শনিবার ● ২৫ মার্চ ২০২৩
শিউলিফুলের আলোয় দেখা মুক্তিযুদ্ধ!- মোসাম্মৎ আয়েশা আক্তার
Home Page » সাহিত্য » শিউলিফুলের আলোয় দেখা মুক্তিযুদ্ধ!- মোসাম্মৎ আয়েশা আক্তার
২৬ মার্চ।
রাত শেষে মাত্র পূবাকাশে আলো রেখা ফুটে উঠেছে। এখনো সূর্য ওঠেনি।
মায়ামী কলেজে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে - স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবার জন্য। আজ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী মায়ামীর সকল সহকর্মী ও শিক্ষার্থী লাল-সবুজ রঙের পোশাক পরে আসবে। মায়ামী তার লাল - সবুজ রঙের শাড়িটার দিকে তাকিয়ে মনে হল সেই ছোট্টবেলার কথা। মায়ামীর জন্ম স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে হলেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তার মামাদের মুখে শোনা গল্প, মা, বড় চাচি আর বড় ভাইয়ের মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে মুক্তিযুদ্ধের সব দৃশ্যপট যেন মায়ামীর কাছে জীবন্ত। মনে পড়ে যায় মায়ামীর দিগন্ত জোড়া ধানের ক্ষেতে বসন্তের বাতাস বয়ে যাওয়া। মায়ামীর কাছে মনে হতো - দেশ স্বাধীন করার আনন্দ নিয়ে এই ধানের ক্ষেতে এই ঢেউ খেলানো বাতাস হয়ে বইছে তার মুক্তিযোদ্ধা মামা ও তার বন্ধুরা কিংবা সকল মুক্তিযোদ্ধারা। আজকে এই মহান স্বাধীনতা দিবসের সকালে মায়ামী সবুজ শাড়ির আচঁলটাকে সেই দিগন্তজোড়া ধান ক্ষেতের সবুজ মাঠ বলে মনে হচ্ছে; যা বসন্তের বাতাসে উড়বে। সেই বসন্তের বাতাস হয়ে আসবে তার শহিদ মুক্তিযোদ্ধা মামা।আর সবুজ শাড়িটার লাল পাড়
মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মামার লাল রক্তের ছাপ। যা কখনোই মুছে যাবে না মন থেকে।
পরক্ষণে মায়ামীর মনে পড়ে গেল এই দিনে তার বড় চাচীর ভাই হারানোর শোকে অবিরত অশ্রুস্নাত চোখ- মুখ। আর স্কুলে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে যাবার জন্য মায়ামীকে তাড়া দেয়ার কথা। ফুলের মালা গেঁথে দেওয়া, স্কুলের অনুষ্ঠানে মায়ামী কোন্ কবিতাটা পড়বে, কি বক্তৃতা দিবে এই নিয়ে বড় চাচীর অনেক উৎসাহ ছিল।স্কুলের আগে পরে বেশিরভাগ সময় কাটতো মায়ামীর বড়চাচীর সাথে। বড়চাচীর ছেলেমেয়েরা তখন কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে বলে বাড়ির বাইরে থাকতো।সেই সুবাদে মায়ামীর সঙ্গ ছিল বড়চাচীর কাছে অনেক আরাধ্যের। বড় চাচী একুশে ফেব্রুয়ারি, মার্চ আর ডিসেম্বর মাস এলে বড়চাচী নীরবে চোখের জল ফেলতেন। মায়ামী চোখ মুছিয়ে দিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধে তার ভাইয়ের শহিদ হবার একই গল্প শুনেছে অসংখ্যবার। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গল্প শোনাতো মায়ামীর বড়চাচী।
মায়ামীর বড় চাচীর ছোট ভাই ছিলেন দেখতে উঁচু লম্বা এবং গায়ের রং ফর্সা। এজন্য সবাই তাকে “রাঙ্গা” বলে ডাকতো।সেই রাঙা মামার বাড়ি ছিল
তৎকালীন কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার জামালকান্দি গ্রামে।বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন খুব ঘনিষ্ঠজন নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী (যা বঙ্গবন্ধু নিজেও তাঁর লেখা “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” তে উল্লেখ করেছেন) ওসমান খানের পৈত্রিক বাড়ি।
স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে শ্রদ্ধেয় ওসমান খানকে খুঁজে পাওয়ার জন্য একদল পাকিস্তানি মিলিটারি অতর্কিতভাবে সশস্ত্র অবস্থায় তাঁদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং বন্দুকের নল উচিয়ে বলতে থাকে -”খান ছাহাব কা হায়ে! খান ছাহাব কাহায়ে!” ( খান সাহেব কোথায়?)।
সেই খান সাহেবকে মনে করে বাড়িতে ঢুকতেই মায়মীর রাঙ্গা মামাকে সরাসরি গুলি করে আর বলতে থাকে “খান ছাহাব মিলেগা! খান ছাহাব মিলেগা!”। এভাবেই মায়ামীর রাঙা মামাকে খান সাহেব মনে করে হত্যা করে মনের সুখে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী। খান বাড়ির স্কুল, মসজিদ, দু’তলা কাঠের বাড়ি , মা- চাচী আর সোমত্ত বোনদের ইজ্জত সবই অক্ষত থেকে যায় যেন মায়ামীর রাঙ্গা মামার জীবন দানের মাধ্যমে।
মায়ামীর মুক্তিযোদ্ধা মামা সেদিন তাঁদের খান বাড়িতে পাকিস্তানি মিলিটারির হামলা হবে সেটা জেনেই বাড়িতে দৌড়ে এসেছিলেন - তার মা, চাচী আর চাচাতো বোনদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে। পাকিস্তানি মিলিটারি বাড়িতে ঢুকবে বলে চাচী এবং চাচাতো বোনদের অন্য বাড়িতে সরে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে যেই মায়ের ঘরে ঢুকে মাকে ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দিয়েছেন কিন্তু তিনি (রাঙ্গামামা ) বের হয়েছেন সামনের দরজা দিয়ে। কারণ মিলিটারি ঢুকে পড়েছে বাড়িতে - তাদের মোকাবিলা করতে হবে। অমনিতেই গুলি এসে বিধল তার বুকে। তার বুক ভেদ করে গুলি গিয়ে লাগে রাঙ্গা মামাদের ঘরের দেয়ালে। রাঙ্গা মামার বুকের সাথে ঘরের দেওয়াল ও ছিদ্র হলো ; ছিদ্র হলো তার মা আর ভাই- বোনের সুখের জীবন। এই দেয়ালটির গুলির আঘাতে ক্ষত হওয়া চিহ্নটি মুছতে দেননি যতদিন মায়ামীর নানু বেঁচে ছিলেন। কক্ষের ভিতর এই দেয়ালের পাশে তিনি নামাজ পড়তেন আর দেয়ালের বাইরের দিকে শিউলি ফুলের গাছ লাগিয়ে শিউলি ফুল ফোটার অপেক্ষায় থাকতেন।তিনি মনে করতেন তার রাঙা খোকা ফুটবে এই শিউলি ফুল হয়ে । রাতে ফোটা শিউলি ফুল সকালে শিউলি তলায় মাটিতে বিছিয়ে পড়ে থাকতো। এই ফুল তিঁনি কাউকে কুড়াতে দিতেন না। কারণ তার রাঙ্গা খোকা যে শত শত শিউলি ফুল হয়ে তার উঠোনে আলো ছড়াচ্ছে!
মোসাম্মৎ আয়েশা আক্তার, সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা কলেজ ।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৩৫:২৭ ● ৬০৬ বার পঠিত