বুধবার ● ৩১ মে ২০২৩

এই সেই মেধা - অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগম

Home Page » সাহিত্য » এই সেই মেধা - অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগম
বুধবার ● ৩১ মে ২০২৩


এই সেই মেধা
অজ পারা গাঁয়ে লবণ লংকার পরিবারের সন্তান মেধা। মেয়েটি কথায় কাজে বেশ চমৎকার।স্থানীয় একটি স্কুলে পড়াশোনা করে। অশিক্ষিত বাবা মা’র এই সন্তানটি গায়ে পরে পাড়া প্রতিবেশী মানুষের নানা প্রকার উপকার করে বেড়ায়।

কারো অসুখ বিসুখ হলে নিয়ে যায় সদর হসপিটালে। কোন ডাক্তার দেখাবে,কি করতে হবে, সাধ্যমত বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে।
পাশের বাড়ীর মিনার মা ছুটে আসে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে। তার মেয়ে পঞ্চগড়ে বাসা বাড়িতে কাজ করে। স্বামী পালিয়ে গেছে,সন্তানটি রেখে গেছে নানুর কাছে। সেই কাজের বুয়া মিনার সাথে সুখ দুঃখের কথা বলার সুযোগ করে দেয় মোবাইলের বাটন টিপে মিনার মাকে। মিনার মা মোবাইল করতে পারে না।

মেধার অলস সময় পার করতে ভালো লাগে না। সর্বদা এ কাজে ওকাজে ছুটাছুটি করে।ও দাদু ওদাদু বলতে বলতে পাশের ঘরে ছুটে যায়। দাদু তো কানে শোনে না,একা একা বিরাট বাড়িতে বসবাস করে।তার সন্তানরা থাকে দুরদুরান্তে। দাদুর হাত পায়ের নখ কেটে দেয়, খেয়েছে কিনা খোঁজ খবর নেয়। অসুখ বিসুখ হলো কি না, সে খেয়ালও রাখে।

চলে আসবে, এমন সময় হাতে গুঁজে দেয় কিছু টাকা।দাদু বলে — কোথায় রাখি মনে রাখতে পারি না। কেউ জানতে পারলে চুরি করে নিয়ে যায়।তোর কাছে রাখ।সময় হলে নিবো।

পাশের ঘরের চাচি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে।গরুর দুধ নামাতে পারছে না চাচা। মেধা বালতি হাতে ঢুকে যায় গোয়াল ঘরে। গাইয়ের ওলান টেনে গড় গড় করে দুধ নামিয়ে দেয়। চাচা সে দুধ হাটে বিক্রি করে নিত্য দিনের বাজার নিয়ে ঘরে ফিরে।

সকালে ঘুম থেকে ওঠেই –মাটির চূলার ছাই পরিস্কার করে,ঘর ঝাড়ু দেয়, বাসি থালা বাসন ধুয়ে মায়ের কাজ কিছুটা এগিয়ে দিয়ে, ছোট ভাইকে মক্তবে পাঠিয়ে নিজে পড়তে বসে। স্কুলে যাওয়ার সময় হলে পুকুরে গোসল সেরে গায়ের আলপথ ধরে স্কুলে রওনা করে।

বকাটে ছেলেদের অত্যাচারে মাঝে মাঝে স্কুলে যেতে পারে না।রাস্তার তেমাথায় কিছু ছেলে পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা মেধাকে ফ্লাইং কিস ছুড়ে মারে, প্রেম নিবেদন করে, তুলে নেয়ার ভয় দেখায়।

স্কুল কামাই করে বলে স্যাররা দমকা দমকি করে। কিন্তু ঠোট খুলে বলতে পারে না, তার ক্লাশের ছেলে বন্ধুরাই মেধাকে বিরক্ত করে, স্কুলে আসার পথে বাঁধা দেয়। ক্লাসে উপস্তিতির হার কমে যাওয়ায় উপবৃত্তির টাকা বন্ধ করে দেয়।মেধার মুখ কালো হয়ে আসে।এবার যদি বাবা তার পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়, কি হবে তখন?

রাতে পড়তে বসে, ভাবতে থাকে স্মরনীয়,বরণীয়, বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিদের কথা। তাদের ত্যাগী,সৃজনশীল,সমাজ বির্নিমানের কলাকৌশল জানতে ইচ্ছে করে। জানবে কি করে। হাতের কাছে বই পত্র তো কিছুই নেই।স্মার্ট মোবাইল ফোন কেনার ক্ষমতা নেই।চাইলেই পারে না গুগলে ঢুকে পৃথিবী বোঝাই জ্ঞান মাথায় তুলে নিতে। পাশের বাজারের পাঠাগার থেকে বই সংগ্রহ করবে তারও উপায় নেই। ঐ পাঠাগারে বসে বই পড়তে হয়।গ্রাম্য পরিবেশে একটা মেয়ে পাঠাগারে গিয়ে বই পড়রে, সমলোচনার উর্ধ্বে ওঠে এ পরিবেশ এখনও তৈরী হয়নি।

মেধা জানতে পারে –গতকাল বাড়ীতে ঘটক এসেছিলো।মেধার মা বাবা কে ইনিয়ে বিনিয়ে বলছে মেয়ে বিয়ের কথা।মেয়েদের এতো বেশী পড়া লেখা করাতে নেই।তা হলে তারা সংসার জীবনে সুখী হতে পারে না। নানা গন্ধ খুঁজে বেড়ায়। তৈরী করে সংসারের হাড়ি পাতিলে ঝামেলা।

ছেলে কোরআনে হাফেজ। বাবার একমাত্র সন্তান।ঝামেলা মুক্ত পরিবার।ছেলের বাবার বেশ অর্থ সম্পদ আছে। বিয়েতে রাজী হয়ে যাও। একটা ভালো মসজিদে ইমামতি করে,টিউশানী করেও ভালো আয় রোজগার করে।স্বভাব চরিত্রও ভালো। মাথায় টুপি,গায়ে জুব্বা পরে ইসলামি সুন্না অনুসারে জীবন যাপন করে। তোমাদের যৌতুক দিতে হবে না,ছেলে তা পছন্দ করে না।

সময় বেঁধে দিয়ে ঘটক বলে –আমাকে ৫/৬ দিনের মধ্যে হা বা না উত্তর দিতে হবে।আবারও বলছি মনে রাখবা — মেয়েকে তো বিয়ে দিতেই হবে, এখানে তো ওখানে। আলমারীতে ভরে লুকিয়ে রাখতে পারবে না। ভালো ছেলে সব সময় হাতে পাওয়া যায় না। এ ধরনের পাত্রের অনেক ডিমান্ড।মেয়ে পেতে অসুবিধা হয় না।

পরদিন কৃষিকাজ করে মাঠ থেকে ক্লান্ত অবসন্ন মন নিয়ে বাড়িতে ফিরে মেধার বাবা। ঘরের দাওয়ায় বসে মেধার মাকে বলে — মেধার বিয়ের কথা কিছু ভাবছো? মানুষের কান কথা তো আর সহ্য করতে পারছি না। তা ছাড়া এতো পড়া শোনা করে কি হবে। সে কি জজ ব্যারিষ্টার হতে পারবে।

গরু বিক্রি করে গত পরীক্ষার ফি দিয়েছি। এর পরের খরচ চালাবো কি করে। নিজে তো খাটাখাটি করতে করতে মরে গেলাম প্রায়।তা ছাড়া ছেলেটাকে পড়শোনা করানো বেশী দরকার। মেধার মা বলে — কি জানি কি বলবো, আমার মাথায় কুলায় না।

মেধা কুটির শিল্পের উপর প্রশিক্ষণ নেয় স্বর্ণা ম্যাডামের সহায়তায়।সে বুঝতে পারে তার নিজেকে ও নারী সমাজকে স্বাবলম্ভী করা দরকার। তাই প্রতিদিন ১০/১২ জন নারীকে নিজেই কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ দেয়। বিভিন্ন এনজিও, সমাজসেবা অধিদপ্তরের অফিসে ঘুরে নারীদেরকে লোনের ব্যবস্থা করে দেয়।
নারীরা তো মহা খুশী। অল্প পুঁজিতে তাদের অল্প স্বল্প লাভ হয়। হাতে খেটে পান পাতার খরচ যোগার করতে পারলেই হলো। বাচ্চাদের হাতে বা সংসারেও কিছু দিতে পারে।

নারীদেরকে স্বাবলম্বী হতে দেখে এলাকার ধান্দাবাজরা নাখুশ হয়। তারা নানা ফন্দি ফিকির খুঁজতে থাকে, বন্ধ করে দিতে চায় মেধার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। প্রায় সময়েই চাদা দাবি করে হট্টগোল বাধাঁয়। হত দরিদ্র মেধার বাবা জক্কি ঝামেলা মাথায় না নিয়ে মেয়েকে সরে আসতে বলে।।

তৃণমুল পর্যায়ে লোন দাতা সংস্থাগুলো বিষয়টি আমলে নিয়ে মেধার পাশে এসে দাড়ায়। তারা বুঝতে পারে এই মেয়েটিই পারবে এলাকার মেয়েদের ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে।ইতিমধ্যে মেধার পড়াশোনা শেষ পর্যায়ে চলে আসে।

এবার নতুন চকে বেঁধে মেধার কুটির শিল্পটিকে সামনে এগিয়ে দিতে থাকে সরকারী বেসরকারী সংস্থাগুলো। মেধার বাবা মা’র ভাগ্যের অন্ধকার দুর হতে শুরু করে। বেড়ার ঘরের পরিবর্তে টিনের ঘর বাঁধে।হাড়িপাতিলের আওয়াজে আসে স্বচ্চলতা।

অল্পদিনের মাথায় মেধার গ্রামটি উন্নয়নের রোল মডেলে পরিনত হয় । এক ফাঁকে বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে মেধা নিজের অভিঞ্জতাকে করে পাকা পোক্ত। মেধার সুনাম ছড়িয়ে পরে চারিদিকে। বিদেশীরা পরিদর্শন করতে আসে মেধার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

এতো সব সফলতা দেখে ধান্দাবাজদের রক্ত চক্ষু ওঠে আসে কপালে। এখন আর যৌতুক নিয়ে নয়, যৌতুক দিয়ে মেধাকে বিয়ে করতে চায়। তখনও বিয়ের ব্যাপারে মেধা থাকে নীরব চুপচাপ অবস্থানে।

এবার হাতে নয়,ভাতে নয়,বিয়ে নয়, মারবে মেধাকে মানুষিক যন্ত্রণা দিয়ে। উড়ো চিঠি, হুমকি, দমকি,হয়রানি করতে থাকে বিভিন্ন ভাবে। মেধার বাবা,মা, নারী উদ্যোক্তা,কাছের,দুরের আত্মীয় স্বজনসহ সবাই বিরক্ত হয়ে যায় মেধার এক ঘেয়েমীপনার উপর। বিয়ে তো করতেই হবে, তা হলে আর দেরী কেন।এ চাপ্টারটা ঘুচিয়ে নিলেই হয়। বালামুসিবত কেটে যায়। গ্রামের বখাটে ছেলেদের উৎপাত বন্ধ হবে।

এক নিশুতি রাতে ইস্টি কুটুমের মিস্টি ডাকে মেধার ঘুম ভেঙ্গে যায়। গাঢ় অন্ধকারে শোনশান নীরবতা ভেঙ্গ নেড়ি কুকুরগুলো একটু পরপর গলা বাড়িয়ে কান্না করছে। বউ কথা কউ পাখিটি তার প্রিয়ার খোঁজে ঊচু গলায় ডাকাডাকি করছে। কি যেন এক শিহরণ চেপে বসে মেধার মনের ঘরে।অবশ অনভুতি ছড়িয়ে পড়ে হাতে পায়ে।

মেধা ভাবতে থাকে –কি অদ্ভুত এই জীবন।
এই দুনিয়াতে কেউ কারো নয়।
বিখ্যাত অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদি সুবর্ণা মোস্তফাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো, তার প্রথম স্ত্রীকে একটি মেয়ে সহ ডিভোর্স দিয়ে। কিন্তু কই সে বিয়েও তো ঠিকলো না।
বৃটিশ রাজ সিংহাসনের অধিকারী চার্লস বিশ্ব সুন্দরী ডায়নাকে চোখ ধাঁধানো জম কালো উৎসব করে বিয়ে করেছিলো। দুই সন্তান জন্ম দেয়ার পর তাদের সংসারও মাটির থালার মতো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। এমন ঘর ভাঙ্গার উদাহরন রয়েছে বিশ্ব জুড়ে সব দেশে।তারপরও মানুষ কেন চুড়াবালির ফাঁদে ঘর সংসার সাজায়।খেলে প্রেমের লুকোচুরি খেলা।

এতো সব ক্রাইসিস দেখার বা জানার পর মেধা ভাবে — আমার বিয়ে করা কি উচিৎ হবে। যদি সংসারের সুখ পাখি বাড়ায় বিড়ম্বনা।

তা ছাড়া আমার চারপাশে যারা সংসার করছে, তারা সবাই নির্মম,কঠিন, মানবেতর জীবন যাপন করছে। প্রতিদিনই টুকটাক ঝগরা করছে। আবার মেকি হাসি মুখে নিয়ে সংসারের ঘানি টানছে ও কষ্ট যনন্ত্রনায় ধুকে ধুকে বেঁচে আছে। এই তেজপাতা জীবনের কি প্রয়োজন?

বিয়ের পর যৌবনের উত্তাপে,ছেলে সন্তানের মায়া মমতায়, সামাজিকতার চাপে কিছুটা মিহি সূঁতার বন্ধন থাকলেও, স্বামী স্ত্রী প্রকৃত অর্থে কেউ কাউকে ভালোবাসে না। কেউ করে পরোকীয়া, লাটাই ছ্যাড়া ঘুরি হাতে, ধোকাবাজির ফাঁদে লুকোচুরি খেলা খেলে।

মেধার বাবার মাথা প্রায় উল্টা পাল্টা হয়ে আসছে। মেয়ে বিয়ে করে না বলে, মাকে বকা ঝকা করে।, মা মেয়েকে বাড়ী থেকে বের করে দিতে চায়।সুখের সংসারে নেমে আসে ভয়াবহ যন্ত্রণা।

মেধার এতো সব ভাবতে আর ভালো লাগে না। সে কি করবে,কি করা উচিত,নানা দুশ্চিন্তা মাথায় চেপে বসে।

ফেইজ বুক ফেইজে বা সংবাদ মাধ্যমে চোখ রাখলে দেখা যায় –তুচ্চ অজুহাতে স্বামী স্ত্রীর মারামারি, থালা প্লেইট ভাঙ্গাভাঙ্গি,খুনাখুনী করছে, এমন কি নিজস্ব আদিপত্য বজায় রাখতে, তাদের প্রাণ প্রিয় সন্তানকে মেরে ফেলছে।

সংসার ভেঙ্গে দুই জন দুই দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। স্বামী রেখে যাচ্ছে স্ত্রীর পেটে,কোলে,হাতে ধরিয়ে দিয়ে তিনটা সন্তান। ওরা কোথায় দাঁড়াবে কি খাবে সে চিন্তা বাবা করছে না।মা বেচারি জন্ম দিয়েছে,তাদের ছেড়ে পালাবে কোথায়।

তারপরও সংসার নামক কারাগারে মানুষ বন্দি।মনের কষ্ট লুকিয়ে রেখে ঠোটে রাখে মুক্তা দানার হাসি। সংসারের ঘানি টানে জীবন বাজী রেখে।

একদিন মেধার কাছে একটি উড়ো চিঠি আসে।চিঠিতে রসালো অনেক কথার পর - - -
লিখে ” প্লিজ মেধা, তুমি আমার ভালোবাসা গ্রহন কর।তোমার জন্য আমি পৃথিবীর সব কিছু উৎসর্গ করবো।এমন কি আমার কলিজাটাও কেটে তোমাকে দেবো। তোমাকে না পেলে আমি মরে যাবো।”

চিঠি হাতে নিয়ে বাড়ির পাশে পুকুর ঘাটে গিয়ে বসে।টলমল জলে উড়ো চিঠির কল্পনার নায়ককে নিয়ে ছবি আঁকতে থাকে।
সত্যি যদি সে ছেলেটির সাথে আমার বিয়ে হয় — কেমন হবে? সে তো তার হৃদয় কেটে দিতেও প্রস্তুত। ক্ষতি কি বিয়ের পিঁড়িতে বসলে?
সে উড়ো চিঠির নায়ককে নিয়ে কল্পনার বাগানে প্রেমের দৃশ্যে মেধা অভিনয় করতে শুরু করে ।
এমন সময় হঠাৎ করে বাতাসে উড়ে চিঠিটি পুকুরের পানিতে তলিয়ে যায়।মেধার তন্দ্রা ভঙ্গ ঘটে।

অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগম

লেখকঃ সভাপতিমন্ডলির সদস্য,বাংলাদেশ কৃষকলীগ।

বাংলাদেশ সময়: ১৫:৩৯:৩২ ● ৭৮৮ বার পঠিত