শনিবার ● ২৩ মার্চ ২০২৪

এনআরবিসি ব্যাংক চেয়ারম্যানের স্বেচ্ছাচারের কবলে

Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » এনআরবিসি ব্যাংক চেয়ারম্যানের স্বেচ্ছাচারের কবলে
শনিবার ● ২৩ মার্চ ২০২৪


এসএম পারভেজ তমাল

 বঙ্গনিউজঃ    পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন পরিচালক মিলে কোম্পানি খুলে তার মাধ্যমে এনআরবিসি ব্যাংকে নিয়োগ দিয়েছেন প্রায় ৪ হাজার চুক্তিভিত্তিক কর্মী। পর্ষদের বৈঠকে খাবার কেনায় অস্বাভাবিক ব্যয়ের তথ্য মিলেছে। একই দিন সকালে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে বিকেলে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। বাজেয়াপ্তযোগ্য শেয়ারের মালিকানা নেওয়া হয়েছে চেয়ারম্যানের ব্যবসায়িক অংশীদারের নামে। প্রবাসীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি এনআরবিসি ব্যাংকে এভাবে চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে চলছে যথেচ্ছাচার। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক পরিদর্শনে ব্যাংকটিতে এসব অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে।

সম্প্রতি ব্যাংকের সাত উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমালের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছেন। এর আলোকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু করা এনআরবিসি ব্যাংকে এখন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা সাত সহস্রাধিক। দেশের অন্য কোনো ব্যাংকে এত দ্রুত কর্মীর সংখ্যা বাড়েনি। বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বেশির ভাগ নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জনপ্রতি ৬ থেকে ৯ লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে– এমন একটি অভিযোগের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিদর্শন করে অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসে, ১০৫ জন ট্রেইনি অফিসার নিয়োগের জন্য অনলাইনে আবেদন নেওয়া হয়। ২০২২ সালের ৯ এপ্রিল পরীক্ষার জন্য মোট ৩০৪ প্রার্থীকে আমন্ত্রণ জানায় ব্যাংক।

সকালে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে অস্বাভাবিক দ্রুততায় একই দিন বিকেলে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে ৯৬ জনের চাকরির বয়স শেষ পর্যায় তথা ২৯ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। চারজনের বয়স-সংক্রান্ত কোনো তথ্য ছিল না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল বলেছে, নির্বাচিত অধিকাংশের বয়স ২৯ বছরের বেশি হওয়া অস্বাভাবিক। এতে প্রমাণিত হয়, পূর্বনির্ধারিত ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতেই এমন পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছে। নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ১৫ জনের অনলাইন আবেদনও পাওয়া যায়নি। যদিও চেয়ারম্যানের টাকা নেওয়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি, তবে পরীক্ষা নেওয়ার অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া ও অপেশাদারিত্বের সঙ্গে প্রার্থী নির্বাচন করায় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়ে থাকতে পারে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়।

জানতে চাইলে পারভেজ তমাল গতকাল বলেন, করোনার কারণে তখন তড়িঘড়ি করে একই দিন লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ওই নিয়োগ বোর্ডে ছিলেন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আপত্তি জানানোর পর তা বাতিল করা হয়। এখানে কোনো ধরনের দুর্নীতির বিষয় সঠিক নয়।

এনআরবিসি ব্যাংকের মানবসম্পদ নীতিমালা অনুযায়ী, কর্মমূল্যায়নের ভিত্তিতে একজন কর্মকর্তাকে একবারে সর্বোচ্চ তিনটি ইনক্রিমেন্ট দেওয়া যাবে। আবার পদোন্নতির জন্য অন্তত দুই বছরের এসিআর থাকতে হবে। কাজী মো. সাফায়েত কবির, মো. জাফর ইকবাল হাওলাদারসহ কয়েকজন কর্মকর্তার পদোন্নতির ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে, চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন ২৭ কর্মকর্তাকে চার থেকে ১৩টি পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা ছাড়াই ব্যাংকের বোর্ড সেক্রেটারিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে চেয়ারম্যানের অপছন্দের কয়েকজন কর্মকর্তাকে নানা উপায়ে চাপ প্রয়োগ করে ব্যাংক থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল বলেন, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওই ইনক্রিমেন্ট দিয়েছিলেন। এটা নিয়মবহির্ভূত জানার পর পরিচালনা পর্ষদ তা বাতিল করে। অভিজ্ঞতা ছাড়া নিয়োগ কিংবা চাপ প্রয়োগ করে কাউকে বের করে দেওয়ার তথ্য সঠিক নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, চেয়ারম্যানের জন্য একটি অফিস বরাদ্দ দিতে পারে ব্যাংক। অথচ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের মতিঝিলে প্রধান কার্যালয়ে এবং ব্যাংকটির গুলশান শাখায় একটি করে অফিস ব্যবহার করার তথ্য পেয়েছে পরিদর্শক দল।

এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে পরিচালনা পর্ষদের উচ্চ ব্যয়ের কিছু উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। একটি সভায় তিনজন পরিচালকের জন্য ২০ বাস্কেট ফল কিনে ৮৫ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়। আবার নির্বাহী কমিটির এক সভায় তিনজনের দুপুরের খাবার বাবদ ২০ পিস ইলিশ, ২০ পিস চিংড়ি ভুনা, ২০ পিস চিতল, ২০ পিস রূপচাঁদা কিনে খরচ দেখানো হয় ৫৮ হাজার ৬৫০ টাকা। এভাবে পর্ষদের প্রতি সভায় সম্মানী বাদে প্রত্যেক পরিচালকের পেছনে গড়ে ১৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ের তথ্য পেয়েছে পরিদর্শক দল, যা অস্বাভাবিক বলা হয়েছে।

নিজেরাই প্রতিষ্ঠান খুলে কর্মী নিয়োগ

ব্যাংকের চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা, অফিস সহায়ক ও পুলের গাড়ি সরবরাহকারী নিয়োগের জন্য ২০১৮ সালে চেয়ারম্যানসহ ৯ জন পরিচালক মিলে ‘এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি কোম্পানি খোলেন, যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০২১ সালের শুরু থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ৩ হাজার ৭১৪ কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দরপত্র আহ্বান এবং অভিজ্ঞতা যাচাই ছাড়াই এসব নিয়োগের বিপরীতে সার্ভিস চার্জ বাবদ ব্যাংক থেকে ১১ কোটি ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন তারা।

এ ছাড়া ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি এনআরবিসি ব্যাংক সিকিউরিটিজের ১০ শতাংশ শেয়ার কয়েকজন পরিচালক নিজেদের নামে নেন। এ দুটি ঘটনাকে নিয়মের পরিপন্থি ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব হিসেবে উল্লেখ করে দণ্ডনীয় অপরাধ বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, কোনো জবাবদিহি না থাকায় এ কোম্পানির মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে ইচ্ছামাফিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০১৪ সাল ও ২০২২ সালের জুনের নির্দেশনায় পরিচালক বা তার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাংকের কোনো পণ্য, সেবা ও সংগ্রহ বা কেনার নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠির পর সম্প্রতি তারা কোম্পানির শেয়ার অন্যদের নামে হস্তান্তর করেছেন। যদিও এসব শেয়ারের সুবিধাভোগী বর্তমান চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন পরিচালকই আছেন। এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের নামে বিভিন্ন সময়ে ঋণও দিয়েছে ব্যাংক। সেই ঋণের টাকা বেশির ভাগ সময় নামসর্বস্ব কোম্পানি লানতা সার্ভিস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর হয়েছে।

জানা গেছে, এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট ও স্টারলিংকস হোল্ডিংস বনানীর এডব্লিউআর এনআইবি টাওয়ারে অবস্থিত। এ ভবনের মালিকানায় রয়েছে ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান আদনান ইমামের এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্ট। পারভেজ তমালের সব শেয়ার তাঁরই ব্যবসায়িক সহযোগী স্টারলিংকস হোল্ডিংসের মালিক শফিকুল আলমের নামে হস্তান্তর করে তাঁকেই এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়েছে। শফিকুল আলমের প্রতিষ্ঠান রিলায়েবল বিল্ডার্সের নামে এনআরবিসি ব্যাংকের হাতিরপুল শাখায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। বিপুল অঙ্কের এ ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে রয়েছে বরিশালের আলেকান্দা মৌজায় অবস্থিত ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ জমি।

এসব বিষয়ে এস এম পারভেজ তমাল  বলেন, সব পরিচালক মিলে একটি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি খোলা হয়েছিল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার জারির পর শেয়ার অন্যদের নামে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে কারও কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়।

বাজেয়াপ্তযোগ্য শেয়ার হস্তান্তর

প্রবাসী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে ২০১৩ সালে তিনটি এনআরবি ব্যাংক অনুমোদনের অন্যতম শর্ত ছিল– বিদেশে কর পরিশোধিত অর্থে উদ্যোক্তা মূলধনের জোগান দিতে হবে। তবে তথ্য গোপন করে জালিয়াতির মাধ্যমে দেশ থেকে পাচারের টাকা বিদেশে নিয়ে এবিএম আব্দুল মান্নান ও কামরুন নাহার সাখীর নামে শেয়ার কেনেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান শহীদুল আহসান। ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শনে এ বেনামি শেয়ার চিহ্নিত করে তা বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অথচ বাজেয়াপ্ত না করে বিভিন্ন উপায়ে এতদিন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।

গত অক্টোবরে আব্দুল মান্নানের নামে থাকা ৪ কোটি ৭০ লাখ ১ হাজার ৮৮৬টি শেয়ারের (পরিশোধিত মূলধনের ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ) মধ্যে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার ৫১১টি শেয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমামের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর কামরুন নাহার সাখীর শেয়ার মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ঋণ সমন্বয়ের জন্য দেওয়া হচ্ছে।

এনআরবিসি ব্যাংকের উদ্যোক্তা শেয়ার চলতি মার্চ পর্যন্ত লক-ইন তথা বিক্রি বা হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আবার ২০২১ ও ২০২২ সালের জন্য ঘোষিত বোনাস শেয়ারও ২০২৫ ও ২০২৬ সালের আগে বিক্রি করা যাবে না। অথচ নিয়ম অমান্য করে বিশেষ বিবেচনায় ব্লক মার্কেটে এই শেয়ার কেনাবেচার অনুমোদন দেয় বিএসইসি। এর মধ্যে গত ৩১ অক্টোবর ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের ব্যবসায়িক অংশীদার শফিকুল আলমের অনুকূলে ১ কোটি ৬৫ লাখ ৭২ হাজার ৯৯২টি এবং নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমামের স্ত্রী নাদিয়া মোমিন ইমামের কাছে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৪৫ হাজার ৯০৪টি শেয়ার বিক্রি করা হয়। আর মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল আহসানের মেয়ে রেহনুমা আহসানের অনুকূলে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ৬১৫টি শেয়ার হস্তান্তর করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় এখন যে কেউ শেয়ার বেচতে ও কিনতে পারেন। আব্দুল মান্নানের কিছু শেয়ার আদনান ইমামের স্ত্রী কিনেছেন। আর আব্দুল মান্নান শহীদুল আহসানের মেয়েকে কিছু শেয়ার গিফট করেছেন। নিয়ম মেনেই সব কিছু করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১:৩২:১৩ ● ১৪৭ বার পঠিত