বঙ্গ-নিউজডটকম:হলমার্কের ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত অন্তত ৩৭টি কোম্পানির অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি সোনালী ব্যাংক। কমিশনের বিনিময়ে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে কোম্পানিগুলো অর্থ হাতিয়ে নিতে সুতা বা কাপড় সরবরাহ দেখিয়েছিল। এভাবে প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
সরকারি ও বেসরকারি ৩৭টি ব্যাংকের ১০০ শাখার মাধ্যমে এই অস্তিত্বহীন কোম্পানিগুলো সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখায় হল-মার্কের ঋণপত্রের বিপরীতে সুতা বা কাপড় সরবরাহকারী হিসেবে কাগজপত্র তৈরি করেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকও অনুসন্ধান করে বেশ কিছু ভুয়া কোম্পানির নাম খুঁজে পায়। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) কয়েকজন মালিককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনেছে, হল-মার্কের সঙ্গে লেনদেনের ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ বের করে আনলে তাঁরা কিছু কমিশন পেতেন। কোনো সুতা তাঁরা সরবরাহ করেননি।
এত কিছুর পরও এসব ভুয়া কোম্পানির নামে বিভিন্ন ব্যাংকে খোলা এলসির (ঋণপত্র) বিপরীতে স্বীকৃত বিলের অর্থ পরিশোধের জন্য সোনালী ব্যাংকের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে। প্রভাবশালী একটি চক্র ইতিমধ্যেই দুদকের কাছ থেকে একধরনের ছাড়পত্রও নিয়েছে। এখন চেষ্টা চলছে অর্থ বের করে নেওয়ার।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সোনালী ব্যাংক এখন যাচাই-বাছাই করে সঠিক লেনদেনের মূল্য পরিশোধ করবে। কোনো অস্তিত্বহীন কোম্পানির অর্থ পরিশোধের কথা তাদের বলা হয়নি।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা এই হল-মার্ক কেলেঙ্কারি। অখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানটি সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (ভূতপূর্ব ঢাকা শেরাটন হোটেল) শাখা থেকে কারসাজি করে বের করে নেয় দুই হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। এই অর্থের মধ্যে প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকা এলসি বা নন-ফান্ডেড ঋণ। মূলত এই অর্থ নিয়েই ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের মতবিরোধ।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রদীপ কুমার দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব বিলে গুরুতর বিতর্ক আছে, সেগুলো আমরা পরিশোধ করব না। কিন্তু যেগুলোতে বিতর্ক নেই, সেগুলোর বিষয়ে পরিচালনা পর্ষদের মতামত নিয়ে তা নিষ্পত্তি করা হবে।’
হল-মার্কের দেওয়া ঋণপত্রে যেসব কোম্পানি অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করেছে, তার মধ্যে ৩৮টি কোম্পানি চালু পেয়েছে সোনালী ব্যাংক। ২১ কোম্পানির সরবরাহ নিয়ে কিছু ক্ষেত্রে সংশয় ও সন্দেহ রয়েছে। আর এর বাইরে ৩৭টি কোম্পানির অস্তিত্বই খুঁজে পায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন: সোনালী ব্যাংক কোম্পানির অস্তিত্ব খুঁজতে মাঠপর্যায়ে গেলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধান কাজ ছিল মূলত ব্যাংককেন্দ্রিক। ২০১২-এর শেষভাগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০টি পরিদর্শক দল ৩৭ ব্যাংকের ১০০ শাখায় পরিদর্শন চালায়।
এর একটি দল যায় ইউসিবিএলের এলিফ্যান্ট রোড শাখায়। সেখানে রওনক টেক্সটাইল মিলের সুতা সরবরাহ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইয়ার্ন উৎপাদনে কোনো যন্ত্রপাতি কোম্পানির নেই। ইয়ার্ন প্রতিষ্ঠানটির কাঁচামাল, প্রস্তুতকৃত পণ্য নয়। অথচ সবগুলো এলসি/বিল ক্রয় ইয়ার্ন সরবরাহসংক্রান্ত।
আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক শ্যামলী শাখার গ্রাহক তানিয়া এন্টারপ্রাইজ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির নামে শাখায় ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি চলতি হিসাব খোলা হলেও এর অনুকূলে সোনালী ব্যাংকের এলসি খোলা হয়েছে ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর। অর্থাৎ কেবল বিল ক্রয়ের জন্যই হিসাবটি খোলা হয়েছে। স্থানীয় বিল ক্রয়ের মাধ্যমে জমা করা অর্থের উত্তোলন ছাড়া হিসাবটিতে আর কোনো লেনদেনই হয়নি। এতে বোঝা যায়, কেবল ভুয়া বিলের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই হিসাবটি খোলা হয়েছে।
জনতা ব্যাংক রমনা করপোরেট শাখায় অনন্ত কটন ইয়ার্ন, ব্রডওয়ে স্পিনিং, মাস্টার কটন ইয়ার্ন, সাউথ কম্পোজিট, সিনথেটিক ইয়ার্ন ও রাঙ্কা সোহেল কম্পোজিট টেক্সটাইলের রপ্তানি বিলগুলো পর্যালোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিল ক্রয়ের পর বিলের অর্থ কোম্পানিগুলোর চলতি হিসাবে জমার দিনেই তা চেকের মাধ্যমে নগদ উত্তোলন হয়েছে। দেখা গেছে, সোনালী ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
দুদকে জবানবন্দী: খান রোটন স্পিনিং মিলসের স্বত্বাধিকারী সাইফুল আলম খান দুদকের শুনানিতে অংশ নিয়ে লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘নয়নতারা ট্রান্সপোর্ট নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। রোটন স্পিনিংয়ের মাধ্যমে ৩০ কাউন্টের সুতা উৎপাদন হয় না। আমি কোনো সুতা হল-মার্ক গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করি নাই। শুধুমাত্র কেজিপ্রতি পাঁচ টাকা কমিশনের মাধ্যমে এলসির বিপরীতে বিল তৈরি করে সম্মতিপত্রের বিপরীতে আইবিপি ঋণ গ্রহণ করি। এই ঋণের অর্থ আমার ব্যাংকের চলতি হিসাবে জমা হওয়ার পর আমার কমিশনের টাকা রেখে অবশিষ্ট টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখায় হল-মার্ক গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা প্রদান করি।’
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের বংশাল ও ধানমন্ডি শাখা, অগ্রণী ব্যাংকের গ্রিন রোড শাখা, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক নারায়ণগঞ্জ শাখার গ্রাহক সমতা টেক্সটাইল অ্যান্ড স্পিনিং ও সমতা ইয়ার্ন টেডিং। প্রতিষ্ঠান দুটির ব্যবস্থাপনা অংশীদার মো. সেলিম মোর্শেদ দুদককে লিখিতভাবে বলেছেন, ‘বিলগুলোর বিপরীতে আমরা কোনো সুতা সরবরাহ করি নাই। প্রতি ডলারে ৭৫ পয়সা কমিশন রেখে অবশিষ্ট টাকা চেক, পে-অর্ডার ও নগদে ব্রোকারের (দালাল) মাধ্যমে পরিশোধ করি।’ সমতার আরেক অংশীদার হেলালউদ্দিন একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন দুদককে।
বাংলাদেশ সময়: ৯:৫৬:২৩ ৪৬৭ বার পঠিত