
সোমবার ● ২৮ এপ্রিল ২০২৫
সম্ভাব্য যুদ্ধের স্পর্শ থেকে বাংলাদেশ কি বাঁচবে?
Home Page » বিশ্ব » সম্ভাব্য যুদ্ধের স্পর্শ থেকে বাংলাদেশ কি বাঁচবে?বঙ্গনিউজ : কাশ্মীরের পেহেলগামে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক আবার নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলে কাশ্মীরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন বাতিলের পর ভারত সরকার সেখানে বড় বড় বিনিয়োগ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুরু করেছিল। ধারণা করা হচ্ছিল, কাশ্মীরের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এ হামলা সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ভারতীয় গোয়েন্দা ব্যবস্থার ত্রুটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভারতের পক্ষ থেকে সরাসরি পাকিস্তানকে এ হামলার জন্য দায়ী করা হয়েছে এবং পাকিস্তানও পাল্টা ভারতকে অভিযুক্ত করেছে। ফলে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা দ্রুতই সামরিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে।
কাশ্মীর ঘিরে ভারত-পাকিস্তানের সম্ভাব্য যুদ্ধ ও এর ভয়াবহতা, বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ, অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও প্রস্তুতির বিশ্লেষণ থাকছে এই প্রতিবেদনে।
দুদেশের সামরিক প্রস্তুতি
বর্তমানে সীমান্তে সেনা মোতায়েন বাড়ানো হয়েছে। পাকিস্তান তাদের সামরিক ঘাঁটি ও বিমানঘাঁটিগুলোতে উচ্চমাত্রার সতর্কতা জারি করেছে। সীমান্ত এলাকায় অতিরিক্ত সৈন্য এবং ড্রোন মোতায়েন করা হয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তান তুরস্কের তৈরি উন্নত প্রযুক্তির বায়রাক্তার ড্রোন মোতায়েন করেছে, যা বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে। ভারতের মিডিয়াগুলো এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। অন্যদিকে ভারতও সীমান্তে সেনা ঘাঁটি শক্তিশালী করছে এবং সামরিক মহড়া চালাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশই এখন যুদ্ধের জন্য আংশিক প্রস্তুত রয়েছে।
ভয়াবহ বিপর্যয়ের শঙ্কা
যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে তা শুধু সীমান্ত যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। দুই দেশেরই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। কোনো বড় ধরনের সংঘর্ষ খুব দ্রুত পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে গড়াতে পারে। আর একটি পারমাণবিক সংঘর্ষ মানে শুধু ভারত ও পাকিস্তানের জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিপর্যয়কর। কোটি কোটি মানুষের জীবন হুমকিতে পড়বে, ব্যাপক অবকাঠামো ধ্বংস হবে, খাদ্য ও পানির সংকট দেখা দেবে এবং পুরো অঞ্চল দীর্ঘমেয়াদে অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এ ধরনের উত্তেজনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়াও গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল প্রকাশ্যে ভারতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। চীন ও রাশিয়া কিছুটা সংযত ভূমিকা নিচ্ছে। চীন পাকিস্তানের ‘ঘনিষ্ঠ মিত্র’ হলেও এখন বড় ধরনের যুদ্ধ চায় না, কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিরতা চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। রাশিয়া ঐতিহ্যগতভাবে ভারতের ঘনিষ্ঠ হলেও এ মুহূর্তে তারা শান্তির পক্ষে আহ্বান জানাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ দুই পক্ষকেই সংযম দেখানোর পরামর্শ দিয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, আন্তর্জাতিক মহলের চাপ থাকলেও দুই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপের কারণে উত্তেজনা কমার সম্ভাবনা এখনই খুব কম।
বাংলাদেশে যে প্রভাব পড়বে
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে যুক্ত এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার দিক থেকেও ভারত আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। একই সঙ্গে, পাকিস্তানের সঙ্গেও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। তাই যুদ্ধের অভিঘাত বাংলাদেশকেও সরাসরি স্পর্শ করবে। যুদ্ধের ফলে সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বে, শরণার্থী সংকট তৈরি হতে পারে এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতায় চাপ আসতে পারে। এছাড়া খাদ্য, জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের বাজারেও বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশের করণীয়
বাংলাদেশের প্রথম করণীয় হবে সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে উচ্চ সতর্কতায় রাখতে হবে যাতে অনুপ্রবেশ, অস্ত্র চোরাচালান বা গুজব ছড়ানোর চেষ্টা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দ্বিতীয়ত, মানবিক প্রস্তুতি নিতে হবে। যদি সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চল থেকে শরণার্থীদের স্রোত শুরু হয়, তাহলে দ্রুত আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। ১৯৭১ সালের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে সরকারের উচিত জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে আগাম সমন্বয় গড়ে তোলা।
তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক মজুত পরিকল্পনা করতে হবে। যুদ্ধ শুরু হলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি, খাদ্যশস্য ও নিত্যপণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। ভারত যদি নিজস্ব চাহিদা মেটাতে বেশি পরিমাণে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি শুরু করে, তাহলে বাংলাদেশের বাজারেও সরবরাহ সংকট দেখা দিতে পারে। তাই এখন থেকেই বিকল্প সরবরাহ উৎস খুঁজে বের করতে হবে এবং নীতিনির্ধারকদের মজুত নীতিতে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
চতুর্থত, কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের উচিত ‘কৌশলগত নিরপেক্ষতা’ বজায় রাখা। প্রকাশ্যে কোনো পক্ষের প্রতি অতিরিক্ত সমর্থন জানানো উচিত নয়। আমাদের স্বার্থ রক্ষাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে, বাংলাদেশ শান্তির পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে। আন্তর্জাতিক ফোরাম, বিশেষ করে জাতিসংঘ, সার্ক ও ওআইসি প্ল্যাটফর্মে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো যেতে পারে। এতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি একটি দায়িত্বশীল, শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
অর্থনৈতিক অভিঘাতের দিকটাও আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে। যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে সমস্যা দেখা দিতে পারে। স্থলবন্দরগুলোর মাধ্যমে ভারত এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। ফলে শিল্পখাতে কাঁচামালের সংকট তৈরি হতে পারে। পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতির চাপও বাড়বে। যদি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপরও প্রভাব পড়তে পারে, কারণ তেলের দাম ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক দেশ শ্রমিক নিয়োগ কমিয়ে দিতে পারে। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ আসবে।
বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট—ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে বাংলাদেশ আগ্রহী, তবে এখনই কোনো ধরনের মধ্যস্থতার প্রস্তাব নিতে চাচ্ছে না। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ চায় দুই দেশের মধ্যে আলোচনা এবং সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান হোক। কিন্তু বাংলাদেশ এ মুহূর্তে মধ্যস্থতা করার জন্য আগ্রহী নয়। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই না যে এ অঞ্চলে কোনো বড় সংঘাত সৃষ্টি হোক, যা মানুষের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। যদিও বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে, তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, বাংলাদেশ এখন অপেক্ষমাণ অবস্থায় আছে। যদি ভারত-পাকিস্তান কোনোভাবে বাংলাদেশকে মধ্যস্থতা করার জন্য আহ্বান করে, তবে বাংলাদেশ সহায়তা করতে প্রস্তুত। তবে আগ বাড়িয়ে কিছু করতে চায় না বাংলাদেশ।
সম্ভাব্য সুযোগ
পরিস্থিতির ভয়াবহতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের জন্য কিছু সুযোগও তৈরি হতে পারে। যদি বাংলাদেশ শান্তি প্রচেষ্টায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ একটি মডেল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। এ ধরনের কূটনৈতিক সাফল্য ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য আলোচনায় বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্ত করবে।
সব মিলিয়ে, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বাংলাদেশের জন্য বড় একটি পরীক্ষা। সংবেদনশীলতা, কৌশল ও দূরদর্শিতার মাধ্যমেই বাংলাদেশকে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। আবেগের চেয়ে স্বার্থকেন্দ্রিক বাস্তবনীতি অনুসরণ করাই হবে সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত। যুদ্ধের বদলে শান্তি চাইলে বাংলাদেশকে প্রস্তুত থেকেই এ সংকটের মোকাবিলা করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩:৪৪:৩২ ● ২৭ বার পঠিত