বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ মামলার তদন্তে গুরুত্ব দিতে প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ও করা হয়েছে।সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের দু’বছর পেরোচ্ছে। গণ্ডি ছাড়িয়ে ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য আলামত পাঠানো হয়েছে সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। পাশাপাশি তথ্য-প্রযুক্তি আর ম্যানুয়ালি তদন্ত চলছে দেশে। সন্দেহভাজন হিসেবে শতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে সাংবাদিক দম্পতির পারিবারিক বন্ধু তানভীর এবং দুই নিরাপত্তাকর্মী এনামুল ও পলাশ রুদ্র পালকে। এছাড়া এ মামলায় আরও পাঁচ ডাকাতকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।তদন্ত সংস্থা র্যাবগতকাল পর্যন্ত সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কোন রহস্য বা খুনিদের শনাক্ত করতে পারেনি র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, গুরুত্ব দিয়ে মামলার তদন্ত চলছে।২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারির ভোরে পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বাদি হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। প্রথমে মামলাটি তদন্ত করে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। চার দিনের মাথায় মামলাটি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়। তদন্তের ৬২ দিনের মাথায় উচ্চ আদলতে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। পরে উচ্চ আদালতের এক নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ই এপ্রিল মামলাটি র্যাবে হস্তান্তর করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ৭৬ দিনের মাথায় ওই বছরের ২৬ এপ্রিল পুনঃময়নাতদন্তের জন্য সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে উত্তোলন করা হয়। এসময় তদন্ত সংস্থা র্যাব আরও কিছু আলামতসহ লাশের ভিসেরা নমুনা সংগ্রহ করে। এছাড়া একই বছর ১২ই জুন মাসে ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাগারে আলামত পাঠানো হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রথম দফায় কিছু প্রতিবেদন হাতে পেয়েছেন। তবে এখন পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার অপেক্ষা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
র্যাবের ভরসা ডিএনএ প্রোফাইলিং, আশা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা: বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে শেষ ভরসা এখন ডিএনএ প্রোফাইলিং। কিন্তু ডিএনএ প্রোফাইলিং শেষে এ মামলার রহস্য উদ্ঘাটন হবে কিনা তা-ও সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। যেই পথে আশার আলো দেখা যাবে সে পথ ধরেই সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। র্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ১২ই জুন ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাগারে কিছু আলামত পাঠানো হয়। ওই গবেষণাগারটি এ ধরনের আলামত থেকে ডিএনএ নমুনা বের করার ক্ষেত্রে সুনাম অর্জনকারী। শুধুই আশার বাণী: সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে শুধুই আশার বাণী শুনিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ঘটনার পরপরই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন। এরপর ঘটনার তিন দিনের মাথায় পুলিশ সদর দপ্তরে আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার এক সংবাদ সম্মেলনে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন। এছাড়া কয়েক দিনের মাথায় ডিএমপির মুখপাত্র মনিরুল ইসলামও হত্যাকাণ্ডের ‘মোটিভ’ নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে মন্তব্য করেন। তদন্ত সংস্থা ডিবি গ্রিল কাটা চোরদের দিকে ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা ও ‘জজমিয়া’ সাজানোর বিষয়টি উঠে এলে ডিবি পরে বিষয়টি এড়িয়ে যায়। এছাড়া র্যাবের কাছে তদন্ত হস্তান্তরের পর ২০১২ সালের ৯ই অক্টোবর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাগর-রুনি হত্যা ঘটনায় ৭ জনকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা দেন। এর মধ্যে পাঁচ জন রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণকে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র রায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ওই বছর আগস্ট মাসে গ্রেপ্তার করে ডিবি ও র্যাব। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো ছাড়াও সাগর-রুনির পারিবারিক বন্ধু তানভীর ও বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পালকেও গ্রেপ্তার দেখানো হয়। কিন্তু দফায় দফায় তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি তদন্ত সংস্থা র্যাব। পরে তদন্ত সংশ্লিষ্ট র্যাব কর্মকর্তারা জানান, পলাতক থাকা আরেক দারোয়ান হুমায়ুন কবীর ওরফে এনামুলকে ধরতে পারলে সব রহস্যের সমাধান হবে। এনামুলকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ১০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু রহস্যঘেরা সে নিরাপত্তাকর্মী হুমায়ুন কবীর ওরফে এনামুলকে গ্রেপ্তার করা হলেও মামলার রহস্যজট খোলেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের বাইরে কার্যত এ মামলার তদন্ত একরকম থমকে আছে। মামলার রহস্য উদ্ঘাটন না হওয়ায় হতাশ তদন্ত সংশ্লিষ্টরাও। একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের তদন্তের রহস্য উদ্ঘাটন না হওয়ায় তারা একরকম বিপাকে রয়েছেন। এক্ষেত্রে তারা অভিযোগ করছেন, ঘটনার ৬২ দিনের মাথায় তারা তদন্তভার পেয়েছেন। কিন্তু আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের পর সংশ্লিষ্টরা সঠিকভাবে আলামত রক্ষা করতে পারেনি। একারণে তদন্ত করতে গিয়ে তাদের বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার জাফর আহমেদ জানান, হত্যাকারীদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করতে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি। সব রকমের চেষ্টাই করা হচ্ছে।
হতাশ পরিবারের সদস্যরা: দু’বছরেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কোনো কূল কিনারা না হওয়ায় হতাশ হয়েছেন নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। তারা এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন, খুনিদের সনাক্ত কিংবা গ্রেপ্তারের আর কোনও সম্ভাবনাই দেখছেন না। মামলার বাদী ও নিহত মেহেরুন রুনির ছোট ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, দু’বছরেও যে মামলার তদন্তে ফলাফল শূন্য সেই মামলা নিয়ে আশা করার কিছু নেই। আমরা সবাই হতাশ। এত বড় একটি ঘটনা, পুলিশ-র্যাব এর কোনও কূল-কিনারাই করতে পারলো না। নওশের আলম রোমান বলেন, ঘটনার পর থেকে প্রথমে পুলিশ ও পরে র্যাব সদস্যরা শুধু আশার বাণী শুনিয়েছেন কিন্তু আশার আলো দেখাতে পারেননি। তিনি বলেন, এখন মামলার তদন্তসংশ্লিষ্টরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগও করেন না। তিনি নিজে মাঝে মধ্যে খোঁজখবর নিতে যোগাযোগ করলে ‘চেষ্টা করা হচ্ছে’ বলেন। দু’বছরেও মেয়ে ও মেয়ে জামাই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন না হওয়ায় একরকম শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন রুনির মা নুরুন্নাহার মির্জা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, পুলিশ-র্যাব কি করছে তারাই জানে। আমাদের শুধু আশা দিয়া রাখছে। কিন্তু আর কতদিন আমরা আশা নিয়া থাকবো। তিনি বলেন, মৃত্যুর আগে যদি রুনি ও সাগরের হত্যাকারীদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে শুনতে পারতাম, তাহলেও মরেও শান্তি পেতাম। নিহত সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির বলেন, আশায় থাকতে থাকতে আমরা সবাই হতাশ হয়ে গেছি। সরকারের কাছে দাবি, তারা যেন সাগর-রুনির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬:৫৭:২২ ৩৪৮ বার পঠিত