বঙ্গ নিউজ ডটকমঃনিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তাগাদা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।রোববার সকালে সচিবালয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন, “শহরের পাশে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের আবাসন প্রয়োজন। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে সে উদ্যোগ নিতে হবে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বড়লোকদের জন্য ফ্লাট বানালেই হয়? গরীব মানুষের জন্যও আবাসন প্রয়োজন।
“বস্তিতে যে শ্রমজীবী মানুষ থাকে- তারাই তো আসল শ্রমজীবী। তাদের তো সুস্থভাবে থাকার ব্যবস্থা আমরা করে দিতে পারি।”
নিম্ন আয়ের মানুষের ‘দুর্ভোগে’ অসন্তোষ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “যারা বড় লোক তারা বড় লোক হচ্ছে তো হচ্ছেই। রাজা-রাজরানা হচ্ছেন। আর, তাদের পাশের নিম্নআয়ের মানুষগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছে। তা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।”
শ্রমিকদের কল্যাণে গঠিত এই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের লক্ষ্যই শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়ন। তাদের জন্যই আমরা সকলে আরাম-আয়েশে জীবন-যাপন করছি।”
আরো বেশি শিল্প-কল-কারখানা স্থাপনের উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
রপ্তানী প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে ট্রেড ইউনিয়ন চালুর প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “বিদেশিরা তো ট্রেড ইউনিয়নের নাম শুনলেই ভয় পেয়ে যায়।”
ট্রেড ইউনিয়নের আদলেই ‘লেবার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ করা হয়েছে উল্লেখ করে তা বিধিমালা আকারে শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে নির্দেশ দেন সরকার প্রধান।
যারা অল্প সময়ে অধিক সম্পদের মালিক হতে বিদেশে যাওয়ার নামে প্রতারিত হচ্ছেন তাদের জন্য আরো সচেতনতা সৃষ্টির তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “অনেকে মনে করে, প্লেনে বসতে পারলেই যেন স্বর্গে চলে যাবো। বাইরে যেয়ে হঠাৎ বড়লোক হওয়ার প্রবণতা তাদের তাড়িত করে। এজন্য সচেতনতা দরকার।”
গৃহশ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি জানি, অনেকে বাইরে নারী মুক্তির কথা বলেন। আর, ঘরে গিয়ে মেইড সার্ভেন্টকে পেটায়।”
শ্রমিক হিসাবে গৃহকর্মীদের সুরক্ষা নীতিমালা করারও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। গৃহকর্মীরা কী কী সুবিধা পাবে এবং কতো ঘণ্টা কাজ করবে তা নীতিমালাতে থাকবে।
শ্রমিদের প্রশিক্ষণের ওপর আরো গুরত্ব দেয়ার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “শিশুরা যেন ঝুকিপূর্ণ কাজ না করে।”
১৪টি জেলায় প্রায় ৫০ হাজার শিশুকে দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “অনেক ট্রাডিশনাল কাজ আছে। যেমন, তামা-কাশা বা তাঁতের কাজ। এই ধরনের পারিবারিক কাজে ছোটবেলা থেকে ট্রেনিং না নিলে হয় না।”
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০১৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন শেষ হলে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা আশা করি, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ২০২১ সালের মধ্যে মাথাপিছু গড় আয় বর্তমানের ১ হাজার ৪৪ ডলার থেকে বেড়ে দেড় হাজার ডলারে উন্নীত হবে।
“প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ১০ শতাংশে উন্নীত হবে এবং দারিদ্র্যের হার বর্তমান ২৬ শতাংশ থেকে কমে হবে ১৩ শতাংশ হবে।”
শ্রমসংশ্লিষ্ট আইনগুলো বাস্তবায়ন, শ্রম আদালতের মাধমে শ্রমক্ষেত্রে সুবিচার নিশ্চিত করা এবং শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নসহ তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
২০১০ সালে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বেতন ৮২ শতাংশ বাড়িয়ে ১৬৬২ টাকা থেকে ৩০২৪ টাকা করা হয়। ২০১৩ সালে আবার ৭৭ শতাংশ বাড়িয়ে ন্যূনতম মজুরি ৫৩০০ টাকা নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বেতন দুদফায় বাড়ার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, কোনো উন্নত দেশে শ্রমিকদের বেতন দুই দফায় ২২৯ ভাগ বাড়ানো হয় নাই।”
শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “দেশের চারটি শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়তনের মাধ্যমে শ্রমিক, শ্রমিক নেতৃবৃন্দ, মালিক প্রতিনিধি ও শ্রম সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিনিধিদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।”
রপ্তানিপণ্যের গুণগত মান এবং উৎপাদনক্ষেত্র ও কর্মপরিবেশ বিশ্বমানের পর্যায়ে উন্নীত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সহযোগিতায় ‘বেটার ওয়ার্ক’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, সরকার শ্রমিক-মালিক আইনগত সম্পর্ক সহায়তা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ১২টি নতুন আইন ও নীতি প্রণয়ন এবং বিদ্যমান আইন সংশোধন ও অনুমোদন করেছে।
শ্রমিকদের উন্নয়নে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে মোট ৩০টি শ্রম কল্যাণকেন্দ্র সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এসব কেন্দ্রের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ, বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ সরবরাহ, প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সেবা, পরিবার কল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে পরামর্শ ও উপকরণ সরবরাহ, খেলাধুলা ইত্যাদি সেবা দেয়া হচ্ছে।
দেশের ১৬৫টি চা বাগানে কর্মরত কর্মচারী ও শ্রমিকদের কল্যাণে শ্রম অধিদপ্তরের অধীনে চা-শিল্প শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে মালিক ও শ্রমিকদের ‘চাঁদা’ ও লভ্যাংশ মিলিয়ে এ তহবিল প্রায় ২০৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। উপকারভোগীর সংখ্যাও লাখ ছাড়িয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের কল্যাণে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে ফাউন্ডেশনের তহবিলে প্রায় ছয় কোটি টাকা জমা আছে।
এছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য একটি গ্রুপবীমা স্কিম চালু করা হয়েছে, যার ৬৬ শতাংশ অর্থ কল্যাণ তহবিল থেকে দেয়া হচ্ছে।
মতবিনিময় অনুষ্ঠানে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু, সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মুখ্য সচিব আব্দুস সোবহান শিকদার, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব আবুল কালাম আজাদ, শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব আবুল কালাম আজাদসহ ওই মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:০১:৫৩ ৩৩৪ বার পঠিত