শুক্রবার ● ১১ অক্টোবর ২০২৪

বাজারে সিন্ডিকেট বেপরোয়া : দ্রব্যমূল্যে দিশেহারা ভোক্তা

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » বাজারে সিন্ডিকেট বেপরোয়া : দ্রব্যমূল্যে দিশেহারা ভোক্তা
শুক্রবার ● ১১ অক্টোবর ২০২৪


ফাইল ছবি

বঙ্গনিউজ ডেস্কঃ সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি, কিন্তু বাজারে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে একেকটি নিত্যপণ্যের দাম। রীতিমতো দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা যেন! ভোক্তার পকেট কাটতে বিক্রেতাদের দাম বাড়ানোর এই নৈরাজ্য অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বলতে গেলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষই নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে দিশাহারা। আলু, বেগুন, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতাসহ প্রায় সব ধরনের সবজিই অস্বাভাবিক দরে বিক্রি হচ্ছে।

ডিমও চলে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, কোনো কোনো পণ্যের দাম মাসের ব্যবধানে ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সাধারণ মানুষ না পারছে বলতে, না পারছে সইতে—এমন এক অবস্থা। ত্যক্ত-বিরক্ত ভোক্তা রাগে-ক্ষোভে বিক্রেতাকে দু-এক কথা শুনিয়ে দিলেও দামের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেই বাড়ি ফিরছে।

সরেজমিনে রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে এবং মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া যায়। জানা যায়, বিদায়ি আওয়ামী সরকারের সময় থেকেই বাজারে এই অস্থিরতা চলছিল। ওই সরকারের ওপর মানুষের ক্ষোভের এটিও একটি কারণ। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর বাজার সহনীয় করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়।

নজরদারি বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দফায় দফায় সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো, টিসিবির মাধ্যমে সুলভে পণ্য বিক্রি বাড়ানো, বিভিন্ন পণ্যের শুল্ক কমানোর পাশাপাশি ডিম, আলুসহ কয়েকটি পণ্য আমদানিরও সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, অতিমুনাফালোভী পুরনো সিন্ডিকেট আগের মতোই সক্রিয়। অনেক ক্ষেত্রে বেপরোয়া। আর পথে পথে পরিচয় বদলে চাঁদাবাজিও চলছে সমান তালে।

পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি চাঁদাবাজ ও সিন্ডিকেটের হোতাদের চিহ্নিত করে কঠোর হাতে দমন না করলে বাজারে স্বস্তি ফেরানো কঠিন।

বাজার বিশ্লেষক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও কমার প্রধান বিষয় হলো বাজারে পণ্যের সরবরাহ। সাম্প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বন্যার প্রভাব পড়েছে চাল, সবজিসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দামে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বরাবরের মতোই সংকটের সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াচ্ছে। ঘাটতি পূরণে আমদানি বাড়ানোর পাশাপাশি ফসলের উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করা গেলে আগামী দুই মাসের মধ্যে বাজার পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

বাজারদরের তুলনামূলক চিত্র

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর রামপুরা কাঁচাবাজার, বাড্ডা, মহাখালী কাঁচাবাজার ও জোয়ারসাহারা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে বাজারে আমদানি করা ও দেশি উভয় ধরনের কাঁচা মরিচই বিক্রি হচ্ছে। বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে গত তিন-চার মাসে বাজারে বেশ কয়েকবার কাঁচা মরিচের দাম ওঠানামা করেছে। তবে বেশির ভাগ সময় ১৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে কাঁচা মরিচ বিক্রি হয়েছে। গত এক মাস আগেও রাজধানীর খুচরা বাজারে ১৬০ থেকে ২২০ টাকা দরে কাঁচা মরিচ বিক্রি হয়েছে। এরপর ক্রমাগত দাম বাড়তে থাকে। এখন তা রীতিমতো নাগালের বাইরে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গত সেপ্টেম্বর মাসের বাজারদর ও রাজধানীর খুচরা বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এক মাসের ব্যবধানে কাঁচা মরিচ কেজিতে ৮২ থেকে ১৫০ শতাংশ দাম বেড়ে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভালো মানের গোল বেগুন মানভেদে কেজিতে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে ১৬০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে প্রতি কেজি করলা বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। এক মাসের ব্যবধানে টমেটো কেজিতে ৭৫ থেকে ৮৬ শতাংশ দাম বেড়ে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। পটোল কেজিতে ৬০ থেকে ৬৭ শতাংশ ও ঢেঁড়স কেজিতে ৬৭ থেকে ৮০ শতাংশ দাম বেড়ে যথাক্রমে ৮০ থেকে ১০০ এবং ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ডজনপ্রতি ৫ থেকে ৯ শতাংশ বেড়ে ১৭০ টাকায় এবং ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ দাম বেড়ে ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও রাজধানীর বাজারে দুই দিন আগেও ডিম ডজনপ্রতি ১৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল। এ ছাড়া বরবটি কেজি ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়, প্রতি পিস লাউ ৯০ থেকে ১০০ টাকায়, চালকুমড়া প্রতি পিস ৭০ থেকে ৮০ টাকায়, ঝিঙা ও চিচিঙ্গা কেজি ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর জোয়ারসাহারা বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. ফয়সালের দাম বাড়ানোর বিষয়ে নানা অজুহাত। তিনি বলেন, ‘টানা বৃষ্টি ও বন্যার কারণে ফসল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাজারে এখন সবজির সরবরাহ কমে গেছে। সরবরাহ ঘাটতির কারণে এখন বাজারে সব ধরনের সবজির দাম চড়া। বাড়তি দামের কারণে সবজি বিক্রি অনেকটাই কমেছে। যাঁরা আগে এক কেজি নিতেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখন আধা কেজি বা ২৫০ গ্রাম করে নিচ্ছেন। ফলে আমরাও সবজি কম করে আনছি।’

রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজারে কথা হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আব্দুল মান্নানের সঙ্গে। তিনি বেগুন, টমেটোসহ এক দোকান থেকে পাঁচ পদের সবজি কেনেন। এতে তাঁর মোট ব্যয় হয় প্রায় ৭০০ টাকা। অথচ এক মাস আগেও এসব সবজি ৪০০ টাকার মধ্যে কেনা যেত বলে জানান তিনি।

আব্দুল মান্নান বলেন, ‘যে হারে ব্যয় বাড়ছে, স্বল্প বেতনের চাকরি করে পরিবার নিয়ে রাজধানীতে আর টেকা যাচ্ছে না। সংসারের খরচ কাটছাঁট করেও ব্যয় সামাল দিতে পারছি না। বাজারে পণ্যের দাম কমানো না গেলে আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে যাবে। তাই অতি দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাজারের পণ্যের দাম কমিয়ে আনতে হবে।’

পাইকারি বাজারদর

রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারের তুলনায় কিছুটা কমে পাইকারি বাজার থেকে সবজিসহ নিত্যপণ্য কিনতে পারছে ভোক্তারা। যার ফলে পাইকারি বাজারগুলোতে আগের তুলনায় সাধারণ মানুষের ভিড় বাড়ছে।

রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজারে গতকাল প্রতি কেজি টমেটো ২২০ টাকায়, কাঁচা মরিচ ৩০০, গোল বেগুন ১২০, ঢেঁড়স ৭০, করলা ৯০, বরবটি ৮০ থেকে ১০০, ব্রয়লার মুরগি ২০০ এবং প্রতি ডজন ডিম ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

দুর্গাপূজা ঘিরে আরো বাড়ল ইলিশের দাম

দুর্গাপূজা উপলক্ষে রাজধানীর বাজারগুলোতে ইলিশের দাম আরো বেড়েছে। এক কেজি ওজনের ইলিশ কেজি দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা, ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ এক হাজার ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৪০০ এবং ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কারওয়ান বাজারের ইলিশ বিক্রেতা মো. হৃদয় বলেন, ‘চাহিদামতো বাজারে ইলিশ আসছে না, যার কারণে বাজারে এবার দাম বাড়তি।’

প্রতি জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন

অন্তর্বর্তী সরকার শুল্কছাড় ও আমদানি উন্মুক্ত করে দেওয়ার মতো কিছু সুবিধা দিলেও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। সে জন্য কঠোরভাবে বাজার মনিটরিংয়ে প্রতি জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এসংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় টাস্কফোর্স নিয়মিত বাজার মনিটর করছে। ব্যবসায়ীদের সতর্ক করার পাশাপাশি জরিমানাও করছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, সাধারণ মানুষ অতশত বোঝে না। তাদের প্রতিদিনই বাজার করতে হয়। প্রতিদিনকার পণ্য কিনতেই যদি আয়ের একটি বড় অংশ খরচ করতে হয়, তাহলে সংসারের বাকি সব চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় করে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া। এটা করতে পারলে সরকারের অন্য সব কাজ করা সহজ হবে বলেও তাঁরা জানান।

বাংলাদেশ সময়: ৯:৫০:৫১ ● ৬৭ বার পঠিত