শুক্রবার ● ১৬ জুন ২০২৩

সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৬৬; স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৬৬; স্বপন চক্রবর্তী
শুক্রবার ● ১৬ জুন ২০২৩


সংগৃহীত ছবি-দুজন শিল্পী গম্ভীরা গান পরিবেশন করছেন
বাংলাদেশের গম্ভীরা গানঃ
বাংলাদেশে পূর্বে গম্ভীরা গানের আসরে শিবের অস্তিত্ব কল্পনা করা হতো। বর্তমানে বাংলাদেশের গম্ভীরা গানের আসরে শিবের পরিবর্তে নানা-নাতীর ভূমিকায় দুইজন অভিনয় করে থাকেন। আগেই বলেছি নানার মুখে পাকা দাড়ি , মাথায় মাথাল, পরনে লুঙ্গি হাতে থাকে লাঠি। আর নাতীর পোশাক ছেঁড়া গেঞ্জি , কোমরে গামছা মাথায় মাথাল ইত্যাদি। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের গ্রামের ছবি। নানা-নাতীর সংলাপ ও গানের মধ্য দিয়ে দ্বৈতভাবে গম্ভীরা গান পরিবেশিত হয়। সাথে থাকে দোহার দল। এক সময় গম্ভীরা গান একতাল , দাদারা খেমটা কাহারবা, প্রভৃতি তালে গাওয়া হতো। বর্তমানে সুরের পরিবর্তন ঘটেছে এবং তাতে হিন্দী ও বাংলা ছায়াছবির গানের সুরেরও প্রাধান্য পাচ্ছে। এ ছাড়া লোকনাট্যের বহু বিষয় , চরিত্র, ও সংলাপ গম্ভীরা গানে সংযুক্ত হয়েছে। চাঁপাই নবাবগঞ্জের কুতুবুল আলম,রকিব উদ্দিন, বীরেন ঘোষ, মাহবুবুল আলম প্রমূখ গম্ভীরা গানের বিশিষ্ট শিল্পী। তাঁরা নতুন ধরনের সুর সৃষ্টি করে গম্ভীরা গানকে সারা বাংলাদেশে জনপ্রিয় করে তুলেন। উল্লেখ্য যে, পশ্চিম বঙ্গের মালদহ জেলার ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জের ভাষার অনেকটা মিল রয়েছে।
পুরাতন ঢাকায় ছিলাম আশির দশকে। একটি মেসে ছিলাম। অগ্রণী ব্যাংকের এক কলিগ বিশেষ ভাবে ধরে বসে একটি নির্বাচনের গান লিখে দিতে হবে। ব্যাংকের অফিসার সমিতির সাধারণ সম্পাদক জনাব মির্জা ওয়াকিল উদ্দিনের ছোট ভাই, শামছুদ্দিন আহমেদ, এই কলিগ আমার পাশের টেবিলে বসতো। নদীর ওপারে তাদের জিনজিরার চুনকুটিয়া ইউনিয়নে নির্বাচন হবে। একটি গানের প্যারোডি করে রেকর্ড করে দিতে বায়না ধরলো। গানটির আদলে প্যারোডি করে ছিলাম “ ডাক দিয়াছেন সালাহ উদ্দিন ভাই- ছাতা নিয়া দাঁড়ায়ে আছেন চিন্তার কারন নাই”। একটি ফিতার ক্যাসেটে মাত্র একটি গান দিলে কেমন হবে ? টেপ রেকর্ডারে গানটি রেকর্ড করিয়ে ছিলাম বিখ্যাত নজরুল সংগীত শিল্পী মইদুল ইসলামকে দিয়ে। সংলাপ গুলোও দুজনেই করেছিলাম। এই টেপ রেকর্ডারের সাথে লাউড স্পীকার যুক্ত করে রিক্সা দিয়ে প্রচার করা হয়েছিল। মইদুল ইসলাম তখন আমার সাথে এ্কই রুমে থাকতেন। পরে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আর একটি গান রচনা করলাম। সেটি ছিল গম্ভীরা। গানের কথাগুলো আজ আর মনে নেই । গানের স্থায়ীটি ছিল “ আবার আইলো ভোটের জোয়ার দেশ জুইড়া, দেখ সালাউদ্দিন আছেন ছাতা ধইরা।” এই গম্ভীরার বিশেষত্ব ছিল সংলাপ গুলোতে। ভোটারদের কথা চিন্তা করে ঢাকাইয়া ভাষায় সংলাপ দিয়ে ছিলাম। সংলাপ ছিল অনেকটা এমন- ”নানা:-আবে কাউলা, ভোট কেমতে দিবি ? নাতী- ছিলটা লইয়া ধিম ধিম কইরা প্রত্যেক মার্কায় একটা কইরা ছাপ মাইরা দিয়া আয়া পড়ুমু।
নানা- আরে ব্যাক্কল কোহানকার। ছবটির মধ্যে ছিল (সীল ) মারলে তো ভোট কেনচেল হইয়া যাইবো। ছবটিতে মারবি কেলা ?
নাতী- ছবতে (সবাই তো ) ভোট দিবার কইচে। তয় দিমু না কেলা ?
নানা- আবে হালায় ব্যাক্কল কুহানকার। ভোট তো ছবতে চাইবোই। তয় শুধু মাত্র ছাতায় ছাপ্পর মাইরা দিয়া আইবি। নইলে ছব ভোট বাতিল অইয়া যাইবোগা।
এই ধরনের সংলাপ এবং এই সংলাপের মাধ্যমে কৌশলে বিরুধী প্রার্থিীর কঠোর সমালোচনা আর সালাউদ্দিনের প্রশংসা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, “ এইবার আর পুরানের মধ্যে আমরা নাই।
নানা- কেলা ? নাই কেলা ?
নাতী- আরে নানা , একটা সাট্টিফিট আনবার গেচি, তো আমার কাছ থাইক্যা দশটি টেকা নিলো।
কস কি? এইটা তো জুলুম। না না তারে আর ভোট দেওয়া যাইবো না। এইবার খাটি একটা পোলা খাড়া হইছে। আমাগো সালাউদ্দিন। তারে ভোট দিমু।
এমন সব সংলাপের পাল্টা জবাব দিবার কোন কৌশল প্রতিপক্ষের ছিল না। গম, রেশন, চালচুরি, রাস্তাঘাট নির্মাণ সব কিছু নিয়েই আক্রমণ ছিল গানের মধ্যে দিয়ে। এই কৌশলের বিপরীতে পুরাতন চেয়ারম্যানের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন পথ খোলা ছিল না। ফলে সালাউদ্দিন বিপুল ভোটে পাস করে। পরবর্তীতে বিপদ হলো যে, একই ভাবে প্রর্থীদের জন্য আরো তিনটা ক্যাসেট তৈরী করে দিতে হয়েছিল এবং সবাই পাস করেছিলেন। তন্মধ্যে শরীয়তপুরেরও একটি ছিল। এই ক্যাসেট করা আমার তখন কোন অনুকরণ ছিল না। এটা ছিল আমার উদ্ভাবন। যতদুর মনে পড়ে সত্তরের দশকে কেবলমাত্র ক্যাসেট প্লেয়ার বাজারে আসে। তাই এমন করে নির্বাচনী গান তৈরী করে নির্বাচনী প্রচারনা আর শোনা যায়নি। মনে হয় আমিই প্রথম পথ প্রদর্শক। অনেক পরে অবশ্য আরো এমন নির্বাচনী গান শোনা গেছে। ( চলবে )

বাংলাদেশ সময়: ২১:৫৭:৪৩ ● ৭৪৪ বার পঠিত