রবিবার ● ১১ জুন ২০২৩
আগামী প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত অনুভূতি -অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগম
Home Page » সাহিত্য » আগামী প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত অনুভূতি -অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমআগামী প্রজন্ম যখন জানবে,শুনবে,বুঝবে বাঙালি কোন যুদ্ধাস্ত্র ছাড়াই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলো। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলবে — এওকি সম্ভব? বিস্ময়ে চোখ তাদের কপালে ওঠে যাবে।
বাঙালির বুকে আকা ছিলো মুক্তিযুদ্ধ কালিন সময়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম শোষণ মুক্ত বাংলাদেশ জন্ম দেয়ার স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের দিক নির্দেশনা ও ২৬ মার্ঢের স্বাধীনতার ঘোষনার মূলমন্ত্র। মাত্র নয় মাস রক্তাক্ত যুদ্ধ করে,এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, ত্রিশ লক্ষ শহিদের আত্ম ত্যাগে,আড়াই লক্ষ মা বোনের শম্ভ্রম হারিয়ে বাঙালি পায় লাল সবুজের পতাকার ছায়াতলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামক জন্মভুমির ঠিকানা। একটা জাতির জন্য এর চেয়ে বড় অর্জন, গর্ব, অহংকার আর কি হতে পারে।
বৃটিশরা ব্যঙ্গ করে বলতো বাঙালিরা ভেতো,ভয়ার্ত,যুদ্ধ করতে জানে না।জনগণের নেতা বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে জেগে উঠার দীক্ষা দিয়ে, বৃটিশদের দুই শত বছরের ধ্যান, ধারনা, কূট ষঢ়যন্ত্র ভেঙ্গে চুরে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করে। বাঙালি যে ভয়হীন, বীরের জাতি তা মুক্তিযুদ্ধের লড়াই বিপ্লবের মাধ্যমে প্রমান করে।
বৃট্রিশ এর হাত বদল হয়ে ১৯৪৭সাল থেকে পাকিস্তানি শোষক চক্র বাঙালির উপর নতুন কায়দায় নীপিড়ন চালাইতে থাকে। চিরকাল বাঙালি শাসিত শোষিত হইতে থাকবে,আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবে না,দু বেলা দু মুঠো ভাত আর মোটা কাপড়ের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, তা হতে পারে না।বঙ্গবন্ধু বজ্রকন্ঠি হুংকার দিয়ে বাঙালিকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ বলয় তৈরী করে । অনেক লড়াই,সংগ্রাম,বিপ্লবের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ১৯৭০ এর নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে।অতপর দেশ পরিচালনা করার কথা ছিলো বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে। কিন্তু পাকিস্তানি কুচক্রী মহল তা হতে দেয়নি।
বরং ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ কালো রাতে অপারেশান সার্চ লাইট নামে পাকিস্তানি বর্বর সেনারা নিরস্ত্র নিরাপরাধ ঘুমন্ত বাঙালির উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়।ঢাকার রাস্তা ঘাট তলিয়ে যায় বাঙালির লাশ ও রক্ত বন্যায়। সেই নিষ্ঠুর মহুর্তে ২৫ শে মার্চ রাত বারটা ২০মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বলেন - আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।
বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহবান রাখেন –তোমরা যে যেখানে আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে পাকিস্তানি দখলদার সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বলয় তৈরী করতে। চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেন। এই ঘোষনার পর পাকিস্তানি সেনারা নির্দয়,নিষ্ঠুর ভাবে বেপরোয়া আক্রমন চালায় বাঙালি জনগণের উপর। মুলত মুক্তিযুদ্ধ তখন থেকেই শুরু হয়। সেই রাতেই ১.৩০ মিনিটে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডি বত্রিশ নাম্বার বাসা থেকে গ্রেফতার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে উচ্চারিত অমরবণী - এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। মহৌষধ হিসেবে এই মর্মবাণী হৃদয়ে ভরে কামার,কুমার,কৃষক,শ্রমজীবি নিম্নআয়ের জনগণ সহ স্বাধীনতাকামী জনগণ গেরিলা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই যুদ্ধের শেষ পরিনাম কি হবে, তা তারা জানতো না। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আকুতোভয় বাঙালি যুদ্ধ করতে থাকে। বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ হারাতে থাকে পাখির মতো লাখে লাখে। এদিকে বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন, নাকি নিহত হয়েছেন সে তথ্যও বাঙালির হাতে ছিলো না। বলা চলে মরণমুখী একটা ধোঁয়াশার ধুম্র জালের ভেতরে দাঁড়িয়ে, সেই ক্রান্তিকালেও বাঙালি ছিলো মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সিদ্ধান্তে অবিচল অটল।
খালে বিলে নদী নালা পদ্মা মেঘনার জলে স্তলে ভাসমান মানুষের লাশের ছড়াছড়ি, শকুন, শিয়াল, কুকুরে লাশের মাংস ভক্ষণের দৃশ্যাবলি এখনো স্থির চিত্র ও ভিডিও গ্রাফের দৃশ্যে ভেসে বেড়ায়। গা শিউরে ওঠে ক্ষত বিক্ষত সেই সময়ের মানব দেহের খন্ডাংশের চিত্র দেখে। ইতিহাস বিকৃতির কারণে অনেক তথ্য ভুল ব্যাখ্যায় আক্রান্ত হয়েছে। সে কারণে স্বাধীনতার একান্ন বছর পেরিয়ে গেলেও কারো কাছে মনে হতে পারে সেই সব ঘটনা অবিশ্বাস্য,অসম্ভব। কিন্তু না, গানে গল্পে নাটকে, বিচিত্র আখ্যানে,নির্মম মানচিত্রে, ইতিহাসের পাতায়,জার্নালে,সিনেমায়, দেশী বিদেশী গ্রন্থনার ভাঁজে ভাঁজে মুক্তিযুদ্ধের সত্য তথ্য চির স্মরনীয় ও সাক্ষী হয়ে আছে। যা স্বীকৃতি পেয়েছে দেশ পেরিয়ে পৃথিবীর সর্ব অঙ্গনে।
আদিকাল থেকে যুগে যুগেই মানুষ চেষ্টা করেছে আগামী প্রজন্মের জন্য বেটার পৃথিবী রেখে যেতে।বাঙালিরাও সে ধারাবাহিকথায় মুক্তিযুদ্ধ করে সুস্থ্যধারার প্রগতিশীল অসম্প্রদায়িক চেতানার বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে আগামী প্রজন্মের জন্য। তবে মা নামক বাংলাদেশের জন্ম দাগের পেছনে রয়েছে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষাময়,বেদনার শ্বাসরোদ্ধকর ঘটনার ক্ষত ও অবতারনা। যা পশুত্বের কাছেও হার মানায়।।
একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বর হায়েনারা শুধু মানুষ হত্যা, নির্যাতন, লুটপাট,বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কান্ত হয়নি,বাংলার নারী সমাজের উপর করে নির্মম পাশবিক অত্যাচার।দেশীয় দোসর রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় পাকিস্তানি সৈন্যরা বাড়ি ঘর থেকে টেনে হিচরে নারীদের ধরে যুদ্ধক্যাম্পে নিয়ে যায়।বিবস্র করে মায়ের সামনে মেয়েকে, মেয়ের সামনে মাকে,শ্বাশড়ির সামনে বউকে করে যৌন নির্যাতন। বাংলার আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে তাদের আহাজারিতে।এই ধর্ষিতা নারীরা দুঃখে অপমানে কেউ কেউ আত্মহত্যা করে, কেউবা হারিয়ে ফেলে মানসিক ভারসাম্য। কেউবা জন্ম দেয় যুদ্ধ শিশুর। এই ব্যথাতুর দুঃখ ব্যথার দায় বহন করেই বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে সন্মুখ পানে, গড়ে তুলছে গ্লোবাল জগতে আগামী প্রজন্মের জন্য আরো সুন্দর অত্যাধুনিক আইটি বিপ্লবের নতুন পৃথিবীর আঙ্গিনা।
এই প্রবন্ধটি প্রজন্মান্তরে মনে করিয়ে দিবে একাত্তর বাঙালির জীবনে কি ভয়ঙ্কর অভিঘাতের ক্ষত সৃষ্টি করেছিলো। অশ্রুসজল হয়ে উঠবে বিজয় উল্লাসের পাশাপাশি দুঃখ যাতনার একাত্তরের জঠর নিসৃত রক্তাক্ত অনুভূতি। এই হউক আগামী প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত অনুভুতি।
লেখকঃ উপদেষ্ঠা,বাংলাদেশ কৃষকলীগ।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:৪৮:৪৯ ● ৬৩২ বার পঠিত