সোমবার ● ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩
ব্যাংকে লোপাটের প্রকৃত চিত্র ভয়াবহ
Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » ব্যাংকে লোপাটের প্রকৃত চিত্র ভয়াবহ
বঙ্গনিউজঃ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) রিপোর্টে ১৫ বছরে ব্যাংক থেকে ৯২ হাজার টাকা লুটপাটের কথা বলা হয়েছে। তবে এটি আংশিক চিত্র। প্রকৃত তথ্য আরও ভয়াবহ। এ টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে। এগুলো আর ব্যাংকে ফেরত আসবে না। এ বাস্তবতা মানতে হবে। তিন অর্থনীতিবিদ এসব কথা বলেন। তাদের মতে, ক্রমেই ঋণ নিয়ে জাল-জালিয়াতি বাড়ছে। মূল কারণ হলো সরকারের ভুল নীতি। এ ভুল নীতির কারণেই অপরাধীরা সুবিধা পেয়েছে। আর এ ধরনের ঘটনা অপরাধী এবং নীতিনির্ধারক সবার জন্য লাভজনক। ফলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তারা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা বন্ধে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। না হলে আপাতত এর কোনো সমাধান নেই।.
যারা এসব মন্তব্য করেছেন তারা হলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম। প্রসঙ্গত, ‘দেশের অর্থনীতির চলমান সংকট ও করণীয়’ নিয়ে শনিবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে সিপিডি। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ২৪টি ঘটনায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে তথ্য তুলে ধরে সিপিডি। এছাড়াও প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে যে সংকট চলছে, এর আগে একসঙ্গে এত চ্যালেঞ্জে পড়েনি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। অর্থনীতি ক্রমেই ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুরতর হচ্ছে। কমছে রাজস্ব আয়। ব্যাংকিং খাত আরও দুর্বল হচ্ছে। বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। পাঁচ বছরে জিনিসপত্রের দাম ৯ শতাংশ থেকে শুরু করে ৪০০ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়াও শ্রম ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। এ অবস্থায় এ খাতে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বৈদেশিক বাণিজ্য ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সংস্থাটির মতে, অর্থনীতির সংকট সমাধানে বড় ধরনের সংস্কার দরকার। এক্ষেত্রে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। এসব বিষয়ে শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে ।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অনেকদিন থেকেই ব্যাংকিং খাতে জাল-জালিয়াতি হচ্ছে। এটি বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা, ক্রমেই আরও বাড়ছে। ব্যাংকে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এর অন্যতম কারণ হলো খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক কোনো উদাহরণ নেই। তিনি বলেন, ঋণখেলাপি ও জাল-জালিয়াতি বন্ধে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জরুরি। কারণ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এটি বন্ধ হবে না। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে কমিশন গঠনের কথা বলছে কেউ কেউ। এক্ষেত্রে ‘ধরে নিই ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হলো’, ওই কমিশন একটি রিপোর্ট দেবে-রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে রিপোর্টের সুপারিশ কে এবং কীভাবে বাস্তবায়ন করবে।
জানতে চাইলে পিআরআই নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সিপিডি যে তথ্য দিয়েছে, তা আংশিক। ব্যাংকং খাতে জালিয়াতির প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ। এটি আরও বাড়ছে। এর কারণ হলো এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, জাল-জালিয়াতি হচ্ছে, খেলাপি ঋণ বাড়ছে। কিন্তু জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ফলে আপাতত আমি কোনো সমাধান দেখছি না।’ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সিপিডি লুটপাটের একটি চিত্র তুলে ধরেছে। কিন্তু কজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে-এমন কিছু তারা বলতে পারেনি। কারণ, কারও বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে মনে হয় না। কারণ, এ ধরনের জালিয়াতির কাজ সবার (অপরাধী এবং নীতিনির্ধারক) জন্য লাভজনক। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করতে হলে দৃশ্যমান কিছু করতে হবে। জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, সিপিডি ৯২ হাজার কোটি টাকার কথা বলেছে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ। এটি বাড়ছে। এর কারণ হলো, সরকার ঋণখেলাপিদের আশকারা দিয়ে দিয়ে এ পর্যন্ত এনেছে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, এগুলো খেলাপিদের পক্ষে গেছে। ২০১৯ সালে তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর একটার পর একটা ছাড় পেয়েছে খেলাপিরা। বিশেষ করে নীতিমালা করেছে ২ শতাংশ খেলাপি ঋণ জমা দিলে ১০ বছরের জন্য সময় পাবে। এটি অত্যন্ত ভুল নীতি। এসব নীতির ফলে আজকের এ পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। আর খেলাপি ঋণের বেশির ভাগ অংশ বিদেশে পাচার হয়ে গিয়েছে। এগুলো কখন আর ব্যাংকে ফেরত আসবে না। এটি হলো বাস্তবতা। আর এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে।
সিপিডির ব্রিফিংয়ে দেশের সুনির্দিষ্ট ১২টি প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), প্রতিযোগিতা কমিশন, অর্থ মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বেপজা), শ্রম আদালত, শিল্প পুলিশ, ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু দেশ যে ধরনের নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে, তাতে সংস্কারের আশা দেখা যাচ্ছে না। ফলে আগামী দিনে সংকট আরও বাড়বে। এছাড়াও সুদের হার ও মুদ্রায় বিনিময় হারের ব্যাপারে পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১:২৭:৪৭ ● ১৯২ বার পঠিত