মঙ্গলবার ● ১১ জুলাই ২০২৩
রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন :৩০৪ তম পর্ব-জালাল উদ্দীন মাহমুদ
Home Page » সাহিত্য » রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন :৩০৪ তম পর্ব-জালাল উদ্দীন মাহমুদ, হাজেরা আপার জল চিকিৎসা-২
–ব্যাংকে তখন প্রতি মাসের ২৭/২৮ তারিখের দিকে বেতন হতো। আমি সর্ব-সাকুল্যে হাজার দুয়েক টাকা মাহিনা পেতাম। আর দৈনিক ১০/= টাকা হারে লাঞ্চ সাবসিডি। বাসা ভাড়া দিতাম ৫০০/৬০০ টাকার মতো। বাড়ি থেকে বেশ কিছু সাহায্য পেতাম। স্ত্রীও চাকরি করত। ঘরে শিশু সন্তান। তার জন্য ল্যাক্টোজেন গুঁড়া দুধ – সেরিলাক সিরিয়াল-খেলনা এ সব কিনতে হতো । ইন্স্যরেন্সের প্রিমিয়াম আর ডি পি এস এর কিস্তি জমা দিতে হতো। তারপরও মোটামুটি চলে যেত। তবে হাতে তেমন বেশি কিছু থাকতো না। কেউ ধার চাইলে দেয়া কঠিন হয়ে যেত।
একদিন জোনাল অফিসে কর্মরত উক্ত সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার কাজেম উদ্দিন স্যার আমার সামনে বসে প্রথমে রসিয়ে রসিয়ে অনেক গাল গল্প করলেন। তার সংসারের অভাব অনটনের কথা জানালেন। তারপর আমার হাতে তার নিজের অ্যাকাউন্টের ৫০০/- টাকার চেক ধরে দিয়ে বললেন, এই চেকটা তোমার কাছে রাখ। বেতন হলে ভাঙ্গিয়ে নিও। আর এখন ক্যাশিয়ারকে বলো আমাকে ৫০০/- টাকা দিয়ে দিতে। আমি কিছু বলার আগেই উনি উঠে গিয়ে আমার নাম বলে ক্যাশিয়ারের নিকট থেকে ৫০০/- টাকা নিয়ে মুহুর্ত্যের মধ্যেই কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলেন। আমার পকেটে ৫০০/- টাকা ছিল না। স্থানীয় কেউ তখন ৫০০/- টাকা পকেটে নিয়ে অফিসে আসবে এমন আশাও করা যায় না। তাহলে আমি কোত্থেকে এই ৫০০/- টাকা ক্যাশে পুরে দিব। বেতন তো হবে আরো ১০/১২ দিন পরে। এই ১০/১২ দিনের জন্য আবার কার কাছ থেকেই বা আজ ধার চাব। আর ধার চাবার মতো মানসিকতা আমার কোনও কালেই ছিল না। চাকুরি জীবনে যত ধার নিয়েছি তার প্রায় সবই ঐ প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে। যত সখ্যতা ছিল তা ঐ ফান্ডের সাথে। আমার পাশে যারা বসতো তাদেরও প্রায় সবাইকে দেখতাম ক্লোজিংয়ের পর পর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে নিয়ে সংসারের বাড়তি ব্যয় নির্বাহ করত। আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল পলিমাটি এলাকায়। জমিতে প্রচুর ধান জন্মাতো। কিন্তু উন্নত মানের না। উন্নত মানের ধান হতো আমাদের বাড়ির পাশের খিয়ার, তথা বরেন্দ্র এলাকার লাল মাটিতে। প্রত্যেক বছর মাঘ মাসে আমরা খিয়ার এলাকার খরনা হাট থেকে উন্নত মানের চিকন চাল কিনে ড্রাম ভর্তি করে রাখতাম, সারা বছরের চাহিদা মিটানোর জন্যে। প্রত্যেক বছর গিন্নি তাগাদা দিত , কইগো এখনও যে চাল কিনলে না। মাঘ মাস তো শেষ হতে চলল।
আমার হাতে যে তখন টাকা নাই একথা তাকে বুঝতে দিতাম না। কারন আমার বেতন থেকে কর্তন করে নেয়া প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তো আছেই। সেখান থেকে টাকা তুলে নিয়ে ঝটপট খরনা হাট থেকে সরুসরু চাল কিনে আনতাম। সাথে কিছু সুগন্ধী পোলাওয়ের চালও নিতাম। চাল কেনার মধ্যস্থতা করার জন্য খরনা হাট এলাকায় কিছু লোকের সাথে খাতিরও জমে গিয়েছিল তখন। আমাদের গ্রামের বাড়ি এলাকায় সর্ব-প্রকার তরি-তরকারী জন্মাতো। আমার মা জমি চাষকারীদের বলে সবসময় টাটকা তরিতরকারী সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতেন। এভাবেই তখনকার দিনে স্বল্পবেতনে একজন সিনিয়র অফিসারের সংসার চলছিল। টাকা ধার দেয়ার মতো অতিরিক্ত টাকা কোথায় ?
কিন্তু ক্যাশে তো টাকা অ্যাডজাস্ট করতে হবে। কোনও পার্টির কাছ থেকে কি টাকা ধার চাব? না, আমি তা পারবো না। চেকটা টেবিলে পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা দিয়ে অন্যমনষ্কভাবে এসব ভাবছিলাম। পাশেই বসা রফিক সাহেব বিষয়টি খেয়াল করছিল। সে আমার সামনে এসে বসল। সব শুনলো। অভয় দিল। বলল- স্যার যে ভাবে অ্যাকটিং করে টাকা নিয়ে গেল সেখানে আপনার তেমন কিছু করার ছিল না।আনোয়ারা আপা এখানে থাকলে সে সাহস পেত না। যা হোক বিকেলে সে মামুন ক্লোথ স্টোরে গিয়ে ৫০০/- টাকা ধার নিয়ে এসে ক্যাশ সমন্বয় করে দিবে। বেতন হবার সাথে সাথে কাজেমউদ্দিন স্যারের অ্যাকাউন্ট থেকে চেকটা ডেবিট করে আবার তাদের টাকা দিয়ে আসবে। বিষয়টা এভাবেই সেদিন একটা সমাধান হয়েছিল। কিন্তু সেদিন আমি বা রফিক সাহেব স্বপ্নেও ভাবি নাই এ সমস্যার এটা কেবল শুরু ।
প্রত্যেক মাসের ১০/১২ তারিখের দিকে অথবা মাস শুরুর দিকে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে লাগল। এরপর ঐ স্যার আর আমার কাছে আসত না। সরাসরি ক্যাশিয়ারের কাছে গিয়ে তাকেই ২৬ তারিখের ডেট দেয়া চেকটা দিয়ে টাকা নিয়ে যেতে শুরু করল। আর বিকেলে আমি রফিক সাহেবের দ্বারস্থ হয়ে বিষয়টি সমাধান করতে লাগলাম। দু’জনেই ভিতরে ভিতরে ফুঁসতে লাগলাম।
কয়েকবার আমরা স্যারকে বললাম যে, এভাবে প্রত্যেক মাসে টাকা ম্যানেজ করা সম্ভব না। স্যার তখন তার সংসারের নানা অনটনের গল্প শুনাতো। আর মোলায়েম সুরে বলতো ছোট ভাই আমার, ছোট ভাই আমার, লক্ষীভাই আমার, আমার জন্য একটু কষ্ট করো। আমরা তার মধুর মধুর কথায় তাৎক্ষনিকভাবে বিগলিত হয়ে চুপ করে থাকতাম।
প্রতি মাসে এভাবে টাকা ধার করে এনে ক্যাশপুরে দেয়ার ঝক্কি-ঝামেলাও রফিক সাহেবকেই সামলাতে হচ্ছে।রফিক সাহেব শুধু আমার চেয়ে বয়সেই বড় না, জ্ঞান-বুদ্ধিতেও বড়। একদিন সে বলল, কাজেম উদ্দিন স্যারের অভাব-অনটন আসলে কোন বিষয় না। টাকা ধার করা তার মজ্জাগত। অনেকের কাছ থেকেই সে টাকা ধার নেয়। এভাবে দেখবেন একদিন সে বদলি হয়ে যাবে- বেতন এখান থেকে আর হবে না। তার শেষবারের চেকের টাকাটা আমরা আর তুলতে পারব না। রফিক সাহেবের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল। স্যার বদলি হবার কারনে শেষবারে ধার নেওয়া টাকাটা আমি তুলতে পারিনি। সে চেক এখনও আমার কাছে আছে। এখানে একটা কথা বলে রাখি, অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার করে এভাবে প্রতি মাসে স্যারের চাহিদা পূরনের বিষয়টি আমার পছন্দ হচ্ছিল না। তাই পরবর্তীতে আমি নিজ পকেট থেকে প্রতি মাসে তাকে এভাবে টাকা দিয়ে ও পরে বেতন হলে তা উত্তোলনের ব্যবস্থা করেছিলাম।
কাজেম উদ্দিন স্যারের যে অচিন্তনীয়- ভয়ংকর কাহিনি বলার জন্যে এ অধ্যায়টির অবতারনা তা কিন্তু এখনও শুরুই করতে পারি নাই। এখন শুরু করব। এক সময় আসবে হাজেরা আপার জল চিকিৎসা । অধ্যায়টির নাম হাজেরা আপার জল চিকিৎসা হলেও এখানে একে একে তিন জনের জল চিকিৎসার কথা আসবে।
১) কাজেম উদ্দিন স্যারের,
২) হাজেরা আপার,
৩)ম্যানেজার সারের।
তবে “জল চিকিৎসা “ বিষয়টি আসলে কী তা জানতে একটু অপেক্ষা করতে হবে।
( চলবে )
বাংলাদেশ সময়: ৭:৪২:২৯ ● ৩২৭ বার পঠিত