বৃহস্পতিবার ● ১৫ ডিসেম্বর ২০২২
চরম দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে জয়ী হওয়া এক অদম্য যুবক ড. এস এম মোজাম্মেল হোসেনের জীবন ও কর্ম
Home Page » শিক্ষাঙ্গন » চরম দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে জয়ী হওয়া এক অদম্য যুবক ড. এস এম মোজাম্মেল হোসেনের জীবন ও কর্মব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নবীনগর সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক ড. এস এম মোজাম্মেল হোসেন ১৯৮৪ সালের ৬ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত সদর উপজেলার রামরাইল ইউনিয়ন এর মোহাম্মদপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার মরহুম এস এম মজনু হোসেন ও রত্নগর্ভা মায়ের নাম মোছাঃ হাছিনা বেগম। তাঁর বাবা মরহুম এস এম মজনু হোসেন ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন সাহসী বার্তাবাহক হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, ১৯৮৬ সালের ১৮ অক্টোবর তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় বাবা এস এম মজনু হোসেন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তাঁর বাবার মৃত্যুর পরে তাঁর মমতাময়ী মা অনেক সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও বিসর্জন দিয়ে তাঁর ৬ ছেলে মেয়েকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। ৬ ভাই বোনের মধ্যে ড. এস এম মোজাম্মেল হোসেন পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠতম সন্তান। মাত্র ৩ বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতাকে হারান। পিতার মৃত্যুর পরে তাদের পরিবার দুঃখের অথৈ সাগরে পড়ে যান। কিন্তু হাল ছেড়ে দেন নি। তাই ১৯৯৯ সালে ড. এস এম মোজাম্মেল হোসেন রামরাইল শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৩টি বিষয়ে লেটার পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। তাঁর এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার খবরটি রেজাল্ট শীটসহ তাঁর প্রিয় শিক্ষক ইব্রাহিম স্যার তাঁদের বাড়িতে চলে আসেন। তাঁর চমৎকার ফলাফল এর খবর পেয়ে তাঁর নিজ গ্রাম মোহাম্মদপুরের লোকজন তাঁদের বাড়িতে ছুটে আসেন। বাড়িতে সবাইকে মিষ্টি মুখ করানো হয়। গ্রামের সবাই আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন। তাঁর ভালো ফলাফল এর খবর পেয়ে বিজেশ্বর এ মোনেম কলেজের একজন শিক্ষক তাঁদের বাড়িতে আসেন। বাড়িতে এসে এই মেধাবী কৃতি ছাত্রকে ভর্তি করানোর জন্য প্রস্তাব দেন। তাঁকে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন ও তাঁর পড়াশোনার যাবতীয় খরচ চালানোর কথা বলেন। কিন্তু ড. এস এম মোজাম্মেল হোসেনের মমতাময়ী মা মোছাঃ হাছিনা বেগম এ ধরনের লোভনীয় প্রস্তাবে রাজী হন নাই। কারণ, তাঁর ছেলে ড. এস এম মোজাম্মেল হোসেন ইতিমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের চরম প্রতিযোগিতাপূর্ণ ভর্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। তিনি তাঁর ছেলেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করে দেন। অথচ তখনও তাঁদের পরিবার চরম দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে জীবন যাপন করছিলো। যাই হোক, ২০০১ সালে ড. এস এম মোজাম্মেল হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। একই বছর ২০০১ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় অবস্থিত কাউতলী স্টেডিয়াম থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক পদে লিখিত পরীক্ষায় ৫০ নম্বরের মধ্যে ৪৮ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তারপর কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের BRU এর দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর তাঁকে সৈনিক পদে চূড়ান্ত নিয়োগপত্র প্রদান করেন। ইতিমধ্যে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ভর্তি পরীক্ষায় অত্যন্ত সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালে তিনি বাংলাদশ সেনাবাহিনীর সৈনিক পদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে যান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ শিক্ষার খরচ চালানো তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিলো। কিন্তু অসীম সাহসিকতা, ভাই বোনের অনুপ্রেরণা, মায়ের দোয়ায় চরম সংগ্রাম করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই অর্থনৈতিক সচ্ছলতা অর্জন করে চরম দারিদ্র্যকে জয় করেন। তারপর ২০০৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পর মায়ের দোয়ায়, নিজের চেষ্টা ও সাধনায় ও মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে ৬ টি সরকারি চাকরি পেয়েছেন। ৬ টি সরকারি চাকরি হলো, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ জেল, সরকারি হাই স্কুল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ও ২৯তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার। অবশেষে তিনি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে চাকরি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। ২০১১ সালের ১ আগস্ট তিনি নোয়াখালী জেলায় অবস্থিত চৌমুহনী সরকারি এস এ কলেজের বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেছিলেন। সেখানে ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাকরি করেন। তারপর ২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তিনি বদলি ভিত্তিক পদায়ন নিয়ে নবীনগর সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেছিলেন। তারপর ২০১৪ সালের ২৭ মে থেকে ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে কর্মরত ছিলেন। ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর মাত্র ৫ বছরে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগে ১৬ নভেম্বর ২০১৬ সালে যোগদান করেছিলেন। সেখান থেকে তিনি ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন থেকে বৃত্তি পেয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে একজন বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন পেয়েছিলেন। তারপর ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তারপর ২০২১ সালের ১৩ এপ্রিল থেকে আবারও নবীনগর সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে যোগদান করেন।
পড়াশোনা ও চাকরির পাশাপাশি ড. এস এম মোজাম্মেল হোসেন ২০০৪ সাল থেকে সংগীত চর্চা করছেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ২০০৭ সালে ৩ বছর মেয়াদী লোকসংগীত ও ধ্রুপদী সংগীতের উপর ওস্তাদ বাবু রহমান এর নিকট তালিম নিয়ে সংগীত বিষয়ক কোর্স সফলভাবে সমাপ্ত করে সনদপত্র অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয় ২০১৩ সালে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা কর্তৃক আয়োজিত সংগীত প্রতিযোগিতায় লোক সংগীতে ২য় স্থান ও দেশাত্মবোধক গানে ৩য় স্থান অর্জন করেছেন। তাছাড়া ২০১৩ সালে তিনি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা কর্তৃক আয়োজিত ইংরেজি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সেরা ৩টি পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। পুরস্কারগুলো ছিলো- শ্রেষ্ঠ বক্তা, শ্রেষ্ঠ দলনেতা ও ইংরেজি বিতর্ক চ্যাম্পিয়ন।
২০২২ সালে নবীনগর সরকারি কলেজের প্রিয় সহকর্মীগণ তাঁকে ভালোবেসে শিক্ষক পরিষদের সম্মানিত যুগ্ম সম্পাদক পদে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। সম্প্রতি নবীনগর সরকারি কলেজের সুযোগ্য অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোঃ আব্দুস সোবহান মহোদয় তাঁর পেশাগত দক্ষতা ও গতিশীল নেতৃত্বে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর ১০ ময়নামতি ব্যাটালিয়নের প্রফেসর আন্ডার অফিসার হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সাথে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৪৬:০১ ● ১০২১ বার পঠিত