মঙ্গলবার ● ৪ জুলাই ২০২৩

সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৭৪: স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৭৪: স্বপন চক্রবর্তী
মঙ্গলবার ● ৪ জুলাই ২০২৩


স্বপন কুমার চক্রবর্তী

১৯৭১,,মুক্তিযুদ্ধে যোগদান-৬

আমরা দুটি ভাই তখন কুচবিহারের পাগলাডঙ্গা শরনার্থী শিবিরে থাকি । কিছুই ভালো লাগছিল না। শুধু অজানা আশংকা । কি হবে কি করবো এমন সব চিন্তা। পরিচিত কোন লোকজন নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে যাব। এমন সময় মোঃ আনছার আলী মিয়া ও মোঃ আতিয়ার রহমান ভাই আমাকে সহায়তা করলেন। উক্ত দুই জন ব্যাক্তি প্রবাস জীবনে আমার আপনজন ছিলেন। গোতামারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পদস্থ এই দুই ব্যাক্তি ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অর্গানাইজার হিসাবে তখন কাজ করছিলেন। হাতীবান্ধা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ নজরুল ইসলাম সাহেবও তখন একত্রে ভারতের শীতলখুচিতে অর্গানাইজার হিসাবে কাজ করছিলেন। জনাব আনছার আলী মিয়া পরে দেশে এসে গোতামারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন একসময়। নজরুল ইসলাম ভাই এখনো জীবিত থাকলেও অন্য দুজন আর বেঁচে নেই। তাদের নিকট হতে সহায়তা পেয়ে নিঃশঙ্ক চিত্তে মুক্তি যুদ্ধে যোগদান করি। শরনার্থী শিবিরে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র আমার ছোট ভাইটিকে ফেলে রেখে  মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে ছিলাম। শীতলখুচির নিয়োগদান ক্যাম্প হতে যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা হয়। আমার সাথে ছিল দইখাওয়ার বোচারাম দাস। বোচারাম দাসের সাথে দেখা হয় ক্যাম্পে এসে। আমাদেরকে অন্যদের সাথে দুএক দিন রেখে পরে দিনহাটা ক্যাম্পে পাঠায়। সেখানেও দৈহিক কসরত চলতে থাকে। পরে একদিন সেনাবাহিনীর ডাক্তার দ্বারা মেডিক্যাল টেস্ট করানো হয়। যদিও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা আগে একবার হয়েছিল। ডাক্তার আমাকে হার্টের সামান্য সমস্যা আছে বলে আপাতত পাঠাতে অস্বীকার করে। কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলা হয়। আমি খুব আশা হত হলাম। আমাকে বলে দিয়েছিল যে নিয়োগকৃত ক্যাম্পের সাথে যুক্ত থাকতে। পরে আবার ডেকে নিবে। একটি প্যাডে তখন ভারতীয় পদস্থ সেনা অফিসার একটি সার্টফিকেট লিখে আমাকে দেন। বাংলাদেশী সামরিক কর্মকর্তাও সাথে ছিলেন। নিয়মিত এই ক্যাম্প থেকে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে চূড়ান্ত ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হতো। কোথায় পাঠানো হবে তা গোপন রাখা হলেও পরে শুনেছি যে, দার্জিলিং পাঠানো হতো। আমি ফিরে আসি। কিন্তু পরে আর আমাকে ডাকেননি। কিছুদিন পর দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো। সার্টিফিকেট খানা পরে আবার কোন কাজে আসবে এমনটি আর কখনও ভাবিনি। সেটিকে আর কোন যত্ন করেও রাখিনি। এটিকে হারিয়ে ফেলেছি। তবে এই সার্টিফিকেটটি দেখালে তখন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরাফেরার সময় বাসে বা ট্রেনে কোন ভাড়া নিতো না। যদিও এটা কোন নিয়ম ছিল না, শুধু সম্মান করা। তাই আমিও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেছি। পরে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি আরও নিশ্চিত হলাম তখন, যখন কিছুদিন পূর্বে আমাকে হার্টের বাইপাস অপারেশন করতে হলো। সহযাত্রী মুক্তিযোদ্ধা দইখাওয়ার বোচারাম কোন এক সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হন।

শরনার্থী শিবিরে একটি নাটক হলো। জিতেন বসাকের লিখা নাটকটির নাম ছিল “ মানুষ”। আমি একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। নাটকটি দেখে হিন্দিভাষী ক্যাম্প সুপার জে ডি শিরিন লেপচা ( J D Tshirin Lepcha ) খুব উচ্চশিত প্রসংশা করেছিলেন। লেপচা ছিলেন নেপালী বংশোদ্ভুত । তার বক্তব্য অন্য একজন আমাকে তর্জমা করে বুঝিয়ে দিয়ে ছিলেন। আর তখন শীতলখুচি ব্লকের ( থানা ) উন্নয়ন কর্মকর্তা ( Block Development Officer তথা BDO ) ছিলেন সুস্থির কুমার ঘোষ। তিনিও অনেক প্রশংসা করেছিলেন। একটা প্রাইজও পেয়ে ছিলাম। নাটকের লেখক পার্শবর্তী এলাকারই বাসিন্দা ছিলেন। তাই তাঁকেও নাটকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত অসুবিধার জন্য তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। নাটকের পাত্রপাত্রীদের সবার নাম এখন আর মনে নেই। তবে বেজগ্রামের শিক্ষক মনোমোহন বর্মণ ছিলেন, আনছার আলি মিয়া ছিলেন, ছিলেন বড়ভিটার বলরাম পোদ্দার প্রমূখ। সবাই ছিলেন বাংলাদেশি শরনার্থী।

ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে ৬ ডিসেম্বর। কিন্তু তারও অনেক পূর্ব হতেই দুটি দেশের সীমান্তে পরস্পর গুলাগুলি চলতে ছিল। কামান ও দুর পাল্লার গান থেকে সেগুলো করা হতো। সিঙ্গিমারী,ফুলবাড়ি,জাওরানী,পাটগ্রাম,কুচবিহারের হাসিমারা, কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারি, লালমনিরহাট সংলগ্ন মোঘলহাট এসমস্ত সীমান্তে প্রচন্ড যুদ্ধের শব্দে প্রকম্পিত হতো সারা এলাকা।
স্বীকৃতি দানের কিছুদিন আগেই ভারতীয় সৈন্য লালমনিরহাট জেলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। আর সে সমস্ত অন্যান্য সীমান্তের ন্যায় এই দইখাওয়া সীমান্ত দিয়েই প্রবেশ করতে আমরা দেখেছি। জলপাই রঙের কমান,ট্যাঙ্ক বহর সব বলতে গেলে বিনা বাধায় প্রবেশ করতেছিল। ছোট ছোট খাল বিল নালা খানাখন্দ মুহূর্তের মধ্যে ভরাট অথবা মেরামত করে ভারী যান, জীপ এমনকি ট্যাংক ও কামান অনায়াসে ঢুকে যেতে থাকে। পাক সৈন্য কোন প্রতিরোধই তৈরী করতে পারেনি। পশ্চাদগামী পাক বাহিনী যে সব ব্রীজ কালভার্ট ,রেল লাইন যা ভেঙ্গে দিয়ে দিয়ে পিছু হটতে ছিল , সবই নিমিষে মেরামত করে ভারতীয় সৈন্য অগ্রসর হতে থাকলো। লালমনির হাটের পর কাউনিয়ার মাঝখানে তিস্তা রেল স্টেশন। তারপরই তিস্তা নদীর উপর ব্রিটিশদের নির্মিত তিস্তা সেতু। পাকবাহিনী পশ্চাদ অপসারণকালে সেতুটি পার হয়েই পিছন দিকের তিনটি স্তম্ভ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু ভারতীয় বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এটির নিচ দিয়ে খালি ড্রাম দিয়ে এবং রাবারের কুশন দিয়ে তার উপর পাটাতন দিয়ে সেতু তৈরী করে, যার উপর দিয়ে ভারী যানবাহন চলতে সক্ষম হয়। ভারতীয় বাহিনী সমস্ত রাস্তা জুড়ে টেলিফোনের তার ফেলে ফেলে  অগ্রসর হতে থাকলো। এই তার মাটিতে পড়ে থাকলেও কেহ এর কোন ক্ষতি করেনি। জনসাধারণের কি আনন্দ। সবাই অহেতুক সাথে সাথে চলছে। আমরাও সাথী হয়ে প্রায় প্রতিদিন বহুদুর গিয়েছি। মাঝে মাঝে পাবলিকের উদ্দেশ্যে ভাংগা ভাংগা বাংলায় বলতো-  “বলো জয় বাংলা।” সবাই আনন্দে এই শ্লোগান উচ্চারণ করেছে। আমরাও করেছি। দুই সৈন্য বাহিনীর মধ্যে কি বিস্তর পার্থক্য। পাকিস্তানী সৈন্য দেখলে মানুষ জান-মাল বাঁচাতে দৌড়ে পালায়। আর ভারতীয় সৈন্য দেখলে তাদের সাথী হয়। ভারতীয় বাহিনীকে কোন উপকার করা যায় কিনা সেটা সাধারণ লোকজন জানতে চায়। তবে ভারতীয় সৈন্য কোন সহায়তা চায়নি। তারা একেবারে সাজোঁয়া বাহিনী। ক্ষেতে খামারে হঠাৎ সামান্য ঝোপের আড়ালে রান্নাবান্না করে নিচ্ছে। ট্রাক থেকে ছাগল মুরগী নামিয়ে মাংস প্রস্তুত করা এবং ডালডা দিয়ে রান্না করা সবই করছে। সাথেই ছিল লাকড়ী। সৈন্যদের কারো কারো পিঠে বিরাট এন্টেনা যুক্ত ওয়ারলেস। কথা বলে নিচ্ছে অন্য অগ্রগামী টীমের সাথে। আমরা এসব উপভোগ করেছি। কোন সৈন্য কারো কোন ক্ষতি করেনি। লুট করেনি। নারী ধর্ষণ করেনি। আর অন্যদিকে পাক বাহিনীর নির্যাতন, বর্বরতা, সহিংসতা,লুটতরাজ শ্লীলতাহানি এবং অকারণে নিরস্ত্র লোক হত্যা করাই তাদের ছিল নিত্যদিনের জঘন্য সব দৃষ্টান্ত। বিশ্বের একটা অসভ্য বাহিনী রূপে পরিচয় দিলো পাকবাহিনী। বরং আত্মসমর্পনকারী পাকবাহিনীর প্রতি জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যথেষ্ট ভদ্র আচরণ করেছে ভারতীয় বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাদের এবং দেশবাসীর প্রচন্ড আক্রোশ হতে রক্ষা করে দিয়েছে পাকিদেরকে। তাদেরকে হত্যা করতে বা নির্যাতন করতে দেয়নি ভারতীয় সৈন্যরা। দুইটি বাহিনীর মধ্যে কি যোজন যোজন পার্থক্য। ( চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ২১:১৯:৩৭ ● ৬৬৬ বার পঠিত