বুধবার ● ২৪ এপ্রিল ২০২৪

যেভাবে নিরাপদ সবুজ কারখানার দেশ হয়ে উঠল

Home Page » জাতীয় » যেভাবে নিরাপদ সবুজ কারখানার দেশ হয়ে উঠল
বুধবার ● ২৪ এপ্রিল ২০২৪


ফাইল ছবি

বঙ্গনিউজঃ   ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে একটি প্রস্তাব আনা হয় গতবছর। প্রস্তাবে বাংলাদেশে পোশাক খাতে কাজের সুষ্ঠু, টেকসই ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টিতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশে লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন (লিড) সনদপ্রাপ্ত ১৮৭টি পোশাক কারখানা রয়েছে বলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই প্রস্তাব উত্থাপনের পর এক বছরে বাংলাদেশে লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানা বেড়েছে ২৮টি। সব মিলিয়ে এমন কারখানা এখন ২১৫টি। লিড সনদপ্রাপ্ত শীর্ষ ১০০ কারখানার ৫৫টি এখন বাংলাদেশে, অর্থাৎ পরিবেশসহায়ক সবুজ কারখানা গড়ার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ধারেকাছে নেই একক কোনো দেশ। পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের পরে পাকিস্তানের অবস্থান, দেশটিতে শীর্ষ লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানা ৯টি। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত, যেখানে এ ধরনের কারখানা আছে আটটি। চীনে এমন কারখানা মাত্র তিনটি। আর যে যুক্তরাষ্ট্র যাচাইবাছাইয়ে লিড সনদ দেয়, সেখানে এ ধরনের কারখানা আছে দুটি।

লিড সনদ দেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবি)। শিল্পকারখানার ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে পণ্য উৎপাদন– সব পর্যায়ে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি কতটা মানা হলো, তা চুলচেরা বিশ্নেষণ করে শীর্ষ মানের লিড সনদ দেওয়া হয়। সাধারণ কারখানার তুলনায় লিড সনদের কারখানা নির্মাণে ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ।

নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও পরিবেশ সহায়ক টেকসই শিল্পকারখানা গড়ার এমন আরও কিছু পদক্ষেপের ফলে তৈরি পোশাক বাণিজ্যে এখন দারুণ এক সময়। পোশাকে ভর করে এগোচ্ছে দেশের রপ্তানি খাত। গেল অর্থবছরে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের মধ্যে পোশাক থেকেই এসেছে ৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলার।

পরিমাণের দিক থেকেও রপ্তানি বেড়েছে। প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পরিমাণের দিক থেকে পোশাক রপ্তানিতে প্রথমবারের মতো শীর্ষে বাংলাদেশ। গত কয়েক দশক এটি ছিল চীনের দখলে। ২০২২ সালে ইইউর ২৭টি দেশে ১৩৩ কোটি কেজি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। আর চীন রপ্তানি করে ১৩১ কোটি কেজি পোশাক। আগের বছরের চেয়ে গত বছর ইইউতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে ২১ শতাংশ। ইউরোস্ট্যাটের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

পোশাক খাতের এই ঘুরে দাঁড়ানো শুরু মূলত রানা প্লাজা ধস ঘটনার পর। ২০১৩ সালে ২৪ এপ্রিলের এ দুর্ঘটনায় দেশে-বিদেশে তিরস্কারের ঝড় ওঠে। কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ না থাকার অভিযোগে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে প্রধান রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র, হুঁশিয়ারি আসে ইইউ থেকে। অনেক ব্র্যান্ড-ক্রেতা বাংলাদেশ ছেড়ে যায়। বাংলাদেশের পোশাক ব্যবহার না করার জন্য বিভিন্ন দেশে মিছিল, প্রচার-প্রচারণায় নামে গ্রিন গ্রোথ ক্যাম্পেইন, ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক অনেক শ্রমিক সংগঠন। এতে যেন খাদের কিনারে গিয়ে ঠেকে দেশের পোশাক খাত। এমন পরিস্থিতিতে উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স ও ইউরোপের ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ডের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম। এর সুবাদে নিরাপদ খাত হিসেবে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্প। বাড়ে ক্রেতাদের আস্থা। এখন চীন-ভিয়েতনামের রপ্তানি আদেশও পাচ্ছে বাংলাদেশ। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন সংকটের মধ্যেও নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে দেশের পোশাক খাতে।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অনিরাপদ অবস্থা থেকে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ কর্মপরিবেশ বাংলাদেশের পোশাক খাতে। কোনো কোনো ব্র্যান্ড ও ক্রেতা পোশাক খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ মডেল অনুসরণ করতে অন্যান্য দেশকে পরামর্শ দিচ্ছে।

গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করা হয়, রানা প্লাজা ধসে হতাহত অনেক শ্রমিক চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ ঠিকভাবে পাননি। অনেকে আর কাজে ফিরতে পারেননি। বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা অন্যান্য শিল্প খাতে কাজে লাগানো হয়নি।’

রানা প্লাজা ধসে আহতদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে ট্রাস্ট ফর ইনজুরড ওয়ার্কার্স মেডিকেল কেয়ার (টিআইডব্লিউএমসি) নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয় ২০১৬ সালে। আইএলওর নেতৃত্বে ব্র্যান্ড, ক্রেতা ও অন্যান্য বিদেশি উৎস থেকে সংগ্রহ করা তহবিল থেকে এককালীন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। তহবিলের অর্থ দিয়ে আহতদের চিকিৎসা চলছে। এ পর্যন্ত এর মাধ্যমে ৩ হাজার ২০০ আহত শ্রমিককে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। দু’জনকে চিকিৎসার জন্য বিদেশেও নেওয়া হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত আহতের চিকিৎসায় এই ট্রাস্ট থেকে ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। ট্রাস্টের সমন্বয়ক শাহরিয়ার রনি বলেন, ‘আহতদের আগের চেয়ে বেশি সেবা দিতে হচ্ছে।’

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কনভেনশন অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ হবে এক জীবন আয়ের সমপরিমাণ। বাংলাদেশের শ্রম আইনে ২ লাখ টাকার কথা বলা হয়েছে। তবে শ্রমিক সংগঠনগুলোর অভিযোগ, আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পায়নি রানা প্লাজা ধসে নিহত অনেক শ্রমিকের পরিবার।

২০১৩ সালে ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক প্রাণ হারান। আহত হন আড়াই হাজার শ্রমিক।

বাংলাদেশ সময়: ৭:৫৫:৫৫ ● ১৪৯ বার পঠিত