শুক্রবার ● ২ জুন ২০২৩
সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৬০:-স্বপন চক্রবর্তী
Home Page » বিবিধ » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৬০:-স্বপন চক্রবর্তীবেদের মেয়ে জোৎস্না:-
স্বাধীনতা পূর্ব ও উত্তর সময়ে লালমনিরহাট তথা বৃহত্তর রংপুরে হরহামেশাই একটি লোকনাট্য পালা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যেতো। ঝুমুর যাত্রার আদলে এটা অনেকটা গীতি নাট্যরূপও বলা যায়। এখানেও মেয়েদের অভিনয় ছেলেদেরকে দিয়ে করানো হতো। যদিও বড় বড় পেশাদার অপেরা গুলোতে নারী শিল্পীর অভাব হতো না। এই নাটক মঞ্চায়নের জন্য খুব একটা আড়ম্বর পূর্ণ আয়োজনের প্রয়োজন হতো না। অর্থাৎ প্রয়োজন হলেও গ্রামাঞ্চলে অনুকূল পরিবেশ এবং ব্যয় করার মতো সামর্থ থাকতো না। তাই সংক্ষিপ্ত ভাবেই মঞ্চায়ন করা হতো । যেকোন একটা উপলক্ষ হলেই অতিরিক্ত আনন্দ বর্দ্ধনের জন্য এই পালাটি অনুষ্ঠিত হতো। দর্শক সমাগমও বেশ ভালোই হতো। এই পালাটি ছিল “ বেদের মেয়ে জোৎস্না”। এটি লক্ষ্য করেছি যে, বেশ দর্শক নন্দিত একটি নাটক। পাড়ায় মহল্লায় বা ক্ষেতে খামারে এর গানগুলো সকলের মুখে মুখে এক সময় খুব গীত হতো। কাহিনীকারের নামটি আমার জানা নেই। সংক্ষেপে কাহিনীটি ছিল এমন যে,
এক পরগনার কাজী সাহেবের দশ বছরের একমাত্র মেয়েকে সাপে কাটে। তাকে বাঁচানোর সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তখনকার রেওয়াজ অনুসারে একটি পত্র সাথে দিয়ে কলা গাছের ভেলাতে করে লাশটি নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। সেই ভেলা ভেসে ভেসে নদীর কিনারে এক বেদের বহরের কাছে এসে থেমে যায়। বেদের বহরের সর্দার ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি মেয়টিকে সুস্থ্য করে তুলেন এবং নিজ নাতনীর মতো করে মানুষ করেন। নাতনীকে যত্ন সহকারে পেশাদার বেদেনি হিসেবে গড়ে তুলেন। সে নাচে-গানেও বেশ পারদর্শি হয়। নাম রাখেন জোসনা। একদিন বঙ্গরাজের উজিরপুত্র জোসনার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করলে রাজকুমার আনোয়ার এসে তাকে উদ্ধার করে। এক পর্যায়ে দুজন পরস্পরকে ভালো বাসে। একদিন আনোয়ারকে সাপে কামড় দেয়। সকল ওঝা বিষ নামাতে ব্যর্থ হয় এবং জোসনা এসে বিষ নামাতে সমর্থ হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, বঙ্গরাজ পুত্রশোকে এমনই কাতর হন যে, তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, তার পুত্র আনোয়ারকে যে, সুস্থ করতে পাবরে তাকে সে যা চাইবে তাই প্রতিদান হিসাবে দিয়ে দিবে। আনোয়ারের সুস্থতার পর রাজার এই প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দিয়ে জোসনা রাজকুমার আনোয়ারকে চায়। কিন্তু বঙ্গরাজ এটা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। বরং তিনি বেদের বহরটিকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করেন। আনোয়ার জোসনার খোঁজে বের হয় এবং জোসনাকে পেয়ে বিয়ে করে আনে। রাজা তখন আনোয়ারকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে। কিন্তু রাণী সুকৌশলে নিজপুত্রকে রক্ষা করে এবং আত্মগোপনে পাঠায়। এভাবেই চড়াই উৎড়াই পেড়িয়ে ঘটনা সমাপ্ত হয়।
এই কাহিনী নিয়ে ১৯৮৯ সালে পরিচালক তোজাম্মেল হক বকুল একটি ছবি নির্মাণ করেন। নামটিও ছিল একই- বেদের মেয়ে জোৎস্না। চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গান পর্যন্ত প্রায় অপরিবর্তিত রেখে এই ছবিটি নির্মাণ করা হলে তা অত্যন্ত দর্শক নন্দিত হয়। ছবির মূখ্য ভুমিকায় অভিনয় করেছেন নায়ক ইলিয়াশ কাঞ্চন ও নায়িকা অঞ্জ ঘোষ। এই ছবিটি এতো ব্যবসা সফল হয়েছিল যে, বলা হয়ে থাকে যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে ব্যবসা সফল একটি ছবি। আমাদের দেশের সাধারণ দর্শক লোক কাহিনী, রূপকথার কাহিনী বা কল্প কাহিনী নির্ভর ছবিকে অনেক পছন্দ করে থাকে। আর্ট ফিল্ম, আধুনিক ফিল্ম বা এক্সপেরিমেন্টাল অথবা ডকুমেন্টারী ফিল্ম হয়তো তেমন দর্শক নন্দিত হয় না।। বেদের মেয়ে জোসনা দেখার জন্য গ্রাম্য মহিলারা দুরদূরান্ত থেকে জেলা বা উপজেলা সদরে গরুর গাড়িতে ,রিক্সায় বা নৌকায় করে এসে ভীড় জমাতো সিনেমা হল গুলোতে।। ছবি তাদের দেখা চাই। এমনও সংবাদ চাউর হয় যে, অন্তস্বত্তা মহিলা হলে এসে বাচ্চা প্রসব করেছেন, আবার সদ্য প্রসূত সন্তানকে নিয়ে কোন মহিলা সিনেমা হলে চলে এসেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গ্রামাঞ্চল থেকে গরুর গাড়িতে করে অথবা নৌকায় করে সদরে এসেছে বেদের মেয়ে জোসনা ছবি দেখতে। স্বামী-স্ত্রীতে প্রচন্ড ঝগড়াও হয়েছে সিনেমা দেখার আব্দার নিয়ে। উল্লেখ্য যে,ছবিটির জনপ্রিয়তা এবং সফল ব্যবসা দেখে পশ্চিম বঙ্গেও একই নামে এবং অজ্ঞু ঘোষকে নায়িকা করে সিনেমা তৈরী হয়। ( চলবে )
বাংলাদেশ সময়: ২০:২৮:৪৫ ● ৪২৫ বার পঠিত