শনিবার ● ১৩ জুলাই ২০২৪
শিক্ষক আন্দোলনে সাড়া নেই সরকারের
Home Page » জাতীয় » শিক্ষক আন্দোলনে সাড়া নেই সরকারের
বঙ্গনিউজঃ কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সরব সরকার। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ দলটির বেশ কয়েকজন নেতা; কিন্তু সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, তাতে সরকারের তেমন সাড়া নেই। উল্টো দু-একজন মন্ত্রী শিক্ষকদের আন্দোলন অযৌক্তিক বলেছেন। ফলে আন্দোলনের ভবিষ্যৎ ও দাবি আদায় নিয়ে সন্দিহান খোদ আন্দোলনকারী শিক্ষকরাইবিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা মূলত তিন দাবিতে আন্দোলন করছেন। সেগুলো হলো সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহার, শিক্ষকদের জন্য সুপার গ্রেড কার্যকর এবং স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন করা।জানা গেছে, গত ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই এটিকে ‘বৈষম্যমূলক’ উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে সরব হন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। কিছু কর্মসূচি পালনের পর ৪ জুন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকরা। এরপরও দাবির বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় ২৫-২৭ জুন টানা তিন দিন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেন।তাতেও দাবি আদায় না হওয়ায় গত ৩০ জুন পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেন তারা। পরে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ডাকে ১ জুলাই থেকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সারা দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন শুরু হয়।এরপর থেকে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, বুয়েটসহ দেশের ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে, একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বর্জন করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এ আন্দোলনে শরিক হয়েছেন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা–কর্মচারীরাও। প্রতিবাদ সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি করছেন তারা।আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ১ জুলাই থেকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে প্রতিদিন কলাভবনের মূল ফটকের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সেখানে তারা দাবি আদায়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন এবং সরকারের উদ্দেশ্যে শিক্ষকদের আলোচনায় ডাকার আহ্বান জানাচ্ছেন। আলোচনার মাধ্যমেই তারা সমস্যার সমাধান চাচ্ছেন। অন্যদিকে ফেডারেশনের সভাপতি ও মহাসচিব একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান কর্মসূচিতে গিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সমিতির ডাকে সাড়া দিয়ে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাপ্তাহিক ছুটিতে ভিন্নতা রয়েছে তারা শুক্র ও শনিবারও অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন।এদিকে শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষাসহ দাপ্তরিক সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন ধরনের সংকট। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেশনজটের শঙ্কার কথা জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে, দাপ্তরিক কাজ বন্ধ থাকায় সনদ উত্তোলনসহ বিভিন্ন সেবা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা।চলমান আন্দোলনের এক পর্যায়ে গত ৪ জুলাই শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বসার কথা ছিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের। সেই বৈঠক আর হয়নি। বৈঠক আদৌ হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে শিক্ষকদের। এ ছাড়া বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার পেছনে তারা ফেডারেশনের দুয়েকজনের নির্বুদ্ধিতাকেও দায়ী করেছেন।এদিকে, গত ২ জুলাই জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যয় স্কিম নিয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। প্রত্যয় কর্মসূচিতে শিক্ষকদের সুবিধা কমবে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা খণ্ডন করে এ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেদিন অর্থ মন্ত্রণালয়ও একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এসব বিজ্ঞপ্তিতে প্রত্যয় স্কিমকে দীর্ঘমেয়াদি একটি টেকসই পেনশন ব্যবস্থা উল্লেখ করা হয়েছে।
শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে শিক্ষকদের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের আন্দোলনে ফোকাস নেই। ফলে আন্দোলনেও এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। তারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বন্ধ হলেও শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে একটা সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ, তখন শিক্ষার্থীরাও ক্লাসে ফিরতে শিক্ষকদের চাপ দিতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকেও চাপ আসতে পারে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত একটি বিভাগের এক শিক্ষক কালবেলাকে বলেন, আমরা বারবার শিক্ষক সমিতির সভা দিতে বলি। কারণ সভার মাধ্যমে আন্দোলনের পরবর্তী রূপরেখা নির্ধারণ করা যাবে। আবার সরকারের সঙ্গে বৈঠক হলেও সেখানে কী ম্যান্ডেট নিয়ে যাওয়া হবে, শিক্ষকরা কতটুকু ছাড় দেবেন তা নিয়েও আলোচনার প্রয়োজন আছে; কিন্তু সমিতির সভা ডাকা হচ্ছে না। কারণ সভা ডাকলে অনেক বিষয়েরই সমালোচনা সমিতির শীর্ষ নেতৃত্বকে সহ্য করতে হবে। তিনি বলেন, সমিতির নেতারা সরকারের সঙ্গে বৈঠকের পর সভা ডাকবেন বলে জানিয়েছেন; কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকেই তারা এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাননি। ফলে শিক্ষকদের মধ্যেও হতাশা বিরাজ করছে।নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) একজন শিক্ষক জানান, তিন দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও এখন প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহার এবং স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য সুপার গ্রেড কার্যকর বিষয়টি এখন তাদের দাবিতে নেই। তিনি আরও জানান, অবস্থান কর্মসূচিতে কোনোদিন শিক্ষক বেশি আসছেন, কোনোদিন কম। তবে ফেডারেশনের ডাকে শিক্ষকরা কঠোর কর্মসূচিতেও যেতে রাজি আছে।ফেডারেশনের এক শিক্ষক নেতা বলেন, ফেডারেশন থেকে তিনটি দাবিতেই আন্দোলনের কথা বলা হয়েছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি হয়তো তাদের মতো করে করছে। সেটি আমাদের জানা নেই।অন্যদিকে সূত্র জানিয়েছে, আগামীকাল রোববার থেকে শিক্ষকদের আন্দোলন আরও কঠোর হতে পারে। তারই অংশ হিসেবে আজ শনিবার থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তারা সবাই যে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আন্দোলন করবে। খুলনা বিভাগ থেকে এ কর্মসূচি শুরু হতে পারে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুল ইসলাম বলেন, সরকার যেহেতু এখন পর্যন্ত আলোচনার জন্য ডাকেনি, কোনো সুরাহা হয়নি। সে কারণে আমরা বিভাগীয় পর্যায়ে কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন বেগবান করতে যাচ্ছি। আমাদের ধারণা, যেভাবে প্রত্যয় স্কিম বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হচ্ছে; সরকার আলোচনার জন্য ডাকতে আর বেশি দেরি নেই।দাবি বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের এখনো তিনটি দাবি। কোনো দাবি বাদ দেওয়া হয়নি। কেউ কোনো দাবি বাদ দিচ্ছে কি না, খোঁজ নিতে হবে।ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া কালবেলাকে বলেন, আমরা এখনো আলোচনার বিষয়ে সরকারের সাড়া পাইনি। তবে আশা করছি, আগামী সপ্তাহে ডাক পেতে পারি। কারণ, কোটার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে। সেদিকেও সরকারের নজর ছিল। যে কারণে শিক্ষকদের আন্দোলনটা কিছুটা আড়ালে চলে যায়। এখন যেহেতু কোটার বিষয়ে আদালত থেকে নির্দেশনা এসেছে, কাজেই শিক্ষকদের আন্দোলন বিষয়ে সরকার ভাববে বলে আশা রাখি।
তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হচ্ছে না। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। আন্দোলনে শিক্ষকদেরই জয় হবে। কারণ এর আগেও কোনো আন্দোলনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হারেননি।
এদিকে শিক্ষকদের আন্দোলনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তদারক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পক্ষ থেকেও আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ইউজিসির এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেই। সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছে।শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, ১ জুলাইয়ের পর থেকে যেসব শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগদান করবেন এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে অন্যান্য কর্মকর্তারাও যোগদান করবেন, সে বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনা আছে। অবশ্যই সেটি সরকারের সার্বিক একটি নির্দেশনা।গতকাল শিক্ষকদের আন্দোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী কালবেলাকে বলেন, সরকারের নির্দেশনা যেহেতু অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে আসবে, আমরা বিষয়গুলো জানিয়েছি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে। সেখানে কোনো পরিবর্তন এলে আমরা জানতে পারব। পরবর্তী নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। তবে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা আমাদের অনেকের সঙ্গেই হয়েছে, নানান বিষয় ইতিমধ্যেই পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, শিক্ষকরা সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে সময়ের প্রয়োজন হয়। তাই আমাদের প্রত্যাশা, যেহেতু উচ্চ আদালত থেকে একটি রায় এসেছে; শ্রেণিকক্ষের পাঠদান কার্যক্রম শিক্ষকরা শুরু করবেন এবং এতে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত হবে।অন্যদিকে শিক্ষকদের আন্দোলনের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও সম্প্রতি বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি এ আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না বলে জানান।
বাংলাদেশ সময়: ১০:৫০:৪০ ● ১৪২ বার পঠিত