রবিবার ● ১৮ জুন ২০২৩
সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৬৭:-স্বপন চক্রবর্তী
Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৬৭:-স্বপন চক্রবর্তীআবারও দইখাওয়া সীমান্তের কথায় ফিরে আসি। ঢাকা হতে হাতীবান্ধা বাস থেকে নেমে দইখাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। যাবার সময় হাতীবান্ধা থেকে গোতামারী গ্রামের রাস্তা খোঁজে পেতে আমার জন্য সহজ হয়নি। মাঝখানে প্রায় পাঁচ দশকেরও বেশী সময় কালের স্রোতে ভেসে গেছে। পরিচিত রাস্তাও হয়ে গেছে অপরিচিত। বদলে গেছে পরিবেশ। খরের ঘরের পরিবর্তে হয়েছে টিনের ঘর। আর টিনের ঘরের স্থলে অনেক দালান কোঠা নির্মিত হয়েছে। রাস্তাঘাট অনেক উন্নত হয়েছে। ফলে সব যেন নতুন লাগছে। তার চেয়েও কঠিন ছিল অতি পরিচিত ব্যক্তিদেরকে চেনার জন্য পরীক্ষা দেওয়া। দইখাওয়া হাটে বসে আছি মোঃ আব্বাস আলী মিয়ার দোকানে। ঔষধের দোকান। সেই তখনকার দোকানটি আজও আছে। মালিক এখন বয়োজ্যেষ্ঠ ও গণ্যমান্য ব্যাক্তি, বাজার কমিটির নেতৃ স্থানীয়দের অন্যতম।। অতি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন আমার। ইতিমধ্যে তিনি আমার বিয়াইও হয়ে গেছেন। অর্থাৎ আনছার আলী মিয়ার ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তাঁকে প্রথমে চিনতে পারিনি- যেন কেহ কারে চিনিতে নাহি পারে, চিনাতে নারে,দুজনায়। আমার মিত্র পরীক্ষা নিতে শুরু করেন। এক এক জনের সাথে নিয়ে গিয়ে সাক্ষাৎ করিয়ে পরিচয় বলতে বললে উভয়েই উভয়ের পরিচয় বলতে অপারগ হই। আমাকেও চিনেনি আমিও না। এটাই সবার একটা আনন্দ বর্দ্ধনের অনুসঙ্গ হয়ে ছিলো। আব্বাস মিয়া বয়োবৃদ্ধ মানুষ। মাথায় ভাঁজ করে পড়ে আছে মাঙ্কি ক্যাপ। শ্বেতশুভ্র দাড়ি। শীতের কারণে এমন ভাবে উলেন টুপি মাথায় পড়ে আছেন যে মনে হলো শিশুদেরকে আনন্দ দিতে শান্তাক্লজ এসেছে। অবশ্য এমন সব পোশাক খোলার পরও চেনা যায়নি। কারন দীর্ঘ পাঁচ দশকের বিরতি। কেহই আমাকে চিনে না,আমিও না। বুঝতে পেরেছি, আমিও তাদেরই দলে । আমিও পরিবর্তিত হয়ে গেছি, বুড়ো হয়ে গেছি। দিন চলে যায় নদীর স্রোতের মতো। গন্তব্যের দিকে ধাবমান। অথচ দীর্ঘ বিরতি না হলে সবাই সবাকে একই রকম অবয়বে দেখতে থাকতাম। ব্যক্তি যদি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নিজের একটি করে ছবি তুলে জমা করে রাখে এবং সেগুলো কোন এক সময়ে সেল্যুলয়েডের ফিতার মতো দ্রুত চালিয়ে দেয়, তখন দেখা যাবে, কিভাবে বার্দ্ধক্যের দিকে ধাবমান হচ্ছে। জানিনা ডারউইনের বিবর্তন তত্বটা এমনই ভাবে লক্ষ কোটি বছরের ক্রম পরিবর্তনে ফসল কিনা।
যাক সে কথা। অবশেষে নাম বলে দেওয়াতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছি। চিনেছি আব্বাস মিয়াকে, চিনেছি বন্ধু আকরাম হোসেনকে, চিনেছি মজিদুর ভাইকে। লক্ষ করেছি, সমসাময়িক বন্ধুরা সব হয়েছে বৃদ্ধ আর ছোটরা হয়েছে সমাজের মাথা। কেহ হয়েছে মেম্বার কেহবা চেয়ারম্যান, কেহ শিক্ষক আর কেহ বা বিসনেস ম্যান। পুরাতন বন্ধুদের পরিচয় পেয়ে সে কি আবেগ অনুভূত হলো। তবে কষ্ট পেয়েছি বহু সমসাময়িক বন্ধুকে হারিয়ে । তাদের চলে যাওয়ার তালিকাও বেশ দীর্ঘ। আনন্দের সাথে সাথে মন খুব ভারীও হয়ে উঠলো। ভাবতে লাগলাম হয়তো আমারও কোন এক সময় এই সংসারের মায়া ত্যাগ করতে হবে, আমিও হবো অতীত, এবং সেটাও হতে পারে নিকট দুরত্বেই। তবে এখনো বেঁচে আছি বলে নিজেকে অপেক্ষাকৃত ভাগ্যবানও মনে হলো। কাবুলীওয়ালা গল্পে বিয়ের দিন বিয়ের সাজে মিনিকে দেখে রহমত কাবুলিওয়ালা বুঝতে পেরেছিল যে তার মেয়েও বড় হয়ে গেছে, তাকেও বিয়ে দিতে হবে। বুকের পকেট থেকে তার মেয়ের হাতের ছাপ দেওয়া একটা ময়লা কাগজ বের করে অশ্রুসিক্ত হয়ে গিয়েছিল। আর আমারও মনে হতে লাগলো যে, আমিও বৃদ্ধ হয়ে গেছি। চলে যাওয়া ব্যাক্তিদের ছবি মনে ভেসে উঠলো, তবে নিশ্চয়ই পঞ্চাশ বছর আগের। আর মনের মধ্যে লালিত বেঁচে থাকা পরিচিত প্রিয়জনদের দীর্ঘ দিনের ছবি গুলো প্রতিস্থাপিত হয়ে গেলো নিমিষেই । যুবকগণ হলো বৃদ্ধ আর শিশু-কিশোরগণ হলো যুবক।
( চলবে )
বাংলাদেশ সময়: ২১:১৮:০৮ ● ৬৪৮ বার পঠিত