মঙ্গলবার ● ৬ জুন ২০২৩
সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৬২: স্বপন চক্রবর্তী
Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৬২: স্বপন চক্রবর্তীরূপবান: পর্ব-২: শেষ পর্ব
তখন ঘাটে মাঠে বা নৌকায় সর্বত্র সুরে- বেসুরে শুধুই রুপবানের গান শোনা যেতো। গলা ছেড়ে গেয়ে উঠতো গান -সাগর কূলের নাইয়া রে অপর বেলায়, মাঝি কোথায় যাও নাও বাইয়ারে। অথবা বার দিনের শিশু লইয়ারে, ও বন্ধু ঘুরছি বনে বনে রে । দুঃখিনীরে আর কাঁদাইও না, বা নিদারুন শ্যাম তোমায় লইয়া বনে আসিলাম। অথবা বাড়ির না দক্ষিণ পাশে গো ও ধাইমা কিসের বাদ্য বাজে গো আমার ধাইমা ধাইমা গো।
আমাদের বাড়ির সামনেই ছিল নদী। ব্রহ্মপুত্রের একটি শাখা, নাম কাঁচামাটিয়া। দিনরাত ছোট বড় অসংখ্য নৌকা চলতো নদীতে। দিনে তো বটেই গভীর রাত অবদি মাঝিদের কন্ঠে গান শুনা যেতো। আর সে গান ছিল অধিকাংশই রূপবান পালার। নৌকার ছইতে মাইক বেঁধে বরযাত্রীগণ যেতো বিয়ের অনুষ্ঠানে। আর বাজতে থাকতো কলের গান। সে গান গুলোর মধ্যে অবশ্যই থাকতো রূপবানের গান বা রূপবানের পূর্ণ পালাটি। গভীর রাতেও নীরবতা ভেদ করে ভেসে আসতো কলের গান, আর সাথে যেন প্রতিযোগিতা করে চলতো নৌকার দাঁড় বাওয়ার শব্দ-ক্যাঁ ক্যুঁ….
তখন রেডিও ছিল, তবে শুধুমাত্র রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা এবং করাচীর অনুষ্ঠান শুনা যেতো। তবে করাচীর অনুষ্ঠান শুনার আগ্রহ ছিল কম,কারণ অনুষ্ঠান হতো উর্দুতে। খালি শুধু শুনতাম – এ রেডিও পাকিস্তান হ্যায়। আবাব আনোয়ার বজ্জাত আপকো খবর শুনিয়ে- ইত্যাদি। শিলং ও কোলকাতাও শুনা যেতো। আরও শুনা যেতো দিল্লী এবং আসামের গৌহাটি কেন্দ্র। টেলিভিশন তখনও গ্রাম পর্যায়ে চালু ছিল না। লোকে নামও তেমন জানতো না। শহরেও খুব অস্পষ্ট দেখা যেতো টেলিভিশন এবং তাও ঢাকার আশেপাশে শুধু শুনতে পাওয়া যেতো। ফলে মানুষের বিনোদনের জন্য অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করতো কলের গান ( গ্রামোফোন রেকর্ড ) । একটু স্বচ্ছল ব্যাক্তি মাত্রই কোন অনুষ্ঠান-, যেমন বিয়ে,অন্নপ্রাশন, মুসলমানি বা হালখাতা ইত্যাদি করলে কলের গান ভাড়া করে নিয়ে আসতো। সেই কলের গানে বেশির ভাগই থাকতো রূপবান পালা অথবা তার গান। অন্যান্য গানও থাকতো , তবে রূপবান অবশ্যই। মানুষের ভীড় হতো খুব। আয়োজনকারী লোকটিও খুব আত্মতৃপ্তি লাভ করতো। দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়তো আয়োজক কর্তার নাম।
উল্লেখ্য যে, রূপবান চলচ্চিত্রটিতে মোট ৩০ টি গান সংযোজিত হয়ে ছিল। গান গেয়েছিলেন নন্দিত লোকগীতি শিল্পী আব্দুল আলীম ও নীনা হামিদ। এই রূপবানের জনপ্রিয়তার সাথে সাথে রূপবান চরিত্রে অভিনয়কারী নায়িকা সুজাতাও অতি জনপ্রিয় নায়িকা হয়ে উঠেছিলেন। তাকে ”রূপবান কন্যা” হিসাবেও ডাকা হতো।
২০১৮ সালে চ্যানেল আই এর “তারকা কথন” নামক এক অনুষ্ঠানে রূপবান কন্যাখ্যাত সুজাতা একটি মজার কাহিনী বলেছিলেন। তিনি বলেন, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে সিনেমার স্যুটিং চলছিল। তাজেলের প্রেমে পড়ে রহিম রূপবানকে ভুলে যেতে বসে। তখন রূপবানের যে কান্নার দৃশ্যটির স্যুটিং হয়েছিল একটি বাঁশকে আঁকড়ে ধরে , সেই বাঁশটি পরে নিলামে ওঠে এবং জনৈক ব্যক্তি সাড়ে পাঁচশ টাকায় বাঁশটি কিনে নিয়েছিল। সেই ব্যক্তিটির বৃদ্ধ বয়সে সুজাতার সাথে সাক্ষাত ঘটলে নিজে এই কথা বলেছিল। বলে ছিলো যে, তিনিই সেই বাঁশটির ক্রেতা এবং বাঁশটি এতোদিনও যতন করে রেখে দিয়েছেন। তখন একটি বাঁশ পাওয়া যেতো দুই/তিন আনায়। সুজাতা নিজে যেহেতু একটি টিভি চ্যানেলে বলেছেন, তাই এটিকে নেহায়েৎ গল্প বলা যায়না। এমন অনেক কাহিনী তখন শুনা যেতো। যেখানেই রূপবান পালা ,সেখানেই কোন না কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। বাঁশ কিনার খবর অহরহই পাওয়া যেতো। কেহ বা উৎসাহিত হয়ে মঞ্চে উঠে নায়িকাকে একটি বা দুটি টাকাও দান করে বসতেন। লোকে হাততালি দিতো। আর আয়োজকদের কেহ দাতার বদান্যতার কথা ঘোষণা দিতেন। অনেকে আবার এতো টাকা দান করার জন্য অবাক হয়ে চোখ কপালে তুলতেন।
রূপবান জ্বরে দেশ আক্রান্ত ছিল দীর্ঘ দিন। সিনেমা হলে গিয়ে টিকিট পাওয়া দুষ্কর ছিল। ব্ল্যাক মার্কেটিং ছাড়া টিকিট পাওয়া ছিল সুদুর পরাহত ব্যাপার। গ্রামের হাট বাজারে অপেরা পার্টি একরাতের জন্য হলেও রূপবান পালা মঞ্চস্থ করতো। দর্শকগণ, বিশেষ করে শীত মৌসূমে চাদর মুড়ি দিয়ে যাত্রা প্যান্ডেলে ঢুকে বসতো। বসার আসন ছিল খড় অথবা পাটের চট। সারা রাত ব্যাপি যাত্রা চলতো। পিনপতন নিঃস্তব্দতায় অশ্রু স্বজল চোখে ভোর বেলায় সবাই বাড়ি ফিরে যেতো। অনেকে একাধিক বারও উপভোগ করেছে এই পালা। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো অনুভুতিকে ভাগাভাগি করা। মঞ্চে অভিনেতা যখন কাঁদে তখন দর্শকও সম্মোহিত হয় এবং কাঁদে। এটাই বৈশিষ্ট্য।
এ সব লোকনাটক অনেকাংশে সঙ্গীত প্রধান হয়ে থাকে। লোক নাটকে সঙ্গীতের ব্যবহার নিয়ে আলোচনাকে অতি কথন বলা যায়। কারণ যাকে লোকনাটক বলা যায়, তার উৎপত্তিই হয়েছে সঙ্গীতের সমুদ্র থেকে। সঙ্গীতই তার প্রাণ, তার সংলাপ এবং তার রসানুভুতির মুল আশ্রয়। লোকনাটকের উদ্ভবের সম্বন্ধে যাঁরাই আলোচনা করেছেন, কিংবা যাঁরা লোক নাটকের বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলেছেন তাঁরা সকলেই মনে করেন লোক নাটকের প্রধান লক্ষণ হলো এ গুলি গীতি প্রধান রচনা। লোকনাট্য বিষয়ে বলতে গিয়ে আশুতোষ ভট্টাচার্য, অজিত কুমার ঘোষ, কিংবা তুষার চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ বন্দোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু ভৌমিক প্রত্যেকেই এই সাংগীতিক ধর্মের কথাই বলেছেন। বাংলার লোকনাট্য সম্বন্ধে প্রথম আলোচনাই শুরু হয়েছিল এই গানের সূত্রে। অধ্যাপক বরুণ চক্রবর্তী তাঁর “বাংলা লোক-সাহিত্য চর্চার ইতিহাস“গ্রন্থে দেখিয়েছেন, লোকনাট্য বিষয়ক চর্চার সূত্রপাত হয়েছিল গুরুসদয় দত্তের বালান সম্পর্কিত আলোচনায় আর যে লেখায় ( The Folk Dances Of Bengal ) এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল তাতে বোলানকে বলা হয়েছিল Ballad Dance. এই Ballad Dance – এর মুল বিষয় হলো “ Dance & Song “. আর হারাধন দত্ত তাঁর প্রবন্ধে বোলানকে নদীয়ার পল্লীগীতি বলেই নির্দেশ করেছিলেন। কাজেই সঙ্গীতকে লোকনাট্য থেকে পৃথক করা যায় না। লোকনাট্যের উদ্ভব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অনেকেই বলেছেন, “ এগুলো আদিম যুগের Ritual Dance, পরে সে গুলিতে সঙ্গীত যুক্ত হয়েছিল। ক্রমে সেইগুলি থেকে সঙ্গীতাংশ কমে সংলাপ অংশের বিস্তার ঘটেছে। সুতরাং নৃত্য ও সঙ্গীত লোকনাট্যের প্রথম দিকে এই দুটি উপাদানই ছিল মূখ্য। আশুতোষ ভট্টাচার্য এ গুলোকে গীতিপ্রধান বলেছেন। অজিত ঘোষ বলেছেন এ গুলোতে সঙ্গীতের প্রধান্যের কথা।” আর অপেরা বলতেই বুঝায় গীতিনাট্যকে (ইতালীয় Opera) জনপ্রিয় এক প্রকারের গীতিনির্ভর নাটক হলো অপেরা। এটি পশ্চিমা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি প্রধানতম শাখা। এর উদ্ভব ইতালীতে, পরে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত মঞ্চনাটক ঘরানার মঞ্চ,অভিনয়,পোশাকসজ্জা এবং কখনো নৃত্য সহকারে এই গীতিনাট্য পরিবেশিত হয়।
(রূপবান পর্ব এখানেই শেষ, তবে সীমান্ত ভ্রমণ নিয়ে প্রাসঙ্গিক কথা চলবে )
বাংলাদেশ সময়: ২১:৩৪:৪৬ ● ৫১৭ বার পঠিত