সোমবার ● ১১ মার্চ ২০২৪
গায়ে হলুদ ও ঢেঁকি সমাচার,পর্ব-২ :- স্বপন চক্রবর্তী
Home Page » সাহিত্য » গায়ে হলুদ ও ঢেঁকি সমাচার,পর্ব-২ :- স্বপন চক্রবর্তী
এযো মহিলাগণ হলুদ শাড়ি পরে উপোস থেকে যথাযোগ্য শুচিতা নিয়ে এসে ঢেঁকিতে হলুদ কোটা শুরু করলেন। তার আগে একটু দুরে এক পুকুর হতে কলস ভর্তি করে কয়েক কলস জল আনা হলো, স্নান করাবে বলে। সামান্য বিচ্যুতিও যেন কোন অমঙ্গলের কারণ হয়ে না যায় সেটা লক্ষ্য রেখেই কাজ চলছে। ব্যান্ডে সাঁনাই, ক্ল্যারিওনেট, করতাল ঝুনঝুনি সহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজতে শুরু করলো। সামনে পান সুপারি সিঁদুর ইত্যাদি সাজিয়ে রেখে দেওয়া হলো। লোটের নিকট একজন মহিলা বসেছেন হলুদকে উলটপালট করে দিতে হবে বলে। তাঁর মুখে বোঁটা সহ একটি পান পুরে রাখা হলো। কারন মৌনতা পাল করতে হবে, কোন শব্দ যেন মুখ দিয়ে বের না হয়। আমি পরামর্শ দিয়ে কাজটিকে বেশি নির্ভরযোগ্য করতে মুখে স্কচস্টেপ দিয়ে বন্ধ করে নেয়া যায় কিনা জানতে চাইলে উত্তর দিলেন, “না “ , নিয়ম নাই।
আগের দিন ঢেঁকিঘরকে ধোয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে। হলুদ কোটতে হবে তাই। এদিকে প্রচন্ড শীতের দিন ছিল। প্রত্যেক রমণী নিজ কাঁকে করে বয়ে আনা এক একটি কলস থেকে জল ঢেলে ঢেলে ছেলে ”অনিকে” স্নান করানো হলো। ফলে পরদিন সে জ্বরে আক্রান্ত হলো। তা হোক, জ্বর এক সময় সেরে যাবে হয়তো। তবে লক্ষ্য একটিই, কাজ অবশ্যই ত্রুটিীহীন হতে হবে। কঠোর বিধিবিধানের বেড়াজালে পড়ে অনিকে মাটিতে পশমী চাদর বিছিয়ে শুতে হলো অন্য আর একটি পশমী চাদর গায়ে দিয়ে। শুধু কি তাই ? তিন দিন সে অব্রাহ্মণ কারো সম্মুখে পড়তে পারবে না। মাথা মুন্ডন করা যোগী বেশি অনিকে মৌনব্রত পালন করে তিনদিন কাটাতে হবে। সুতরাং জ্বরের ভয় করার কোন অবকাশ আপাতত নেই। বলাবাহুল্য অন্যসব ব্রাহ্মণ সন্তানের মতো আমাকেও এমনটি করতে হয়েছিল। আমার ছেলেকেও।
বর্তমান নগর সভ্যতার যুগেও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মাঙ্গলিক কাজের অংশ হিসাবে গায়ে হলুদ দিতে দেখা যায়। তবে ঢেঁকিতে হলুদ কোটে নয়, বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসা হলুদ নতুবা হাম্বল-দিস্তা বা উরুন-গাইন দিয়ে তৈরি হলুদ দিয়ে সেই কাজটি করা হয়। বিবাহ অনুষ্ঠান হলে ছেলের বাড়ি হতে হলুদ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে খালি হলুদ শুধু নয়, সাথে সাধ্যমতো অলংকার ,শাড়ি, মাছ ,মিষ্টি, পানসুপারি ইত্যাদিও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই হলুদ কনের গায়ে মাখিয়ে দিয়ে স্নান করানো হয় এবং উপস্থিত জনের মধ্যে মিষ্টি ও পান বিতরন করা হয়। চিন্তা একটাই, যেন সার্বিক মঙ্গল হয়।
উল্লেখ করা যায় যে, হলুদের কিছু দ্রব্যগুণ তথা ঔষধিগুণও রয়েছে। হলুদ খাদ্যকে সুস্বাদু করে। হলুদ পেটের সমস্যার উপকার তথা হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। বিবর্ণ তরকারিকে রঙিন করে । তরকারিতে একটা সুগন্ধ আনয়ন করে। কথিত আছে যে, হলুদ গায়ে মেখে জলে ডুব দিলে তার গন্ধে কুমির নাকি আক্রমণ করে না। তাই হয়তো সাধক রাম প্রসাদ গেয়েছিলেন, “ বিবেক হলদি গায় মেখে যাও ছোঁবে না ( কুমির) তার গন্ধ পেলে”। খালি পেটে সকালে কাঁচা হলুদ খেলে পেটের সমস্যা, কৃমিনাশ সহ অনেক অশোক নিরাময় হয়। ক্ষতস্থানে হলুদ দিয়ে প্রলেপ দিলে আরোগ্য লাভ হয়। আয়োর্ব্বেদ চিকিৎসায়ও অনেক সময় অনুপান হিসাবে কাঁচা হলুদ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।
ধর্ম এবং সংস্কৃতি মানুষের মাঝে নিবিড় ভাবেই লালিত হয়। এটা এমনই প্রথা যে, অনেক সময় সংস্কৃতির স্থান দখল করে নেয় ধর্ম আর ধর্মের স্থান দখল করে সংস্কৃতি। সংস্কৃতি ও ধর্ম অবিচ্ছেদ্য ভাবে পাশাপাশি সমাজে অবস্থান করে। এটা অনায়াসে সমাজের কাজকর্মে মিলে মিশে এক হয়ে যায়। মানুষ তখন ধর্মকে সংস্কৃতি আবার সংস্কৃতিকে ধর্ম মনে করে অনেক সময় ভ্রমও করে । তবে মূল উদ্যেশ্যই হলো অমঙ্গল যেন না আসে। সকলের চিন্তা, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। সকল অমঙ্গল যেন দুরে থাকে। অর্থাৎ পরিবারের মঙ্গল কিসে হবে তা নিয়েই চিন্তা। ( চলবে )
বাংলাদেশ সময়: ১৭:২৯:৪৩ ● ৬২৪ বার পঠিত