শনিবার ● ২৪ জুন ২০২৩

সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৭০: স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৭০: স্বপন চক্রবর্তী
শনিবার ● ২৪ জুন ২০২৩


স্বপন কুমার চক্রবর্তী

১৯৭১,মুক্তিযুদ্ধ-২

বিভিন্ন খবরে জানা যেতো যে রাজাকাররা বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাক বাহিনীর হাতে সোপর্দ করে দিয়েছে। পাক বাহিনী বাঙালিদেরকে শিহরণ জাগানিয়া ভাবে নির্যাতন করতো। পাক বাহিনী তাদের জীপ গাড়ীর পিছনে বেঁধে পূর্ণ গতিবেগে গাড়ী চালিয়ে দিতো। নয়তো অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেলতো। রাজাকারেরা নারীদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে তুলে দিয়েছে শত্রু বাহিনীর হাতে। কত বীভৎস সব ঘটনা। নারী নির্যাতন ছিল গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠার মতো। সব নির্যাতন ছিল ধারণা করার চেয়েও অনেক গুণ বেশি। আর্মি ক্যাম্পে বস্ত্রহীন অবস্থায় রাখা হতো নারীদেরকে। শরীরের বিভিন্ন স্পর্শ কাতর অংশ বেয়নেট দিয়ে কেটে দিনের পর দিন নির্যাতন করে কাউকে কাউকে মেরে ফেলা হতো। যুদ্ধনীতির সকল কিছুই ছিল পাক বর্বরদের নিকট মুল্যহীন, অর্থহীন । নীতিহীন কাজই ছিল তাদের নীতি। জেনারেল টিক্কাখানের ঘোষণাও তেমনি ছিল। লোকের প্রয়োজন নেই ,প্রয়োজন মাটির। মেয়েদের গর্ভে পাক সন্তান জন্ম নিলে নাকি বাঙালির কোন চিহ্ন থাকবে না এদেশে। সব পাকসাফ হয়ে যাবে। তাদের সকল কর্মকান্ড এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় পাশবিক।
এই দুর্যোগ সময়ে ক্ষেতের ফসল কেটে নিয়ে গেছে সুযোগ সন্ধানী অনেক লোকজন। ঘরের টিন খুলে নিয়ে গিয়ে ঘরগুলোকে নাঙ্গা করে ফেলে রেখে দিয়েছে। তখন রাজাকারদের ভাবভঙ্গি এমন ছিল যে, তারা নিজেদেরকে একমাত্র পাকিস্তানের খাঁটি সেবক ও রক্ষাকর্তা ভাবতে লাগলো। রাজাকারেরা নিজেদেরকে সমাজের অনেক উঁচু স্তরের মানুষ তথা নিজেদেরকে ”সুপেরিয়র” ভাবতে লাগলো। হাটে বাজারে এসে এমন সব ভাব করতো যে, তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ ভুমিকাটি পালন করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা বাংলার চেয়ে ভুল উচ্চারণে উর্দূ বলাকে বেশী মর্যাদা পূর্ণ কাজ বলে বিবেচনা করতে শুরু করে দিয়েছিল। সাধারণ মানুষ ও দোকানদারদের সাথেও অনাবশ্যক উর্দূ ব্যবহার শুরু করে দিয়েছিল। তাদেরকে নিয়ে বহু গল্প প্রচলিত আছে । যেমন- কিছু রাজাকার ভাঙ্গা একটি কালভার্ট মেরামত করে দিতে কিছু নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে এসেছে। তাদেরকে ফৌজি ভাষায় নির্দেশে দিতে চেষ্টা করছে। বলছে, “ এধার ছে মাটি কাটকে লিয়ে ও ধারমে ছড়াইয়া বড়াইয়া ফালাইয়া দেও। “ আর এক রাজাকার নাকি বাজারে গিয়ে দেখে তার কিনে রেখে যাওয়া চিংড়ি মাছ কে যেন পায়ে মাড়িয়ে দিয়েছে। সে খুব ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে ব্যাপক ভাবে ভুল উর্দূ ভাষায় গালি শুরু করে দিল। বললো, ম্যায় এক রূপেয়াকা চিংড়ি মাছ কিনকে লিয়ে এ ধার মে রাখা হ্যায়। আর কোন শালার ব্যাটা শালা তা পাড়াইয়া সব চেপ্টাইয়া ফালছে। ম্যায় ভি দেখলুংগা।” ইত্যাদি।

মুক্তিযোদ্ধাগণ কি নিদারুণ কষ্ট করেছে তা বর্ণনাতীত। নিজে চোখে সব কাছে থেকে দেখেছি। তাদের পরনে লুঙ্গি গায়ে সেন্ডু গেঞ্জী , কারো কারো পায়ে সেন্ডেল আছে ,কারো বা তাও নেই। নগ্ন পায়ে, দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে, মাথায় বাক্স আর ঘাড়ে ঝুলানো রাইফেল,স্টেনগান বা মর্টার নিয়ে চলছে। কোথাও বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। তাদের সাথে ভালো অস্ত্র বলতে বড়জোর একটা এলএমজি বা এসএমজি। তাদের কন্ঠে গান-” মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি। “ অপর দিকে রাজাকারেরা গাইছে – “রাজা ছাঁইয়া দেনা রে ,দিল মে আনা রে, ছম ছমা ছম ছম। চাঁদনীকা রাত হোগা .থোড়া থোড়া বাথ হোগি..।”
(চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ২০:৩১:০৩ ● ৭১৮ বার পঠিত