শুক্রবার ● ৯ জুন ২০২৩

বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও ব্যক্তি জীবেন সাহিত্যের অনুরণন -অধ্যক্ষ ড.গোলসান আরা বেগম

Home Page » সাহিত্য » বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও ব্যক্তি জীবেন সাহিত্যের অনুরণন -অধ্যক্ষ ড.গোলসান আরা বেগম
শুক্রবার ● ৯ জুন ২০২৩


   ফাইল ছবি ভাবনা

একই অঙ্গে এতো রুপ ও রুপের প্রতিফলন– এই কথাটি বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। টুঙ্গিপাড়ার অজ পাড়া গাঁ থেকে ওঠে আসা তিনি কি ভাবে হলেন স্বর্ণাক্ষরে লেখা অমর কাব্যের মহানায়ক,তা সত্যি অকল্পনীয়। কপালে রাজটিকা নিয়ে জন্ম নেয়া খোকা নামের ছেলে কৌশরে পা দিয়ে হয়ে গেলো আদরের মিয়া ভাই।দুষ্ট প্রকৃতির, এক গুয়ে স্বভাবের, ডানপিঠে এক রোখা ছেলেটি ছিলো অতিশয় মানাবিক।তাই মুসলিম সেবা সমিতি গঠন করে বন্ধুদের নিয়ে বাড়ী বাড়ি ঘুরে মুষ্টি ভিক্ষার চাল সংগ্রহ করতেন।অতঃপর তা বিক্রি করে দরিদ্র অসহায় মুসলিস ছাত্রদের পড়ালেখার খরচ দিতেন।

সমাজ বির্নিমানের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় একজন দক্ষ নেতা হওয়ার জন্য যতগুলো গুনাবলি থাকা দরকার, বঙ্গবন্ধুর তার চেয়ে অনেক বেশী ছিলো। জ্ঞান অর্জনের জন্য নিয়মিত প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার পাঠক ছিলেন।তিনি যত বার কারাগারে বন্দি জীবন যাপন করতে যেতেন, অবসরে পড়ার জন্য একগাদা বই নিয়ে যেতেন। তার প্রমান পাওয়া যায় ” শেখ মুজিব আমার পিতা” বইয়ে। সেই বইয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন — ১৯৪৯ সাল থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন, কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিলো, যা সব সময় আব্বা সঙ্গে রাখতেন।জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসার সময় বেশীর ভাগ বই জেল খানার লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন, কিন্তু আমার মা’র অনুরোধে নিম্নের এই বই কয়টা আব্বা কখনো দিতেন না।সঙ্গে নিয়ে আসতেন।

তার মধ্যে রবীন্দ্র রচনাবলী,শরৎচন্দ্র রচনাবলী,নজরুলের রচনা,বার্নার্ড শ’র কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেয়া ছিলো।বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি জীবনের ইতিহাস থেকে জানতে পেরেছি– শত কাজের চাপে ব্যস্ত থাকা সত্ব্যেও এতটুকু সময় পেলেই সন্তানদের নিয়ে কাব্য আলোচনা করতেন।আবৃত্তি শোনাতেন পরিবারের সদস্যদের। প্রসঙ্গক্রমে বঙ্গমাতা উল্লেখ করে বলেছেন — কোন কারণে আমার মন খারাপ হলে, বঙ্গবন্ধু আমাকে কবিগুরুর কবিতা শোনাবার প্রতিশ্রুতি দিতেন। স্ত্রীর মান অভিমান ভাঙ্গনোর জন্য কবিতা আবৃত্তি করতেন– এমন সাহিত্য প্রেমি নেতা, বাঙালি কোথায় খোঁজে পাবে। বিপদের দিনগুলিতে গুন গুনিয়ে গাইতেন — ” বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা “। এই সেই লক্ষ গুণে গুনান্নিত নেতা আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তিনি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন না, তারপরও সাহিত্য প্রেম ছিলো তাঁর উন্নত ও বিভিন্ন মাত্রিকতায়। তিনি নিজেই বলেছেন -” আমি সাহিত্যিক নই,শিল্পি নই,কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে,জনগণই সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎস।জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনোদিন কোন মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না “। তার দর্শন ও অভিমত ছিলো ” সাহিত্য শিল্পে ফুটিয়ে তুলতে হবে এদেশের দুঃখী মানুষের আনন্দ বেদনার কথা।সাহিত্য শিল্পকে কাজে লাগাতে হবে তাঁদের কল্যাণে”।

১৯৬৯ সালে পাকিস্তানী সরকার যখন রবীন্দ্র সঙ্গীতের উপর নিষেধাঙ্গা জারি করে, তখন সহোরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু এক জনসভায় বলেছিলেন “আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপিয়ার, এরিস্টটল,লেলিন, দান্তে,মাও সেতুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য।আর দেউলিয়া পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখা পাঠ। যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখে নভেল বিজয়ী বিশ্ব কবি হয়েছেন।তিনি আরো বলতেন –আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই,আমরা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইবই,এবং রবীন্দ্র সঙ্গীত এই দেশে গীত হবেই”। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা ” আমার সোনার বাংলা” এর প্রথম দশ লাইন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

সাহিত্য অনুরাগী এই মানুষটি তার বক্তৃতায় প্রায় সময়ই কাজী নজরুল ইসলাম ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কবিতার বিখ্যাত উক্তি উচ্চারণ করতেন। ১৯৭১ এ যখন পাকিস্তানের সামরিক সরকার প্রধান এয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা চলছিলো,কোন সমাধানে উপনিত হতে পারছিলেন না, তখন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কবি নজরুলের পংতি উচ্চারণ করে বলে ছিলেন ” আমি জাহান্নামের আগুনে বসেও হাসি পুষ্পের হাসি”।কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের স্মরণযোগ্য উক্তি উচারণ করে বলেছিলেন ” চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস”।

১৯৭১ এর মার্চ মাসে টঙ্গিতে পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর গুলিতে বহু শ্রমিক হতাহত হয়েছিলো।উত্তেজিত হয়ে শ্রমিক দল বঙ্গবন্ধুর বাস ভবনে ছুটে গিয়েছিলো।শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য শেষে উচ্চারণ করে বলেছিলেন ” বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত,যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,অত্যাচারির খড়ক কৃপান ভীম রণ ভুমে রণিবে না “। বঙ্গবন্ধু ও কবি কাজী নজরুল ফাইল ছবি

বাঙালির শোষণ বঞ্চনা,সহজ সরলতা দেখে প্রায় সময়েই উচ্চারণ করতেন রবীন্দ্রনাথের অমর বাণী–” সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি”। তিনি লেখকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন ” আজ আমাদের সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দূর্নীতির শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে, আপনাদের লেখনীর মাধ্যমে তার মুখোশ তুলে ধরুন।দুর্নীতির মূলোচ্ছেদে সরকারকে সাহায্য করুন “।

সাহিত্য প্রেমি ও লেখক শেখ মুজিব কারাগারের নির্জন কক্ষে বসে কলম পিষে নিজেও হয়ে ওঠেন বাঙালীর ইতিহাস খ্যাত ও নমস্য লেখক।অসমাপ্ত আত্মজীবনী,আমার দেখা নয়া চীন, কারাগারের রোজ নামচা ইত্যাদি প্রবন্ধগ্রন্থ লিখে রেখে গেছেন তাঁর অন্তর নিংগড়ানো নানা তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করে।। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থটি বর্তমানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।তা ছাড়া বিভিন্ন ভাষায় এই বইটি অনুদিত হয়েছে। এ সবই হলো নেতৃত্বের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর নিজ্স্ব মেধার প্রতিফলন।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১০ জানুয়ারী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বিজয়ের বেশে ফিরে আসেন। সে দিন সহোরাওয়ার্দি উদ্যানের জন সভায় আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে ” কবিগুরু আপনি দেখে যান, সাড়ে সাত কোটি বাঙালি মানুষ হয়েছে”। বাঙালি আজ স্বাধীন ও শোষণ মুক্ত। শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকবৃন্দের সৃস্টিশীল বিকাশের জন্য যে কোন অন্তরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবেই।ভুলে ভরা সমাজ সংশোধনের জন্য লেখকদের প্রতি আহবান রাখেন।

সাহিত্য প্রেমি বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বিশ্ববন্ধু তাঁর বহুবিধ মেধার সমন্নয়ে।আগামী প্রজন্মকে বলবো স্বনাম ধন্য, বিশ্বখ্যাত হতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী হতে হবে। বিভন্ন উপায়ে ও কৌশলে গণমনে গ্রহনযোগ্য জায়গা তৈরী করে নিতে হবে। তার রাজনৈতিক পান্ডিত্য,মহানুভবতা, সাহিত্যনুরাগী, জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করার মনোবৃত্তি ইত্যাদির সমন্নয়ের জন্যই শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি বা poet of politics বলা হয়।বঙ্গবন্ধুর জন্ম শত বর্ষ ২০২১ এর ১৭ মার্চে নত শিরে প্রাণ খোলে জানাই সেলুট।

লেখকঃ উপদেষ্টামন্ডলির সদস্য,বাংলাদেশ কৃষক লীগ।

বাংলাদেশ সময়: ১৮:১৬:৪৯ ● ৩৮৭ বার পঠিত