বুধবার ● ১৪ জুন ২০২৩

সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৬৫; স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৬৫; স্বপন চক্রবর্তী
বুধবার ● ১৪ জুন ২০২৩


সংগৃহীত ছবি-গম্ভীরা পরিবেশন করছেন দুজন শিল্পী।
গম্ভীরা-২, প্রকারভেদঃ-
গম্ভীরা গান সাধারণত দু’প্রকার। আদ্যের গম্ভীরা এবং পালা গম্ভীরা। প্রথমত দেব-দেবীকে সম্বোধন করে মানুষ তার সুখ-দুঃখ পরিবেশন করলে তাকে আদ্যের গম্ভীরা বলে। দ্বিতীয়ত, পালা গম্ভীরায় নানা-নাতীর ভূমিকায় দু’জন ব্যক্তির অভিনয়ের মাধ্যমে এক একটা সমস্যা তুলে ধরা হয়।
নামকরণ:
পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, সনাতন ধর্মাবলীদের অন্যতম দেবতা শিব। শিবের অপর নাম “গম্ভীর”। শিবের উৎসবে শিবের বন্ধনা করে যে গান গাওয়া হতো সেই গানের নামই কালক্রমে হয়ে যায় গম্ভীরা। পরবর্তী সময়ে গম্ভীরা গানের ধরন অনেকাংশে বদলে গেছে। গানের সুরে দেব-দেবীকে সম্বোধন করে বলা হয় গ্রামীন দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষের সুখ-দুঃখ কাহিনী। কখনো সারা বছরের প্রধান ঘটনা এ গানের মাধ্যমে আলোচিত হয়। পালা গম্ভীরায় অভিনয়ের মাধ্যমে এক একটা সমস্যা তুলে ধরা হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে বছরের সালতামামি উপলক্ষে পালা গম্ভীরা পরিবেশন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের “গম্ভীরা” বলতে একটি অঞ্চলের তথা চাঁপাই নবাবগঞ্জের লোক সঙ্গীতকে বোঝায়।
গম্ভীরা মুখোশঃ-
আগে উল্লেখ করেছি যে, গম্ভীরা গানের উৎপত্তি পশ্চিম বঙ্গের মালদহ জেলায় হিন্দু সমাজে। গম্ভীরা নৃত্যটি উত্তরবঙ্গের অর্থাৎ মালদাহ জেলা জুড়ে চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব উপলক্ষে প্রদর্শিত হয়। মালদহের গম্ভীরার বিশেষত্ব হলো মুখোশের ব্যবহার। স্থানীয় সূত্রধর সম্প্রদায় নিম এবং ডুমুরের গাছের অংশ বিশেষ দিয়ে মুখোশ গুলো তৈরী করে। কখনো কখনো মাটি দিয়েও মুখোশ তৈরী করা হয়। গম্ভীরা গানের তালে তালে এই মুখোশ পড়েই নৃত্য করা হয়। গম্ভীরা নৃত্যের মুখোশ হিসাবে বিভিন্ন ধরনের মুখোশ প্রয়োজন হয়। হিন্দু পৌরাণিক চরিত্রের বাণ, কালী, নরসিংহী, বাশূলী, গৃধিনী ,বিশাল, চামুন্ডা উগ্রচন্ডা, ঝাঁটকালী, মহিষমর্দিনী, লক্ষী-সরস্বতী, হিরণ্যকশিপু বধ, তাড়কাবধ, শুম্ভ-নিশুম্ভ বধ, ইত্যাদির মুখোশ ব্যবহৃত হয়। এই মুখোশের মধ্যে সব চেয়ে আকর্ষণীয় হয় নরসিংহী মুখোশ।
পরিবেশনাঃ
পশ্চিম বঙ্গের মালদহ জেলাতে গম্ভীরা গান বা লোকনাট্য পরিবেশন কৌশল একাধিক ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগ বন্ধনা। এই অংশে মঞ্চে শিব আসেন এবং শিবকে উদ্দেশ্য করে নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে দুটি চরিত্র। শিব সমস্যা গুলির প্রতিকারের উপায় বলে দিয়ে প্রস্থান করেন। পরের ভাগে আসে দ্বৈতচরিত্র। পুরুষ ও মহিলা দুটি চরিত্র সংলাপ ও গানের মধ্যদিয়ে সমাজ জীবন , রাজনীতি, থেকে শুরু করে ঘটনা বহুল নানা সমস্যা তুলে ধরেন। পরে চার ইয়ারী হিসাবে চারজন অভিনেতা মঞ্চে আসেন। এরমেধ্যে একজন স্পষ্টভাষী থাকেন। সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে তিনি স্পষ্ট বক্তব্য গান ও কথার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। এই চার ইয়ারীর বাক্যালাপের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যার সমাধান বেড়িয়ে আসে। পরের পর্বটি থাকে ব্যঙ্গাত্মক। একটি চরিত্র ব্যঙ্গের মাধ্যমে জরুরী কিছু কথা বলে। আর শেষ ভাগে থাকে সালতামামী বা রিপোর্টিং । সারা বছরের নানা ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণই হলো সালতামামী। সর্বশেষ এর সমাধান বের করা হয়।
এই গম্ভীরা গান বা লোকনাট্য বিশেষ ভূমিকা বহন করে তাল-বাদ্য। এ গানে হারমোনিয়াম, তবলা, করতাল , প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয়ে থাকে।
যে সমস্ত প্রথিতযশা শিল্পীদের হাত ধরে গম্ভীরা মালদহ জেলাতে স্বমহিমায় বিরাজমান তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলি হলো কৃষ্ণধন দাস গোস্বামী, মহম্মদ সুফি , গোপাল চন্দ্র দাস , সতীশ চন্দ্র গুপ্ত, কিশোরী কান্ত চৌধুরী প্রমূখ। গম্ভীরা গানকে বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে যান যোগেন্দ্র নাথ চৌধুরী। তিনি গম্ভীরা সম্রাট নামে খ্যাত ছিলেন।
( চলবে )

বাংলাদেশ সময়: ২০:১৩:৩৯ ● ৬৪০ বার পঠিত