মঙ্গলবার ● ২০ জুন ২০২৩

বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসেরের গল্প - অধ্যাপক ড. জেবউননেছা

Home Page » ফিচার » বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসেরের গল্প - অধ্যাপক ড. জেবউননেছা
মঙ্গলবার ● ২০ জুন ২০২৩


বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের

স্বাধীনতা সংগঠক, বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক অধ্যাপক মযহারুল ইসলাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্পর্কিত একটি গ্রন্থ লিখেন। যে গ্রন্থটির নাম ছিল ‘ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব”। বলা চলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সর্বাপেক্ষা নির্ভরশীল এই গ্রন্থটি । ১৯৭৪ সালে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৫৫ তম জন্মদিনে বঙ্গবন্ধুর হাতে গ্রন্থটি তুলে দেয়া হয়। এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে তিনি লিখেছিলেন,‘ যা হোক ইতিহাসের মূল লক্ষ্য একটি সমাজ ও জাতি- কিন্তু কোন সমাজে বা জাতিতে এমন একজন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে,যার কার্যকলাপ সেই সমাজ বা জাতিকে এক নতুন মাহাত্ম্যে অভিষিক্ত করে- নতুনভাবে আলোড়িত করে-একটি দেশ,সমাজ বা জাতিকে নবজন্ম দান করে। শেখ মুজিব এমনি একজন অসাধারণ ব্যক্তি’। সত্যি বঙ্গবন্ধু যেমন দেশমাতৃকার জন্য বছরের পর বছর কারাবরণ করেছেন,ঠিক তেমনি তাঁর পরিবার,স্বজনদের জন্য ও ছিল ভালবাসা। কিন্তু অগ্রাধিকার দিয়েছেন দেশমাতৃকাকে। এখানেই তার এবং তাঁর পরিবারের মাহাত্ম।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সায়েরা খাতুন এবং শেখ লুৎফর রহমানের ঘর আলো করে ১৯২৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই শেখ আবু নাসের জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের আলো ছায়ায় বেড়ে উঠা শেখ নাসের ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর পরই ব্যবসায়িক কারণে খুলনা আসেন। ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু যখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন,সে সময়ে শেখ আবু নাসের পাবনার বিখ্যাত হেরাজ ম্যানশনের মালিক হেরাজ বিশ^াসের কন্যা বেগম রাজিয়া নাসের ডলির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক কোন কর্মসূচীতে খুলনায় গেলে শেখ নাসেরের নূরনগরস্থ বাড়ীতে উঠতেন। শেখ নাসেরের ব্যবসা ভালই চলছিলো। কিন্তু ভাগ্য তাকে সাহায্য করেনি। তাইতো ১৯৭১ এ পাক হানাদাররা শেখ নাসেরের সকল ব্যবসা বন্ধ করে দেয়।
ছেলেবেলা ভীষণ দুরন্তপনা শিশুটি ১৯৭১ এ রনাঙ্গনের ৯ নম্বর সেক্টরের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শেখ নাসের টুঙ্গিপাড়ায় যুবকদের সংগঠিত করেন। প্রায় মাস খানেক পর ১৯৭১ এ ২৪ জুন ভারতে যান। ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত তার বাড়ী ৯ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার পরগনার টাকির গাঙ্গুলি বাড়িতে নিয়ে যান শেখ নাসেরকে। এর কয়দিন পর শেখ নাসের টাকি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
৯ নম্বর সেক্টরের অধীন বৃহত্তর বরিশাল সাব সেক্টরের টু আই সি আব্দুল হক বীর বিক্রম তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন,-‘অমায়িক ব্যবহার ছিল তার। কম কথা বলতেন। সারাদিন রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনতেন,যুদ্ধের অগ্রগতি জানতে চাইতেন। বাংলাদেশে থাকা তার স্ত্রী সন্তানদের জন্য চিন্তা করতেন।’ শেখ নাসের বাগেরহাটের সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সামশু মল্লিক সহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চিতলমারি দিয়ে বাগেরহাটে প্রবেশ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আর একটি সূত্র থেকে জানা যায়,১৯৭১ সালে সাতক্ষীরা জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করতে যান। শেখ নাসেরকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেবার দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে একজন ছিলেন কাশেম মোল্লা (২৭.০৯.২০২০, দৈনিক সমকাল) । এই ক্ষুদ্র ঘটনা থেকে বোঝা যায় মেখ নাসের তাঁর দায়িত্বের প্রতি কতটা অবিচল ছিলেন।
সহজ সরল অবয়বের এই মানুষটির ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে বিদেশী গণমাধ্যমে একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেছিলেন, তা পরবর্তী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল। তিনি সচিত্র সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এখন হাজার হাজার ছেলে আসছে,তারা ট্রেনিং নিচ্ছে। হাজার হাজার মেয়েরা ট্রেনিং নিচ্ছে। আনসার,পুলিশ,ইপিআর,বেঙ্গল রেজিমেন্ট সবাই এখন তারা নিজেরা ইচ্ছে করে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করছে। মুক্তিবাহিনীর জন্য যদি সাহায্য পাই পৃথিবীর সমস্ত দেশের থেকে যেমন,প্লেন,নেভাল এবং হেভী আর্মস অচিরেই বাংলাদেশ পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে সরকার বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নেবে । বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট যে সমস্ত জায়গা মুক্তিবাহিনী দখল করে নিয়েছে সে সমস্ত প্রায় ৩০/৪০ মাইল পর্যন্ত আমরা ভিতরে দখল করে নিয়েছে আমাদের মুক্তিবাহিনী। সেখানে বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট একজন ডিষ্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট,এসপি,এসডিও,থানা অফিসার,পোষ্ট অফিস সব সে দিয়েছে সেখানে এবং তারা সেখানে এডমিনিষ্ট্রেশন চালাচ্ছেন এবং তার দ্বারা সেখানে সব দেখাশোনা সমস্ত রকমের মুক্তিবাহিনী সাহায্য করছে যাতে পাকিস্তান আর্মি আবার এসে এটাক না করতে পারে। সেজন্য সেখানে মুক্তিবাহিনীরা দেখছে এবং গভর্নমেন্ট ও সেভাবে চালাচ্ছে এবং সেখানে আমাদের ষ্টাম্প চলছে। সেখানে আমাদের হসপিটাল আছে এবং সমস্ত অফিসার আমাদের বাংলাদেশের গভর্নমেন্ট থেকে সেখানে এপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে (শেখ আবু নাসেরর সচিত্র সাক্ষাৎকার,বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়েবসাইট, আপলোডেড ১৩.০৩.২০২২) । একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বয়ান থেকেই বুঝে নিতে খুব বেশী অসুবিধা হয়না যে,তাঁর শরীরে বইছিল দেশকে স্বাধীন করার উত্তেজনা এবং আগ্রহ। যিনি বঙ্গবন্ধুর ¯েœহধন্য ভাই। বঙ্গবন্ধু তাঁর গ্রন্থে লিখেন,‘ আমার ছোট ভাই নাসের ব্যবসা শুরু করেছে খুলনায়। সে আমার ছেলে মেয়েদের দেখাশোনা করে। বাড়ি থেকে তার কোন টাকা পয়সা দিতে হয়না। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে কিছু টাকা বাড়িতে দিতে শুরু করেছে (রহমানঃ ২০১২:২২১)। কতটা পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হলে এমনটি হতে পারে। আর এ ধরণেল ভালোবাসার বন্ধনের ক্রাণে টুঙ্গীপাড়ার খোকা একদিন বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন।
অপর আর এক অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ আমি নিজেও খুব চিন্তাযুক্ত ছিলাম। কারণ আমরা ছয় ভাইবোনের মধ্যে পাঁচজনই তখন কলকাতা ও শ্রীরামপুরে। আমার মেজোবোনের জন্য চিন্তা নাই। কারণ সে বেনিয়া পুকুরে আছে। সেখানে এক বোন বেড়াতে এসেছে। এক বোন শ্রীরামপুরে ছিল। একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের ম্যাট্রিকে পড়ে। একেবারে ছেলেমানুষ। একবার মেজো জনের বাড়ী,একবার ছোটবোনের বাড়ী এবং মাঝে মাঝে আমার কাছে বেড়িয়ে বেড়ায়। কারো কথা বেশী শোনেনা। খুবই দুষ্টু ছিল ছোটবেলায়। নিশ্চয়ই গড়ের মাঠে এসেছিল। আমার কাছে ফিরে আসে নাই। বেঁচে আছে কি না কে জানে। শ্রীরামপুরের অবস্থা খুবই খারাপ। যে পাড়ায় আমার বোন থাকে,সে পাড়ায় মাত্র দুইটি ফ্যামিলি মুসলমান।’ ( রহমান: ২০১২: ৬৬)। এখানেও বুঝা যায়,বঙ্গবন্ধু তাঁর ছোট ভাইকে কতটা ¯েœহ করতেন,ভালোবাসতেন। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগষ্ট সকালে থেকে কলকাতায় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। ইতিহাসে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ বা ‘কৃষ্ণ ষোল’ নামে পরিচিত। কলকাতায় সেদিন গড়ের মাঠে যে সমাবেশ হয়েছিল সেই সমাবেশের কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধ্।ু মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের কলকাতা বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে সবাই গড়ের মাঠে সমবেত হয়েছিল (লেনিন:২০২১:৬৭) ।
বঙ্গবন্ধু ২৬ জুলাই,১৯৬৬ সালে তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন,‘আমার ছোট ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা কেমন,সংসার কেমন চলছে। অর্থাভাবে কি না? (রহমানঃ ২০১৭:১৮১)। এসব প্রশ্ন ও তাড়িয়ে বেড়াত বড় ভাইকে। ১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ভাষা আন্দোলনে গ্রেফতার হন,তখনকার গোয়েন্দা নথিতে দেখা যায় শেখ আবু নাসের,বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই। যার পেশা ব্যবসা এবং সে দশম শ্রেণীর ছাত্র। ছোট বেলায় তিনি টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হন এবং এই রোগে তাঁর বাম পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে কেউ কেউ তাকে তৈমুর লং বলে ডাকতেন।
১৯৭৫ সালের ১৪ আগষ্ট ঢাকা থেকে যশোর হয়ে খুলনা যাবার কথা ছিল শেখ নাসেরের। কিন্তু পরদিন ১৫ আগষ্ট সকালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠান থাকায় বঙ্গবন্ধু খবর পাঠিয়ে তাকে ধানমন্ডি -৩২ নম্বরের বাড়ীতে ফেরত আসতে বলেন্ এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ফিরে আসেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস,১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ঘাতকদের গুলীতে সকলের সাথে তিনিও প্রাণ হারান। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাসার কাজের সহকারী আবব্দুর রহমান রমা বলেন,গোলাগুলির এক পর্যায়ে রমা বঙ্গমাতার বাথরুমে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি সুলতানা কামাল,শেখ জামাল,রোজী জামাল,বঙ্গমাতা এবং বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরকে দেখতে পান শেখ নাসের ঐ বাথরুমে আসার আগে তার হাতে গুলি লাগে এবং এবং তার হাত থেকে রক্ত ঝরছিলো। বেগম মুজিব তাঁর শাড়ির আঁচল ছিঁেড় শেখ নাসেরের গুলিবিদ্ধ জায়গাটিকে বেধেঁ দেন। এরপর আর্র্মিরা দরজা ধাক্কানোর এক পর্যায়ে দরজা খোলার পর শেখ নাসের,শেখ রাসেল ও রমাকে নিচতলায় নিয়ে যান। সেখানে শেখ নাসেরকে উদ্দেশ্য করে জানতে চায়,সে কে? তিনি শেখ নাসের বলে পরিচয় দিলে তাকে নিচতলার বাথরুমে নিয়ে যায়। একটু পরেই ঐ বাথরুমে গুলির শব্দ এবং ‘মাগো’ বলে আর্তচিৎকার শুনতে পায় (আব্দুর রহমানের সাক্ষাৎকার: ১৫.০৬.২০২৩)। এভাবেই শেষ হয় শেখ নাসেরের জীবন। রেখে যান অন্তসত্ত¦া স্ত্রী এবং সাত সন্তান। তাকে হারিয়ে স্ত্রী এবং সন্তানেরা মানবেতর জীবন যাপন করেন। প্রতি পদে পদে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হন। নানা শ^াপদসংকুল পথ পেরিয়ে সন্তানেরা বড় হন এবং নিজ আলোয় নিজেদের আলেকিত করেন এবং পিতার আদর্শে নিজেদের নিয়োজিত করছেন।
শেখ ওয়াহিদুজ্জামান আল ওয়াহিদ সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ’ গ্রন্থে শেখ নাসেরের জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ হেলাল উদ্দিন ‘বঙ্গবন্ধু ও আমার পিতা: একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন’ শিরোনামে ১৫৯-১৬২ পৃষ্ঠা জুড়ে লেখার এক পর্যায়ে লিখেন,‘আমার পিতা শেখ আবু নাসের শিপিং বিজনেস অর্থাৎ নৌ পরিবহন বাণিজ্য শুরু করেন। সপরিবারে খুলনাতে বসবাসের ফলে এখানেই আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে কয়েকজন জন্মগ্রহণ করেন। ’ অপর আর এক অনুচ্ছেদে লিখেন,‘আমার পিতা আমাকে যতখানি ¯েœহ-মমতা দিয়েছেন,আমার চাচা বঙ্গবন্ধু আমাকে খুব ¯েœহ করতেন, ভালোবাসতেন।’ এই এতটুকু তথ্য থেকে একজন সন্তানের পিতাকে নিয়ে স্মৃতির দুয়ারে ফিরে যাওয়া এবং পারিবারিক মেলবন্ধনের অসাধারণ উদাহরণ।
অপরদিকে,শেখ নাসেরের বোনের মেয়ে আব্দুর বর সেরনিয়াবাতের কন্যা হুরুন্নেসা মঞ্জুর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়,শেখ নাসের তাঁর বোনের মেয়েদের ভীষণ ভালোবাসতেন এবং বোনের মেয়েদের হাতের নানা রকমের রান্না খেতে পছন্দ করতেন এবং তিনি একজন ভীষণ মিশুক মানুষ ছিলেন।
মনীষী জলিন পেরি লিখেছিলেন,‘ ভাইয়েরা কখনোই এক অপরকে অন্ধকারে ফেলে রাখা যায়না’। এই কথাটি ভীষণ সত্যি যখন দেখা যায় । এই যে ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের যে দরদ তা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। একদিকে কারাগারেবসে বড় ভাই ছোট ভাইয়ের কথা স্মরণ করছেন,অন্যদিকে ছোট ভাই ,বড় ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে বড় ভাইয়ের সংসার দেখভাল করার চেষ্টা করতেন। সত্যি ভাই ভাইকে ফেলে যাননি। যেমন জীবিত অবস্থায় ভাইয়ের পরিবারকে দেখাশোনা করেছেন। তেমনি মরণের পাড়ে কেউ একা যাননি। দুই ভাই এক সাথেই মৃত্যুবরণ করেছেন।
‘নাসের’ নামের অর্থ হচ্ছে,ছায়াবৃত,সাহায্যকারী। শেখ নাসেরের জীবনের নানা ঘটনা,পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের মানসিকতা,মুক্তিযুদ্ধে দুর্বার অংশগ্রহণ এবং শেষ দিনে দুই ভাইয়ের একসাথে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া । সবকিছু যেন তাঁর নামের অর্থের প্রতিফলন। শেখ নাসের ছিলেন নরম মনের একজন সাধাসিধা মানুষ ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই এটা যেমন চিরসত্য। ঠিক তেমনি তাঁর ব্যক্তি পরিচয়,তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকার একজন গর্বিত অহংকারের অহংকারের অংশীদার তিনি। যাদের সংগ্রামে আজ বাংলাদেশ বিশে^র বুকে মাথা তুলে দাড়িঁয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ নাসেরের প্রতি রইল আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৮ বছর ৫ মাস ১৫ দিনের ছোট ভাই শেখ আবু নাসের চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন রাজধানী ঢাকার বনানী কবরস্থানে। দিন আসে দিন যায়,কিন্ত দুই ভাই ফিরে আসেননা। তাঁরা রাতের আকাশে তারা হয়ে জ¦লেন। ১৫ আগষ্ট,১৯৭৫ এর শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসেরের রনাঙ্গনে সাহসী ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় চির অক্ষয় হয়ে থাকবে। তবে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা। সত্য কখনো চাপা থাকেনা। ইতিহাস এগিয়ে যায় তার নিজস্ব গতিতে। তাইতো দেরীতে হলেও বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবার হত্যার মামলার বিচার হয়েছে। ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মহান ভূমিকা প্রতিভাত হয়েছে।
তাইতো কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর ‘কাজীর বিচার’ শিরোনামের কবিতায় লিখেন,‘বঙ্গবন্ধু হত্যা – মামলার রায় ঘোষণার পূর্ব রাতে। ৭.১১.৯৮। রাত ও ঘটিকা/ মাননীয় জেলা ও দায়রা জজ’/কাজী গোলাম রসুল যখন/ জেগে আছে তখন/ যতো ক্লান্তিই আসুক না কেনো/রায় ঘোষণার পাক মুহুর্তে’ ’/ আমি কি ঘুমাতে পারি?/বঙ্গবন্ধু হত্যা - মামলার রায় ঘোষণার পর/৮-১১.৯৮। দুপুর তিন ঘটিকা’ জয় বাংলা / জয় বঙ্গবন্ধু/ জয় কাজী গোলাম রসুল’।

তথ্যপঞ্জী
১. শেখ মুজিবুর রহমান,অসমাপ্ত আত্মজীবনী,২০১২,ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড,ঢাকা।
২. শেখ মুজিবুর রহমান,কারাগারের রোজনামচা,২০১৭, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড,ঢাকা।
৩. নাছিমা বেগম, রেণু থেকে বঙ্গমাতা, ,২০২১,বাংলা একাডেমি,ঢাকা।
৪. নূহ- -উল = আলম লেনিন, রাজনীতিতে হাতেখড়ি ও কলকাতায় শেখ মুজিব,,২০২১,বাংলা একাডেমি,ঢাকা।
৫. নির্মলেন্দু গুণ,মুক্তিযুদ্ধের কবিতা,২০১১,সন্ধানী প্রকাশনী,ঢাকা।
৬. শেখ ওয়াহিদুজ্জামান আল ওয়াহিদ (সম্পাদিত),বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ,২০১৫,বঙ্গবন্ধু গবেষণা ফাউন্ডেশন,ঢাকা।
৭. এম. আব্দুল হাকিম আহমেদ,‘১৫ আগষ্ট নিরন্তর রক্তক্ষরণের আর একটি নাম’,২৩.০৮.২০২১,উত্তরাধিকার৭১ নিউজ।
৮. মোঃ নজরুল ইসলাম,‘ইতিহাস থেকে বিস্মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের এর সংগ্রামী জীবনগাথাঁ’,মেহেরপুর প্রতিদিন ,১৫.০৮.২০২২।
৯. মোঃ নজরুল ইসলাম,‘শহীদ শেখ আবু নাসের,কতটুকু জানি তাকে?’,০২.০৯.২০২১,খুলনা টাইমস।
১০. আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বড় কন্যা হুরুন্নেসা মঞ্জুর সাক্ষাৎকার,১৪.০৬.২০২৩।
১১. বঙ্গবন্ধুর বাসার সহকারী আব্দুর রহমানের সাক্ষাৎকার,১৫.০৬.২০২৩।
১২. বঙ্গবন্ধুর চিঠিই তার একমাত্র সম্বল,শেষ ইচ্ছা শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ,২৭.০৯.২০২০, দৈনিক সমকাল।
১৩. জীবন সংগ্রামে সফল এক সাহসী নারী বেগম রাজিয়া নাসের,১৬.১১.২০২১, খোলামত,চ্যানেল খুলনা।
১৪. ১৫ আগষ্টে প্রাণে বেঁচে যাওয়া রাজিয়া নাসেরের সংগ্রামী জীবন,১৭.১১.২০২০,বাংলানিউজ,২৪ডট কম।
১৫. সচিত্র সাক্ষাৎকার,শেখ আবু নাসের,বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়েবসাইট,১৩.০৩.২০২২।

অধ্যাপক ড. জেবউননেছা

অধ্যাপক ড. জেবউননেছা

লোকপ্রশাসন বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ০:৪৮:২৭ ● ৫৮৪ বার পঠিত