সোমবার ● ২১ আগস্ট ২০২৩
ফের পেঁয়াজের বাজার ‘সেপ্টেম্বর আছর’
Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » ফের পেঁয়াজের বাজার ‘সেপ্টেম্বর আছর’
বঙ্গ-নিউজঃ দেশে উৎপাদন বাড়লেও চাহিদা মেটাতে প্রতিবছরই পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। আমদানির সিংহভাগই হয় ভারত থেকে। তাই ভারতে রপ্তানি বন্ধ, মূল্যবৃদ্ধি কিংবা শুল্ক আরোপ– এ জাতীয় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সঙ্গে সঙ্গে দেশে এর প্রভাব পড়ে। চার বছর ধরে এর প্রভাব দেশের ভোক্তাদের বেশ ভুগিয়েছে, বিশেষ করে সেপ্টেম্বর মাস এলেই এ ধরনের পরিস্থিতি বেশি দেখা যায়।
পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় দেশে এক দিনেই কেজিতে দাম বেড়েছে ২০ টাকা পর্যন্ত। তাই এবারও সেপ্টেম্বরে ভোগাবে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে ক্রেতাদের মধ্যে।
অনেকেই বলছেন, কয়েক বছর ধরে এ সময়ে পেঁয়াজ নিয়ে সংকট তৈরি হয়। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রয়োজন ছিল আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া। বিশেষ করে মজুত বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। কারণ, দাম বেড়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করলেও তখন আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না বাজার।
তবে সরকারের সংশ্লিষ্টদের দাবি, ভারতে শুল্ক আরোপের কারণে দেশের বাজারে দামে প্রভাব পড়বে না। দাম বাড়লেও বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনে টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি করে খোলাবাজারে ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করা হবে।
সপ্তাহ দুয়েক ধরে পেঁয়াজের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। তবে গত শনিবার ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এমন খবরে এক দিনেই দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় ওই বছর বেশ টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয় দেশের বাজারে। তখন পাকিস্তান, মিয়ানমার, তুরস্ক, চীন ও মিসর থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিল। নৌ ও স্থলপথের পাশাপাশি আকাশপথেও আমদানি হয়েছিল। এরপরও প্রায় ৩০০ টাকা ছুঁয়েছিল পেঁয়াজের দাম। এরপরের বছরও ঠিক একই সময়ে রপ্তানি বন্ধ রেখেছিল ভারত। সে বছরও ২০০ টাকা ছাড়িয়েছে দাম। ২০২১ সালে ভারত রপ্তানি বন্ধ না করলেও নানা কারণে বাংলাদেশের বাজারে কমবেশি প্রভাব পড়েছে। দাম দেড়শ বা এর কাছাকাছি পর্যায়ে উঠেছে।
এক দিনেই কেজিতে বাড়ল ২০ টাকা
ভারতের শুল্ক আরোপের খবরে এক দিনের ব্যবধানে দেশে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে খুচরা পর্যায়ে। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল কাঁচাবাজার ও সেগুনবাগিচা বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। আমদানি করা পেঁয়াজের কেজিতে ২০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭২ টাকায়।
কারওয়ান বাজারের স্বদেশ বাণিজ্যালয় আড়তের পাইকারি ব্যবসায়ী মিন্টু মিয়া বলেন, গত শনিবার সকালে শ্যামবাজারে পাইকারিতে ভারতীয় পেঁয়াজের কেজি ছিল ৪০ থেকে ৪২ টাকা। ওইদিন রাতে এক লাফে কেজিতে ১৪ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে দাম উঠেছে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকায়। একইভাবে দেশি পেঁয়াজের দামও কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে উঠেছে ৭৫ থেকে ৭৬ টাকায়। শ্যামবাজারে বাড়লে ঢাকার সব বাজারে এর প্রভাব পড়ে।
হিলি স্থলবন্দরের আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুনুর রশিদ বলেন, ভারতের শুল্ক আরোপে দেশটির ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়াবেন। তাতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের পেঁয়াজ আমদানি খরচ বাড়বে। এর প্রভাবে এরই মধ্যে দাম বেড়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, আগের এলসি করা পেঁয়াজেও শুল্ক কার্যকর হবে। শুল্ক আরোপের পর গতকাল কোনো পেঁয়াজ আসেনি হিলি বন্দর দিয়ে। তবে ভারতের ব্যবসায়ীরা কত দরে পেঁয়াজ রপ্তানি করবেন, তা আজ থেকে জানা যাবে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ভারতে রপ্তানিতে শুল্ক আরোপের ঘোষণায় দেশে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের চিরাচরিত স্বভাব এমনই। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তি দামে পণ্য দেশে আসার আগেই দাম বাড়িয়ে দেন তারা। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও পণ্যের চালান এখনও দেশে এসে পৌঁছায়নি– এমন অজুহাতে দাম কমাতে চান না তারা। তিনি বলেন, কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রয়োজন ছিল আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা। বিশেষ করে মজুত বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। তবে এখন কোনো সুযোগসন্ধানি চক্র যেন কারসাজি করতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।
উৎপাদন ও আমদানি পরিস্থিতি
বাংলাদেশে এবার ৩৪ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। তবে যথাযথ সংরক্ষণের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে উৎপাদনের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। সেই হিসাবে আনুমানিক ১০ লাখ টন পেঁয়াজ নষ্ট হলেও প্রকৃত উৎপাদন প্রায় ২৪ লাখ টন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ টনের মতো। তবে এ তথ্য মানতে নারাজ আমদানিকারকরা। তাই দেশে ভালো উৎপাদন হলেও চাহিদা মেটাতে প্রতি বছরই অনেক পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।
আমদানিকারকরা বলছেন, আগে ১৫ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি হতো। এখন সরকার পেঁয়াজ উৎপাদনে প্রণোদনা দেওয়ায় উৎপাদন বেড়েছে। তার পরও ১০ লাখ টনের বেশি আমদানি করতে হয়। যার ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই আসে ভারত থেকে। বাকি ৫ থেকে ১০ শতাংশ আসে মিয়ানমার, তুরস্ক ও পাকিস্তান থেকে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ জুন থেকে গত শনিবার পর্যন্ত ১৩ লাখ ৪ হাজার ২৮৪ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত দেশে এসেছে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৫০৮ টন। অর্থাৎ আমদানি হয়েছে অনুমোদনের মাত্র ২৭ শতাংশ।
যা বলছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা
গতকাল এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ১৩ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিলেও এসেছে মাত্র ৩ লাখ টন। এর অর্থ হলো, দেশে পেঁয়াজ আছে। মাঠ পর্যায়েও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কৃষকদের কাছে এখনও পেঁয়াজের মজুত আছে। ভারতের রপ্তানিতে শুল্ক আরোপে দেশে তেমন প্রভাব পড়বে না। শুল্ক আরোপের ঘোষণায় দাম কিছুটা বাড়লেও কয়েক দিন পর কমে আসবে। তুরস্ক, মিসর ও চীন থেকে আমদানির চেষ্টা করা হবে বলেও জানান তিনি।
এ ব্যাপারে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ সমকালকে বলেন, এরই মধ্যে ভর্তুকির মূল্যে বিক্রি করার লক্ষ্যে টিসিবিকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দাম স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনে টিসিবি আমদানি বাড়াবে। এ ছাড়া ভারতের বিকল্প হিসেবে অন্য দেশ থেকেও আমদানি করা যায় কিনা, সে বিষয়ে পর্যালোচনা করা হবে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, দেশের বৃহৎ পাইকারি মোকাম খাতুনগঞ্জে আবারও বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। গত শনিবার ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। গতকাল বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকার ওপরে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজির দাম ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। গ্রামীণ বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী চন্দন কুমার পোদ্দার সমকালকে বলেন, ভারতে শুল্ক আরোপের কারণে সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে। আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির নেতা মো. ইকবাল বলেন, ‘মূলত স্থলবন্দরের আমদানিকারকরা ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেন। সেই পেঁয়াজ ব্যাপারীদের মাধ্যমে খাতুনগঞ্জের আড়তে পৌঁছে। এখানকার ব্যবসায়ীরা কমিশনের ভিত্তিতে পেঁয়াজ বিক্রি করেন। কারসাজি করলে স্থলবন্দরের আড়তদার, ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা করতে পারেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ভারতের শুল্ক আরোপের খবরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দরের খুচরা ও পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম এক লাফে বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে। এদিকে সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে গতকাল কোনো পেঁয়াজের ট্রাক প্রবেশ করেনি। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, গোয়েন্দা নজরদারি না বাড়ালে দাম আবার বাড়বে হু হু করে। সোনামসজিদ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান পানামা পোর্ট লিংকের কর্মকর্তা কামাল খান জানান, গত শনিবার এ বন্দর দিয়ে ৮৭টি পেঁয়াজের ট্রাক দেশে প্রবেশ করেছিল।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৫৯:২৯ ● ২৫৫ বার পঠিত