বৃহস্পতিবার ● ২৪ আগস্ট ২০২৩

কীভাবে অবৈধ ক্রিপ্টো কারেন্সির ফাঁদে পড়লেন বাংলাদেশিরা?

Home Page » প্রথমপাতা » কীভাবে অবৈধ ক্রিপ্টো কারেন্সির ফাঁদে পড়লেন বাংলাদেশিরা?
বৃহস্পতিবার ● ২৪ আগস্ট ২০২৩


ফাইল ছবি
বঙ্গ-নিউজঃ  বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রা অবৈধ। তারপরও ১১ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ডলারের ক্রিপ্টো কারেন্সি কীভাবে কানাডাভিত্তিক মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপে (এমটিএফই) বাংলাদেশিরা বিনিয়োগ করলেন?

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বিনিয়োগ অর্থপাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। যারা বিনিয়োগ করেছেন তারা টাকাও খুইয়েছেন, আবার অবৈধ কাজেও জড়িয়ে পড়েছেন। তারা জেনে বা না জেনে যেভাবেই করুক, অপরাধে জড়িয়েছেন। তারা এখন এর কোনো ধরনের প্রতিকার পাবেন বলে মনে হয় না।

এই টাকা যে দেশ থেকে বাইরে চলে গেল, সেটা মনিটর করার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের। এ পর্যন্ত যা জানা গেছে, তাতে এই বিনিয়োগকারীরা বিকাশ, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা দিয়ে ক্রিপ্টো কিনে তা তাদের ওয়ালেটে জমা করে এমটিইএফে বিনিয়োগ করেছেন। একই পদ্ধতিতে লাভের টাকা নিয়েছে। এটা গোপনে করা হয়নি। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় রীতিমতো অফিস খুলে তারা এটা করেছে। যদিও এমটিইএফের নিজেদের কোনো অফিসের অস্তিত্ব নেই।

২০২১ সালের ২৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ক্রিপ্টো কারেন্সি নিয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, ক্রিপ্টোকারেন্সি, যেমন—বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, রিপল ও লাইটকয়েন বিভিন্ন জায়গায় লেনদেন হচ্ছে। এসব ভার্চুয়াল মুদ্রা কোনো দেশের বৈধ কর্তৃপক্ষ ইস্যু করে না। ফলে এ মুদ্রার বিপরীতে কোনো আর্থিক দাবি স্বীকৃত নয়। এসব মুদ্রায় লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনুমোদন করে না। তাই এর ব্যবহার বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭; সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ সমর্থন করে না। অনলাইনে নামবিহীন বা ছদ্মনামধারী প্রতিসঙ্গীর সঙ্গে লেনদেনে অনিচ্ছাকৃতভাবে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধবিষয়ক আইন লঙ্ঘন হতে পারে।

বুধবার (২৩ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘আমরা বারবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ক্রিপ্টো কারেন্সির ব্যাপারে সতর্ক করেছি। এখন যারা ওই প্রতিষ্ঠানে ক্রিপ্টো কারেন্সির মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছেন, তারাও অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। কারা জড়িয়েছেন এবং কীভাবে জড়িয়েছেন, সেটা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে।’

অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বাংলাদেশিদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া ওই প্রতিষ্ঠানটি একটি অ্যাপ-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। ওই অ্যাপের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলে বাংলাদেশিরা বিনিয়োগ করতো। আর বাংলাদেশি মুদ্রাকে আরেকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ডলারে ক্রিপ্টো কারেন্সি করা হতো। বাংলাদেশিরা টাকা দিতো বিকাশ, রকেট বা অনলাইন মানি ট্রান্সফার, ব্যাংক ও হুন্ডির মাধ্যমে।

শেরপুরের ফরহাদ নামে একজন বলেন, ‘আমরা আসলে জানতাম না, কীভাবে কী হয়! পরিচিত একজনকে বিকাশে টাকা দিতাম, তিনিই আমাদের অ্যাকাউন্ট খুলে দেন। আবার আমাদের একটি কোড নম্বরের স্ক্রিনশট পাঠাতেন, সেটা তাদের পাঠালেই বিকাশে আমাদের ডলারের সমপরিমাণ টাকা পাঠাতেন।’

জানা গেছে, এই কাজে বাংলাদেশে একটি সংঘবদ্ধ চক্র কাজ করতো। তারা এ কাজের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক গ্রুপ ব্যবহার করতো।

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘বাংলাদেশে ক্রিপ্টো কারেন্সি অবৈধ। সুতরাং, কোনো বৈধ প্রক্রিয়ায় ক্রিপ্টো কারেন্সির লেনদেন সম্ভব নয়। এখানে যারা বিনিয়োগ করেছেন, তারা বাংলাদেশি মুদ্রায় করেছেন। মাঝের একটি গ্রুপ টাকাকে ডলার ও ক্রিপ্টো কারেন্সিতে রূপান্তরের কাজ করেছে। আবার সেটা টাকায় রূপান্তরিত করে বিনিয়োগকারীদের দিয়েছে।’

জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘এই অবৈধ লেনদেন মনিটরিং করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আরও অনেক সংস্থা আছে, তারা কী করেছে? সেটাই এখন প্রশ্ন। ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাকিংয়ে কোনো অস্বাভাবিক লেনদেন হলে সেটা তো দেখার কথা।’

প্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘যারা টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছেন, তারা তো অবৈধ কাজ করেছে। আর যারা বিনিয়োগ করেছেন তারাও অবৈধ কাজ করেছেন। তবে মনিটরিং থাকলে এটা হয়তো আগেই ঠেকানো যেত। যারা প্রতারিত হয়েছেন, তাদের কোনো প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ আমি এখানে দেখছি না।’

জাকারিয়া স্বপন আরও বলেন, ‘দেশের অভ্যন্তরেই এমএলএম, ই-কমার্সের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতারণা হলো। তারই আমরা কিছু করতে পারি না। আর এটা তো বিদেশে বসে ভার্চুয়াল প্রতারণা। আমরা লোভ সামলাতে না পারলে এরকম আরও হতে পারে।’

ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এখানে সিস্টেমে তো গলদ আছে। দেশের টাকা বাইরে চলে গেল। এটা তো পাচার। সেই পাচার ঠেকানো যাদের কাজ, তারা তো ঠেকাতে পারেনি। তবে কেউ যদি ডলার দেশের বাইরে তার অ্যাকাউন্ট থেকে করে থাকে, সেখানে কিছু করার নেই। কিন্তু, এরকম ঘটনা আবারও ঘটতে পারে। তাই এখন তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন কারা টাকা পাঠিয়েছে, কীভাবে পাঠিয়েছে। সেটা বের করা গেলে ভবিষ্যতে হয়তো এটা বন্ধ করা যাবে। ক্রিপ্টো কারেন্সি অবৈধ। তারপরও সেটা এখানে ব্যবহার হচ্ছে। এর মাধ্যমে আরও টাকা পাচার হচ্ছে বলে আমার ধারণা।’

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিকাশ বলেন, ব্যাংক বলেন, তারা তো আর ক্রিপ্টো কারেন্সি করে দিতে পারে না। তাদের সেই সুযোগ নেই। তাই যারা এটা করে, তাদের ধরার জন্য দক্ষ লোক দরকার। যে রেগুলেটরি বডিগুলো আছে, আদের আরও দক্ষ এবং সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ যাদের দায়িত্ব, তারা এটা তদন্ত করছে। আমরাও দেখছি। তবে, আমাদের পক্ষে এটা আগে বোঝা সম্ভব ছিল না। কারণ, যারা ক্রিপ্টো কারেন্সির মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছেন, তারা গোপনে করেছেন। তারা জানতেন, এটা অবৈধ। প্রকাশ হলে তিনি করতে পারবেন না, ধরা পড়বেন। এখন প্রতারিত হওয়ার পর বলছেন।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরও বলেন, ‘কারো ব্যক্তিগত পর্যায়ের লেনদের মনিটরিং করা কীভাবে সম্ভব? আর সেটা তো করছে গোপনে। প্রকাশ্যে করলে আমরা দেখতে পারতাম। তারা নিজেরা অবৈধকাজে জড়িয়ে পড়ছে। এর আগে আমরা এমএলএম, ই-কমার্স নিয়েও সতর্ক করেছি। তারপরও প্রতারণা হয়েছে। মানুষ সতর্ক হচ্ছে না। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক সিআইডির সহায়তায় এই ধরনের বেশ কিছু ওয়েবসাইট বন্ধ করেছে। কিন্তু, ১০টি বন্ধ করলে নতুন চারটা শুরু হয়। তাই মানুষের সচেতন এবং সতর্ক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ সময়: ১১:১২:১৭ ● ১৭৩ বার পঠিত