বুধবার ● ১৩ মার্চ ২০২৪

গায়ে হলুদ ও ঢেঁকি সমাচার-পর্ব-৪: স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » গায়ে হলুদ ও ঢেঁকি সমাচার-পর্ব-৪: স্বপন চক্রবর্তী
বুধবার ● ১৩ মার্চ ২০২৪


সংগৃহীত- গ্রামের একজন মহিলা একক ভাবে ঢেঁকিতে কাজ করছেন
নতুন ধানের চিড়া তৈরীও হতো ঢেঁকিতে পার দিয়ে। চিড়া তৈরির ক্ষেত্রে অথবা চালের আটা তৈরির ক্ষেত্রে ঢেঁকির রিং যুক্ত চুরুন খোলে রিং ছাড়া একটি চুরুন যুক্ত করতে হয়। ঢেঁকিতে ধান থেকে চাল, আর চাল  থেকে যে আটা বা চালের গুঁড়ি তৈরী হতো । চালের গুঁড়ি দিয়ে ঘরে ঘরে বানানো হতো নানান ধরনের পিঠা। পুলি পিঠা, ভাপা পিঠা, পাটিসাপটা, চিতোই, পোয়া পিঠা, ছঁই পিঠা সহ নানান বাহারি পিঠা। ঢেঁকির শব্দ যেমন গ্রামবাসিকে জানান দিতো, ঠিক বাহারি সব পিঠা-পুলির গন্ধও সারা গ্রামে গন্ধ ছড়িয়ে রসনা জাগিয়ে দিতো। লোকে জানতে পারতো, পিঠা তৈরি হচ্ছে। ফলে সামর্থ মতো কমবেশি সবাই রকমারি পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে যেতো সেই নবান্নের উৎসবে। তখন ঢেঁকি চলতো দিনরাত বিরামহীন । সব আয়েজনের অপরিহার্য অনুসঙ্গ হয়ে যেতো কাঠের তৈরি সেই ঢেঁকিটি।
ঢেঁকির আকার আকৃতির কথা বলতে গেলে বলতে হয়, এর দেহের অগ্রভাগ অপেক্ষাকৃত মোটা ও ভারি একটি শক্ত কাঠের ধর। আর পিছন দিকটা একটু কম পুরুত্ব থাকে এবং একটু চেপ্টা হয়। পিছনের এই চেপ্টা অংশের নিচে সামান্য একটু গর্ত  করা থাকে,সে জন্এয পিছনের চেপ্টিটা অংশ গর্তে  ডেবে যেতে পারে। সামনের দিকে অপেক্ষাকৃত বেশি ভারি হয়। পিছনের দিকে দুটি খুঁটির ( কাতলা ) মাঝখানে মোটা খিল দিয়ে ঢেঁকিকে আটকে দেওয়া হয়। আর সম্মুখ ভাগে একটা দেড় ফুটের মতো গোলাকৃতির চুরুন ( হ্যামার ) যুক্ত করে দেওয়া হয়। এই চুরুনের উপর ঢেঁকির অগ্রভাগ এবং পিছনের দিকে শক্ত খিলের উপর ভুমি থেকে দেড় ফুট প্রায় উপরে মাটির সমান্তরালে থাকে ঢেঁকি। অর্থাৎ পিছনের দিকের দুটি শক্ত খুঁটি এবং সামনের দিকের চূরুনের উপর স্থাপিত থাকে ঢেঁকি।
ঢেঁকির পশ্চাৎ দিকে এক বা একাধিক ব্যক্তি ( সাধারণত মহিলাগণ ) পা দিয়ে ভর দেন। তখন ঢেঁকির অপর অংশ অর্থাৎ সম্মুখ দিক উপরে উঠে, এবং পা ছেড়ে দিলে ঢেঁকি আবার সজোরে আঘাত করে লোটের উপর আছড়ে পড়ে। এভাবেই ক্রমাগত ভাবে উঠানামা করে চুরুনের দ্বারা ধান থেকে চাল বা চিড়া অথবা চালের গুঁড়া প্রস্তুত করা হয়। হলুদ, ধনে, জিরা ইত্যাদি মশলা গুঁড়ো করার কাজেও ঢেঁকি ব্যবহার করা হতো । চুরুনের মাথায় লোহার একটি রিং পরানো থাকে। তাকে এলাকা বিশেষে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। রিং বা হামিও বলা হয় এলাকা ভেদে। এই রিং ধান ভাঙাতে ভাঙাতে খুব ধারালো হয়ে যায়। ঢেঁকির মাথাটি ভারি হওয়ায় চুরুন সজোরে আঘাত করতে পারে। যে স্থানটিতে আঘাত হানে সেটি একটি কাঠের তৈরি গোলাকৃতির গর্ত। তাকে বলে লোট। এই গর্তটি তৈরী করা হয় বিশাল আকারের একটি কাঠের খন্ড খোদাই করে। ঢেঁকির পিছনে পায়ের চাপ দিয়ে উঠানামা করানোর সময় লোটের মধ্যে রাখা শস্য গুলোকে একজন ব্যক্তি হাত দিয়ে বারবার উল্টেপাল্টে দেন যেন সবগুলোতে চুরুনের আঘাত সমভাবে লাগে। এই ভাবে হাত দিয়ে উল্টে দিবার সময় একটা ছন্দ মেনে কাজ করতে হয়। একটু অন্য মনষ্ক হলে বা ছন্দোপতন হলে হাতে প্রচন্ড আঘাত লেগে যেতে পারে। তখন হাত থেঁতলে পর্যন্ত যায়। যদিও এবিষয়ে মহিলাগণ সতর্কই থাকেন।
ঢেঁকিতে অধিকাংশ সময়েই মহিলাগণ কাজ করতেন। আমার মাকেও দেখেছি ঢেঁকিতে কাজ করতে। একবার হাতও থেঁতলে গিয়ে ছিল। কত যে যন্ত্রনা ভোগ করেছিলেন তখন আমার মা। কিন্তু কোন সময়েই মায়ের মুখাবয়বে সে যন্ত্রনার কোন লক্ষন প্রকাশ করতে দেখিনি। স্বাভাবিক কাজকর্মও বন্ধ করে বসে থাকেন নি। কারন মা যে সর্বং সহা।

অধুনা যান্ত্রিক যুগে বৈদ্যতিক চালকলের যত্রতত্র দেখা মিলে। প্রায় প্রতিটি গ্রামে ছাড়াও হাট বাজারে রয়েছে একাধিক চালকল। কেজিতে ১০/১২ টাকার বিনিময়ে চালসহ অন্যান্য দ্রব্যাদি ভাঙানো যায়। মহিলাগণ এখন আর ঢেঁকিতে ধান ভানার কথা চিন্তাও করেন না। কারন এটা অত্যন্ত কষ্টকর ও সময় সাপেক্ষ বিষয়। তাছাড়া এখন মহিলাগণ সবাই প্রায় শিক্ষিতা। বিভিন্ন পেশায়ও তারা নিয়েজিত থাকেন। তাই অল্প সময়ে এবং অল্প পরিশ্রমে ধান ভাঙানোর জন্য সবাই বৈদ্যতিক চালের কলের প্রতিই আগ্রহী। নতুনের মাঝেই পুরাতনের বিলুপ্তি ঘটে। এভাবেই বিলুপ্তির দ্বার প্রান্তে কাঠের তৈরী ঢেঁকি। (চলবে )
ছবি ইন্টানেট। একজন গ্রামের মহিলা একক ভাবে ঢেঁকিতে ধান ভানার কাজ করছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৭:৩১:৫৪ ● ৫৪৬ বার পঠিত