখন বিয়া সাদী সেরে ঘর সংসার করুক।
ভালোলাগে খুব ভালোলাগে জামির সফুরার সাথে একা পুকুরের পেছনে কলা বনের সারির গভীরে প্রবেশ করতে। সফুরা যেমন কাজল পরা ডাগর চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে যেন লতার মতন দুলে ওর বেনী ওর শরীর। চাইলেই গাছ হয়ে জড়িয়ে নিতে পারে জামি। কিন্তু কাছাকাছি এলেই কেমন এক গ্রাম্য বুনো ঘ্রাণ সফুরার শরীরে জামিকে নির্বিকার করে দেয়। ওর ভালোলাগেনা সফুরাকে। বড় নিস্তরঙ্গ পুকুরের জল মনে হয়। আচমকা উল্টা পথে হাঁটা দেয়, যাই বলে। সফুরা বেতস লতার মতন কাঁপতে থাকে। কিছুই বুঝতে না পেরে। আর এডিডাস কেডসের মসমস আওয়াজে ঘাসের বুক দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে জামি বহু দূরের মানুষ হয়ে যায়। সফুরার ডাগর কালোচোখ দীঘি হয়ে গেছে কিনা জলে ভরে তা ওর মনে পরে না।
জল তরঙ্গের মতন ঝিলিক দেয়া, বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতন মশৃণ মুখ, বুক, নিতম্ব ছুড়ির ফলার মতন ফলাফালা করে কাটতে থাকে জামিকে। এক অদ্ভুত অনুভবে ও বুঝে ওঠে না, সময়টা কী, দুপুর না রাত, গ্রাম না শহর। অন্ধকার না আলো। এক উষ্ণ প্রস্রবণে পরে ছটফট করতে থাকে যেন আগুনের লাভার ভিতর খেলছে। বেরিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পায় না।
চৈত্র সংক্রান্তির পিঠাপুলী উৎসব, বাউল গানের ঢেউ পেরিয়ে, আর্ট কলেজের মুখোশ বানানো, আলপনা আঁকা মেয়েগুলোর কাজে থমকে থাকে জামি। স্থির শরীর ওর অথচ চোখ ঘুরে চরকির মতন এক থেকে অন্যের উপর। সংস্কৃতি অনুষ্ঠানের নাচের মেয়েগুলোর লতানো বাহু, কোমরের ভাজ তলোয়ার হয়ে পোঁচ দিতে আসে জামিকে। দমবন্ধ হতে থাকে ওর। চোখে নানা রঙ দেখে। আলপনার রঙ, হলি খেলার মতন উড়ছে যেন বাতাসে। মেজাজ চরম হয়ে উঠে। একটা রিকসা নিয়ে ঘুরে উদ্দেশ্যবিহীন। বেশ রাতে হলে ফিরে কম্পিউটারে সুন্দরীদের দেখে। একজনকে বেছে নিয়ে তার সাথে ঘুমাতে যায়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নেয়। বছরের শেষদিনে এই খেলা সমাপ্ত করে বাস্তব রক্ত মাংসের খেলায় মাতার।
ভোরবেলা রমনার মাঠে অনেক মানুষের ভীড়। অনেক সুর অনেক ছন্দ, অনেক রঙিন প্রজাপতি। জোড়ায় জোড়ায় কপোত কপোতি বাকবকুম করছে। বান্ধবীসহ দুচারজন বন্ধুর সাথে দেখা হলো। দেখা হলো কয়েকজন সহপাঠী, বান্ধবীর সাথেও। সবারই পাশে একজন নিজস্ব মানুষ। উচ্ছাসে উদ্বেলিত হয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করা হলো। খানিক সময় কথা বলার সময় নেই কারো। মহা ব্যস্ততায় মাঠের এদিক থেকে ওদিকে ছুটছে সবাই। কেউ বান্ধবীর চুড়ি কেনার অপেক্ষায় আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ গালে, মুখে আলপনা আঁকার অপেক্ষায় লাইন দিয়ে আছে। আবার কেউ ছুটছে পান্তা ইলিশের খুঁজে। খাওয়া না হলে নববর্ষ বৃথা হয়ে যাবে।
জামির কাছে সব কেমন পানসে নিরাসক্ত মনে হতে থাকে। ওর গলা শুকিয়ে উঠছে, নতুন পাঞ্জাবী ভিজে উঠছে ঘামে। অস্বস্থিকর অবস্থায় ঠিক করে হলে ফিরে যাবে ঘুমাবে সারা দুপুর। মন খারাপ ওর,কিছুই ঘটবে না ওর জীবনে। কোন সুন্দরী ভালোবাসবে না ওকে। এক ঠোঙা বাদাম কিনে দু চারটা মুখে দিতে দিতে, চারপাশে অসংখ্য শব্দের গুঞ্জরণে ভাসতে ভাসতে জামি বাংলা একাডেমির দিকে এগুতে থাকে। রমনার সবুজ ঘাসের ধূলায় ধূষর বৈশাখি রোদের আলোয় ভিজতে ভিজতে। পার্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুহুর্তে থমকে যায় জামি। কেউ ডাকছে ওর নাম ধরে। এই জামি…. এ……ই.. জা…….মি…..
মাথা ঘুরিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া মানুষের ফাঁক দিয়ে দেখতে পায় দশ বারো হাত দূরে মহুয়া। ওদের সহপাটি ছিল অন্য ডিপার্টমেণ্টের মেয়েটি। কিন্তু জামির খুব কাছের বন্ধু না ও। দু চারবার অনেক বন্ধুর মাঝে কথা হয়েছে অথবা পাশাপাশি বসে থেকেছে ঐ পর্যন্তই সম্পর্ক। জামি এগিয়ে গেলো গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা মহুয়ার কাছে। শুভ নববর্ষ বলে হাতটা বাড়িয়ে দিল জামি। মহুয়া দ্বিধা না করে, শুভ নববর্ষ বলে ওর হাতটা ধরল। একটা বিদ্যুৎ প্রবাহ যেন বয়ে গেলো জামির শরীরে। মেয়েটি বেশ সুন্দর। সবাই সাদা লাল শাড়ি পরেছে আজ কিন্তু ও পরে আছে গোলাপী শাড়ি। কিযে অদ্ভুত লাগছে ওকে দেখতে। অস্থিরতা কাটাতে মহুয়ার দুটো হাত ধরে আরো অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে আরো কাছে ঘন করে নিয়ে আসে নিজের কাছে জামি, মহুয়ার হাত ভরা চুড়ি রিনিঝিনি বেজে উঠে। অস্থির ভাবে বলে জামি, কি রে, কী খবর তোর। কাউকে সাথে দেখছি না যে। স্বতস্ফূর্ত যেন এভাবেই মহুয়ার সাথে কথা বলে আসছে বরাবর। কাছে আসা মহুয়ার গায়ের ঘ্রাণ এই ঘামে জবজব তপ্ত দুপুরে একটা ফুরফুরে বসন্ত বাতাস বয়ে যায় শরীর জুড়ে, একটা নেশা ধরিয়ে দেয় ওর মনে যেন। এমন একটা মুহুর্তের জন্য কত কাল অপেক্ষা করছে। মনে হয় চারপাশ শূন্য শুধু ওরা দুজন রাজা রাণী, খোলা উদ্যান জুড়ে রাজত্ব করছে।
পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মানুষের স্রোত থেকে অনেকই আড় চোখে কেউ বা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছে ওদের দুজনকে। এক অনাবীল ভালোলাগায় ভরে উঠে জামির মন। অসম্ভব সুন্দরী একজন নারীর সঙ্গি সে, লোকে ভাবছে , এই ভাবনায় ভীষণ গর্ব অনুভব করে মনে মনে। কিন্ত মনের সুখটায় আপ্লুত হতে পারছে না পুরাপুরি। কারণ সে তো জানে তারা কেবল এই মুহুর্তে এক সাথে দাঁড়াল। ভালো করে কথাও হয়নি এখনও। তবু নববর্ষের শুরুটা এতক্ষণে যেন শুভ হতে শুরু করল।
মহুয়ার হাতটা ধরেই আছে জামি, তারপর বল, তোর সাথে আর কেউ আছে না কি …? কথা শেষ না করে আগ্রহী চোখে তাকিয়ে থাকে মহুয়ার চোখে।
কেউ নেই আমি ছাড়া, শরীরে এক মায়াময় ঝাঁকুনি দিয়ে ঠোঁটের কোনে বাঁকা একটা হাসি ফুটিয়ে বলে মহুয়া। হৃদপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠে জামির। মহুয়ার মুখ ও শরীরের ভঙ্গি দেখে। মহুয়া আরো যোগ করে। এত্ত মানুষের ভীড়ে একা হাঁটতে ভালোলাগে বল? তা ঠিক আমিও একা, তাই চলেই যাচ্ছিলাম।
যাস না, চল এক সাথে ঘুরে বেড়াই। আহা, এ যে না চাইতেই বর্ষণ। ভিজিয়ে দিল যেন জামির শরীর এই বৈশাখী দুপুরে।
কখনও তেমন কথা না হওয়া, ভীষণ ধনী বাবার মেয়ে, মহুয়ার হাত ধরাধরি করে হাঁটতে লাগল মানুষের ভীড়ের ঢেউ ভেঙ্গে ভেঙ্গে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে দুজনে। এবার অনেক কথার গুঞ্জরণ থেকে যেন মধুর সুর বর্ষিত হতে থাকল। হটাৎ করে, যেন প্রখর রোদের আলো মিষ্টি স্নিগ্ধ হয়ে গেলো। মোহময় সময় ঘিরে ধরল জামিকে। আর গর্বে ওর বুকের ছাতি যেন ইঞ্চি দুই বেড়ে গেলো। চারপাশের মানুষ কতটা ওদের দিকে দেখছে সেটাই বেশী উপভোগ করছে জামি অহংকারে । কখন যেন মহুয়ার পিঠ জড়িয়ে কোমরে হাত রেখেছে পিছন থেকে সুখি নব দম্পতির মতন। মহুয়া তেমন আপত্তি করছে না দেখে একটু একটু করে আরো বেশী কাছে আসার সাহস পাচ্ছে জামি। ঘণ্টা দুই পর মহুয়া বলল, খুব গরম লাগছে, চল এখান থেকে বেরুই। বিশাল হওয়া ছাতিটা ধুপ করে যেন পরে গেলো জামির। মহুয়া তা হলে চলে যাবে। আনন্দময় সময়ের এখানেই শেষ। জামির মনে কালো মেঘ জমতে শুরু করল। মহুয়া কেন ওকে আজ বেছে নিল, ওর সাথে ঘুরছে কিছুই জানা হলো না। মহুয়া কি ওকে ভালোবাসবে? আজ প্রথমদিনে কী জিজ্ঞাসা করবে? জামি ভাবছে দ্রুত কিন্ত কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না।
মনের কষ্টটা চেপে রেখে জানতে চাইল এখনই বাড়ি ফিরে যাবি?
না এখান থেকে বেরুই চল, তারপর অন্য কোথাও যাই। কালো মেঘের পরত ভেঙ্গে এবার একটু রোদের আভাষ দেখা দিল যেন মেঘ সরে জামির মুখে। শাহবাগের কাছে এসে রিকসা নিল ওরা। দিগশূন্য উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরতে ঘুরতে এক সময়, মহুয়া বলল, কোথায় যাবি? কি জানি এই ঢাকা শহরে যাওয়ার যায়গা কোথায়। আর আজ তো সব মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে।
তা হলে চল আজ আমরা ঘরে ঢুকে যাই।
একটু অবাক হয়ে যায় জামি মহুয়ার কথায়। ঘরে কোথায় যাবে, তবে একা নয় বলেছে আমরা। তবে কী জামিকে ওদের বাড়ি নিয়ে যেতে চায়। উদাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সে ঘর কোথায় বল?
আছে, চল আমি নিয়ে যাই, যাবি?
চল তুই নিয়ে গেলে তোর সাথে যাই।
গুলশানে আমাদের একটা গেষ্ট হাউস আছে চল সেখানে যাই।
জামি তো আজ হারিয়ে যেতেই চেয়েছে। আর মহুয়া যেন ওর নেশা নিয়ে আজ ওকে মাতাল করতে এসেছে। দুই এ দুই এ চার হয়ে গেছে। শুনেছে ভালুক মহুয়া ফুলের মধু খেয়ে মাতাল হয়ে যায় আর ওর পাশে বসে আছে জ্যান্ত এক মহুয়াফুল। একটু একটু করে যদি সব মধু শুঁসে নিতে পারত। পান না করেই ও মাতাল হয়ে যাচ্ছে। এমন নেশা লাগানো ঘ্রাণ, কাছে বসে মাতাল না হয়ে পারে জামি!
ওর ভাবনার সকল মাধুরী দিয়ে যদি সাজাতে পারত, সময়টা নিজের মধ্যে একা কাটানো রাতের সময়গুলোর মতন দূরন্ত যদি মহুয়ার সাথে কাটাতে পারত। ভাবনায় ওর ভিতরে রক্তস্রোত দ্রুত বয়। উত্তেজনা বাড়ে। অথচ সহজ নির্মল থাকার চেষ্টা করে যতটা সম্ভব। ওরা র্ফাম গেইট ছাড়িয়ে এসেছিল। এদিকে ভীড় কম। রিকশা দ্রুত যেতে পারছে। মহাখালী পেরিয়ে গুলশান পৌঁছাতে খুব বেশী সময় লাগল না।
সুন্দর একটি বাড়ির কাছে রিকসা থামাতে বলল মহুয়া। ভাড়া মিটিয়ে ওর হাত ধরে টেনে ভিতরে যেতে থাকল। ভাড়াটা আমি দিতাম।
তুই আজ আমার গেস্ট। তোকে আমি আজ আপ্যায়ন করব আমার মতন। ব্যাগ থেকে চাবি বের করে দরজা খুলতে খুলতে বলল, মহুয়া। কি অসম্ভব দামি আসবাব আর পরিপাটি করে সাজানো বাড়িটা। জামি এমন বাড়িতে আগে কখনও ঢুকেনি। নিচের ঘর পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল ওরা। বেশ কয়েকটা ঘর পেরিয়ে একটা ঘরের দরজা ঢেলে ঢুকল মহুয়া। পরিপাটি সাজানো ঘর। এয়ারকণ্ডিশনের ঠাণ্ডা পরশে বৈশাখী তপ্ত রোদে ঝলসানো দেহে আরাম অনুভুত হচ্ছে। একপাশে কাউচ, এক পাশে বিছানা। মাঝে ভাড়ি র্পাসিয়ান কার্পেট পাতা। বসো, জামি রিলাক্স কর। এই বলে মহুয়া ছোট্ট একটা ফ্রিজ খুলে ঠাণ্ডা বিয়ার বের করল। টেবিলের উপরে সাজান গ্লাসে ঢেলে জামিকে এগিয়ে দিল। নিজের গ্লাস নিয়ে বলল, চির্য়াস। তোর আমার বন্ধুত্ব চিরস্থায়ি হোক।
জমি খুব একটা অভ্যস্থ নয় র্হাড পানিয় খাওয়ায়। ওর কাছে বিশ্রি লাগে স্বাদ। কিন্তু চিরস্থায়ি বন্দবস্ত করার তাগিদে বড় একটা চুমুক দিয়ে ফেলল গ্লাসে। মুখটা বিকৃত হযে গেল ওর। ভাগ্যিস মহুয়া তখন ঘুরে বিছানার দিকে যাচ্ছিল। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে বলল, বড্ড ধকল গেলোরে আজ।
ঘিয়ে রঙের ঠাণ্ডা বিয়ারের গ্লাসে বুদবুদ উঠছে, হাতে ধরা গ্লাসটি ছূঁয়ে আছে ওর পেটের মশৃণ চামড়া। ব্লাউজের নীচ থেকে নাভীর পর্যন্ত অনেকটা অংশ অনাবৃত। ধবধবে মেদহীন পেট মায়াবী ক্যান্ভাস হয়ে জামিকে ডাকছে, ওখানে ছবি আঁকতে।
এলিয়ে থাকা মহুয়া কাত হয়ে মুখটা এক হাতের পর রেখে ওকে বলল, এখানে এসে বস জামি, তোকে দেখতে পাচ্ছি না। কাছাকাছি পাশাপাশি সত্যিকারের এক মানবীর পাশে। ঠিক যেমন চৌকস সুন্দরী জামি চায় তেমন একজনের সাথে এক বিছানায় জামি বসে আছে। ভাবনাগুলো জীবন্ত হয়ে উঠতে চাইছে। কখন যেন একটু একটু করে সবগুলো ভাবনা, বাস্তবে বিছানায় নামতে থাকল। মহুয়াফুলের মধু পান করে মাতাল হতে থাকল, নেশায় আচ্ছন্ন জামি। ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে ভাবনার সুখগুলো উজাড় হয়ে তপ্ত লাভা হয়ে ছড়িয়ে পরল। গভীর অনুভূতির সতেজ সরোবরে বারবার ডুব দিতে লাগল জামি। অভূত পূর্ব নববর্ষের রাত পেরিয়ে দুসরা বৈশাখ এসে গেল। মহুয়া মাতাল নেশা ধরা স্বর্গ সুখে পৃথিবী বিচ্ছিন্ন এক জগতে দুজন সুখের পায়রা সাতদিন এক সাথে কাটিয়ে দিল।
বেশ কয়েক মাস পর একদিন টিউশনি সেরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরে পরে গেলো জামি তিনতলা থেকে নীচে। পাড়ার লোকজন এ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে পাঠাল জ্ঞানহীন জামিকে। কোথাও তেমন আঘাত পায়নি, কেটে যায়নি। কিন্তু জামির ভীষণ বল লাগছে। দুদিন পর ডাক্তার জামিকে বললেন, আপনাকে এখন থেকে অনেক বেশী সাবধানে চলাচল করতে হবে।
কি হয়েছে আমার ডাক্তার?
আপনার এইডস হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৩৭:৪৯ ৭০৮ বার পঠিত