বৃহস্পতিবার ● ৮ ডিসেম্বর ২০২২
“হায়রে উড়ন্ত পাখীর জীবন” - অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগম
Home Page » সাহিত্য » “হায়রে উড়ন্ত পাখীর জীবন” - অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমও রবিনের মা —–
তোরে বলছি না — আর কাঁদবি না।
তুই জানিস না? তুই কাঁদলে আমি হাতে পায়ে জোড় পাই না। আমি কোন কাজ করতে পারি না। কাজ না করলে খাবে কি।।
–রবিনের বাবা তুমিই বলো। আমি কি করবো? রবিন একবারও ভাবলো না, সন্তানের প্রতি বাবা মা’র দায়িত্ব রয়েছে যেমন ।ঠিক তেমনি বাবা মা’র প্রতি মন্তানেরও দায়িত্ব আছে।
আমার তো বুক জ্বলে। মনরে বুঝাইতে পারি না। সারাক্ষণ ছেলে ও নাতির ছবি আমার চোখে ভাসতে থাকে।
—-তোর ছেলে কি তা বুঝে? ছেলে ছেলে করে তো মরে গেলি। আমার বুক জ্বলে না? বলতে বলতে সে ডুকরে কেঁদে বুক ভাসায়।
—-রবিনের বাবা, বলো তো বুক জ্বালার মলম কোথায় পাওয়া যায়? আমারে আইনা দাও না। না হয় বিষ খেয়ে মরে যাবো। সব জ্বালা মাটিতে মিশে যাবে।
—- তুমি কি পাগল হয়ে গেলি না কি।
দেখ না, পাশের বাড়ীর রাহাত আলীর অবস্থা। তাদের তো দুই ছেলে মেয়ে ছিলো।বিদেশে কি যে মজা,তারাই জানে।বাবার মস্ত বড় সম্পদ আছে, নিজেরাও ভালো চাকুরী করতো।কিন্তু না, দুই ভাই বোনই চলে গেলো বিদেশে।
বাবা মা কি আর করবে। তাদের চোখের সামনে সব অর্থ সম্পদ বিক্রি করে নিয়ে গেলো বিদেশে। বোবা নিথর পাথরের মতো থাকিয়ে থাকলো মাটির দিকে।
রাহাত আলী হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে সম্পদ সঞ্চয় করেছিলো, কি বিদেশে পাছার হওয়ার জন্য। ছেলে মেয়ের মুখের উপর একটা কথাও বলতে পারলো না। তারাই এখন সব ভালো বুঝে।দেশের মাটিতে নয় গ্লোবাল ভিলেজে শান্তি খোঁজে। পা ফেলে না মাটিতে,অত্যাধুনিক জীবন পছন্দ করে।
রাহাত আলী ও তার স্ত্রী তাদের সিদ্ধান্তে থাকলেন অনড়। ছেলে বা মেয়ে কারো সাথে বসবাস করতে যান নাই। ড্রাইভার, দারোয়ান,কাজের মানুষকে ঘিরে বেঁচে থাকলেন ।
খুব অসুস্থ্য হয়ে মা মারা গেলো। ভাই তার বোনকে পাঠিয়ে দিয়ে বললো — তুমি যাও মাকে বিদায় দিয়ে এসো।আমি বাবাকে বিদায় দিতে যাবো।
তোমার তো এক ছেলে, সে কি করবে।মরন কালে মুখ দেখতেও আসতে পারবে না। কাজের অজুহাত দেখিয়ে মুখ রাখবে ঘুরিয়ে। অথচ এই সন্তানের জন্য কত কিছুই না করেছি।হায় খোদা কাকে বলবো।
রবিনের মা বলে– ছয়তলা বাড়ি করার সময় ছেলেকে জিঞ্জেস করেছিলাম, কি রে বাবা, তুই কি বিদেশ টিদেশ চলে যাবি না কি।
সে খুব উচু গলায় বলেছিলো — আমি কি ফকির ফাকরা না কি। যে বিদেশ যেতে হবে, শরীরের রক্ত পানি করতে।
তা ছাড়া আমি তো ভালো চাকুরীও করছি।
মনে মনে খুব খুশী হয়েছিলাম।দো- হাত তুলে আল্লাহ্ র কাছে মন খুলে শুকরিয়া আদায় করেছিলাম। যাক, বাঁচা গেলো। সন্তানের খোঁজে আকাশে চোখ রেখে এয়ারপোর্টে ঘুরাঘুরি করতে হবে না।
বাংলাদেশের বহু মানুষ জমি জমা বাড়ি ঘর বিক্রি করে সন্তানকে পাঠিয়েছে দিচ্ছে বিদেশে । কেউ যায় পড়শোনা করতে, কেউ-বা চাকুরি করতে। একবার বিদেশের মাটিতে পা রাখলে, তারা আর দেশে ফিরতে চায় না।
তারা বিদেশী অর্থের যোগান দেয় পরিবারে ও জাতীয় অর্থনীতিতে।. তাদের বউ,বাচ্ছা, মা, বাবা তো সুখে শান্তিতেই থাকে। গ্রামের বাড়ীতে পাকা ঘর বানিয়ে শহরের সুবিধা ভোগ করে।কেউ কেউ আবার বিদেশের মাটিতেই স্থায়ী ঠিকানা গড়ে ফেলে।
শোন, আমাদের মত দরিদ্র দেশ থেকে বিরাট অংকের টাকা তুলে নিয়ে , বিদেশে গড়ছে ঝাড় জঙ্গলে বিলাশ বহুল কুড়ে ঘর।ওখানেই না কি পৃথিবীর সকল সুশীতল শান্তির ঠিকানা।
আমার দেশের কি যে ক্ষতি করছে ওরা, তা এক বারও ভেবে দেখছে না। আমাদের দেশে সুখ শান্তি নাই,কে বলছে? সুজলা সুফলা এমন দেশ কোথাও খোঁজে পাবে না।
ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা, সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি,আমার সোনার বাংলা,আমায় যেতে দে না ছোট্ট সোনার গাঁ, মাটির নীচে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা, রাত পোহালেই যদি শো যেতো বঙ্গবন্ধু মরে নাই আরো বহু প্রাণ প্রিয় গান, পংতি,উদ্ধৃতি বিদেশগামীদের মন সিক্ত করতে পারে নাই বলেই,দেশে প,তি দয়া মায়া নেই।পালিয়ে যাচ্ছে বিবেক বর্জিত হৃদয় নিয়ে।
অথচ এই মাটিকে ভালোবেসে ত্রিশলক্ষ মানুষ শহিদ হয়েছে একাত্তরে। প্রীতিলতা, সূর্যসেন, ক্ষুধিরাম, বঙ্গব্ধুর মত বহু ত্যাগী নেতার রক্তের ঋণে ধন্য হয়েছে এই দেশের মাটি।
বাংলাদেশে রয়েছে ষঢ়ঋতুর ঐতিহ্যবাহী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। মন ছোঁয়ে যায়,ভরিয়ে দেয় দু,চোখ সবুজ,শ্যামল কারুকার্যে। নদীর মাঝি ভাটিয়ালী গান গাইতে গাইতে হারিয়ে যায় কোন সুদুরে।, কলকাকলিতে ঘুম ভাংগে ভোরের পাখীর। সোনা রোদ ছড়িয়ে দিয়ে খুকুর দোখে খুশী বন্যা বয়ে দেয় সকালের কাঁচা সুর্য্য। কুয়াশার চাদর মাথায় দিয়ে কৃষি ভাই করে কাজ, কাশফুল দোলে দোল, আহা কি যে অপরুপ।
আমাদের দেশের বাবা মায়ের উচিৎ প্রত্যেক সন্তানকে শিশু বয়সে দেশ প্রেমের দীক্ষা দেয়া। দেশীয় শিল্প,সাহিত্য, সংস্কৃতি সর্ম্পকে সঠিক ধারনা মস্তিস্কে গেঁথে দেওয়া। মাটি ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বুকের গভীরে জন্ম দেয়া।
সরকারও তাদেরকে প্রতিরোধ করতে পারছে না। এরাই গড়ে তুলেছে বিদেশের মাটিতে বেগম পাড়া। অবৈধ পথে লুট হয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমানের অর্থ। কে তামাবে এই পাগল ছাগলদের।
ওদের মুখের যুক্তি তর্ক শোনে নিজেদের মাথাও গরম হয়ে যায়। কিন্তু এই বুড়ু বয়সে কি করবো। এক পা তো দিয়ে রেখেছি কবরে।
আমরা বোকা কানা মানুষ যারা,মাথায় রেখে হাত হায় আফসোস করছি। আগামী প্রজন্মের অবস্থাটা কি হবে। এর জন্যই কি একাত্তরে রক্ত ক্ষয়ী যুদ্ধ করে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্ম দিয়েছিলাম।
রবিনের মা হাতের উপর হাত,পায়ের উপর পা রেখে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। আর ভাবে, হায়রে রবিন, তোকে নাড়ীর রক্ত, বুকের দুধ দিয়ে রড় করেছিলাম এই কস্ট পাওয়ার জন্য।দম বন্ধ হয়ে আসে কেন ।অবুঝ মানুষের মত শুধু কাঁদতে ইচ্ছে করে। রবিনও কি কাঁদে?
চাকুরি,সন্তানের দেখভাল, সংসারের দৈনন্দিন কার্যাবলী — এক হাতেই সামলিয়েছি। ঘরে বাইরে সমান তালে রেখেছি পা। অসম্ভব শ্রম ঘাম ব্যয় করেই সাজিয়েছি সুখের ফুলদানি।
মরণকালে সন্তানের হাতের পানি পাবো না, এটাই কি ছিলো সাধনার গোল পোস্ট।
— ও রবিনের মা। তোমার পোলা রবিন কি বলে জান?
—– কি বলে?
—— পঞ্চাশ বছর পর বাংলাদেশ পানির নীচে তলিয়ে যাবে।এ দেশে জান মালের কোন নিরাপত্তা নাই। ভবিষ্যতে আরো
ভয়ঙ্কর দুর্যোগ দেখা দিবে। শ্রীলংকার মতো ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে যাবে দেশ। তখন মানুষ না খেয়ে মরবে।
— রাখো তো এসব ফালতু কথা। আমরা এতো বছর বাঁচুম না। যা হয় হবে।
— এই তো কথা কয়টা শেষ না করতেই আবার ভেদ ভেদ করে কান্না জুড়ে দিলে।কাঁদতে কাঁদতেই মরবি। আমাকে সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে যাবি।
– কি করবো বলো মনেরে তো মানাতে পারি না। রাতে দু’চোখ বন্ধ করতে পারি না।মোবাইলটা কানের কাছে রেখে ঘুমাই।অপেক্ষায় থাকি, এই বুঝি রবিন কল করলো।
— ও রবিনের মা , শোন।পাশের বাসার রাহাত আলী মারা গেছে তার গ্রামের বাড়ীতে।ওখানেই তারে দাফন করা হয়েছে।
– উনার ছেলে আসলো না?
— ওদের তো ভীষণ কর্মব্যস্ত জীবন। বাবাকে দেখার সময় কই? তা ছাড়া রাহাত আলী মৃত্যুর পূর্বে বলেছিলো, তার লাশ যেন প্রিজে ঢোকিয়ে ছেলের জন্য অপেক্ষা না করে।
— তার টাকা পয়সা, বাড়ী ঘরের কি হলো।
— রাহাত আলী তার বড় ভাইয়ের নামে লিখে দিয়ে গিয়েছে।
হায়রে উড়ন্ত পাখীর জীবন। গ্রাম ছেড়ে শহরে।হীম শীতল ঘরে কত সান সৌকতের আয়োজন।তুলতুলে নরম বিছানা, বাহারী ডিজাইনের খাট,সোফা, আয়েশের ক্লান্তি নেই। ঘরের ভিতরে দিনে রাইতে জোনাকের বাতি জ্বলে।সুইচ দিপ দিলেই সুগন্ধি খাবার চলে আসে নাকের ডগায়। সুখের ছায়া করে পায়ের নীচে গড়াগড়ি।
এর পর সব রেখে চলে যেতে হয় অচিন গন্তব্যে। যেখানে নাই পুর্ব পুরুষের পায়ের চিহ্ন।
হায়রে উড়ন্ত পাখির জীবন। এই জীবনের জন্য মানুষ কেন এতো হন্যে হয়ে পেরেশানী হয়।
লেখক: সহ সভাপতি,বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ। ০১৭১৭৭৬২৭৪৫
বাংলাদেশ সময়: ২:৫৪:২৯ ● ৪৮৭ বার পঠিত