তমালঃ বঙ্গ-নিউজডটকমঃ আর পশ্চিমবঙ্গের সীমানার মধ্যে আটকে থাকা নয়। এ বার লোকসভা নির্বাচনে দলের প্রার্থীদের হয়ে অন্যান্য রাজ্যেও প্রচার করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর আগের লোকসভা নির্বাচনে অথবা সদ্যসমাপ্ত পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কিন্তু এই ভূমিকায় দেখা যায়নি তৃণমূল নেত্রীকে।
কেন এই পরিকল্পনা?
তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, গত আড়াই বছরে পশ্চিমবঙ্গে মমতা দলের জেলাওয়াড়ি সংগঠনকে সুসংহত করেছেন। বিরোধী থেকে শাসকের আসনে বসার পরে স্বভাবতই বেশ কিছু রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে মমতা এবং তাঁর দলকে। সে সব সামলে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের মাধ্যমে কখনও উত্তর-পূর্বাঞ্চল, কখনও উত্তরপ্রদেশে ভোটে লড়ার অল্পবিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষা হলেও এ নিয়ে কখনও সার্বিক কোনও পরিকল্পনা তৈরি করা হয়নি।
তা হলে এ বার কেন? ওই নেতার ব্যাখ্যা, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন সম্পর্কে তৃণমূলের নিজস্ব বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই ভিন্ রাজ্যেও দলকে ভোটে নামানোর কথা ভাবা হয়েছে। তৃণমূলের বিশ্লেষণ, প্রথমত, কংগ্রেসের পক্ষে একশো আসন পাওয়াই বেশ কঠিন। আবার নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির পক্ষে দেড়শো আসন পাওয়াটাও খুব সহজ কাজ নয়। বিশেষত, যখন দেশের দক্ষিণ, পূর্ব এবং পূর্বাঞ্চলের তিনটি এলাকা মিলিয়ে (কর্নাটক এবং বিহার বাদে) প্রায় দু’শো আসনে বিজেপির উপস্থিতি নেই বললেই চলে। দ্বিতীয়ত, রাজ্যের ৪২টি আসনের জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না করলে গত বারের তুলনায় আরও ভাল ফল করা যাবে বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি অন্যত্রও লড়াই করে আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসন কুড়োনোই আপাতত লক্ষ্য তৃণমূলের। তৃতীয়ত, তৃণমূল সেই লক্ষ্যে পৌঁছলে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নির্ধারক শক্তি হয়ে উঠবেন মমতা। ওই নেতা বলেন, “যে কারণে গত শনিবার রাঁচির জনসভায় মুকুলবাবু তৃণমূল নেত্রীই প্রধানমন্ত্রী হবেন এমন কথা না বললেও তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা মমতাই ঠিক করবেন।”
এই পরিস্থিতিতে তাই সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে নজর দিচ্ছে তৃণমূল। রাজ্যওয়াড়ি হোমওয়ার্ক করার জন্য মুকুলবাবু সম্প্রতি মথুরা, কোচি, আগরতলা এবং রাঁচিতে জনসভা করেছেন। লোকসভা নির্বাচনে ত্রিপুরা তো বটেই (সেখানে দু’টি), কেরল এবং তামিলনাড়ুতেও প্রার্থী দেওয়ার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে তৃণমূলে। তা ছাড়া পরিকল্পনা রয়েছে, দিল্লির সাতটি আসনের মধ্যে কয়েকটি আসনে প্রার্থী দেবে তৃণমূল। সে সংখ্যা অবশ্য এখনও চূড়ান্ত নয়। প্রার্থী দেওয়া হবে হরিয়ানাতেও। খুব শীঘ্রই এই দুই রাজ্যের যে কোনও একটিতে তৃণমূলের সর্বভারতীয় কনভেনশন করার সিদ্ধান্তও হতে চলেছে বলে দলীয় সূত্রের খবর।
দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের সাফল্যে ভর করে লোকসভা ভোটে হরিয়ানা ও দিল্লিতে তো বটেই, আরও কয়েকটি রাজ্যে প্রার্থী দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি (আপ)। আপ-এর পক্ষে একটা হাওয়াও তৈরি হয়েছে বিভিন্ন রাজ্যে। তৃণমূলের পরিকল্পনা হল, এই সব এলাকায় পাল্টা প্রচার চালিয়ে বলা, একমাত্র তৃণমূলই আপ-এর দর্শন সফল ভাবে রূপায়ণ করেছে। মুকুলবাবুর কথায়, “সাধারণ মানুষ বুঝবেন যে, মমতা ধূমকেতুর মতো রাজনীতিতে এসে হঠাৎ আমজনতার কথা বলতে শুরু করেননি। এক দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে ধাপে ধাপে সংসদ সদস্য, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন।” তৃণমূল মনে করছে, এত দিন পশ্চিমবঙ্গের বাইরে তারা চেষ্টা করেনি, তাই সাধারণ মানুষ তাদের কথা জানতেন না। আপ-এর আকস্মিক উত্থান তাদের সুযোগ এনে দিয়েছে, সাধারণ মানুষের কাছে তুলনাটা তুলে ধরার। দলীয় সূত্রের খবর, অণ্ণা হজারে নির্বাচনের সময় তৃণমূলকে সমর্থন করার ইচ্ছা প্রকাশ করে বার্তা পাঠিয়েছেন।
নির্বাচন কমিশন ফেব্রুয়ারির শেষে ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করলে পশ্চিমবঙ্গে এপ্রিলের আগে ভোট করা কঠিন। কমিশন সূত্র বলছে, এপ্রিলের গোড়ায় মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে তার পর চারটি পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে ভোট হবে। মনমোহন সিংহ সরকারের তরফে এক বার কমিশনের সঙ্গে কথা হয়েছিল মার্চ মাসে ভোট করার। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এবং আরও কয়েকটি রাজ্যে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা থাকায় কমিশন তাতে সম্মত হয়নি। ফেব্রুয়ারিতে বিজ্ঞপ্তি ঘোষণার ৪৮ দিন পরে ভোটপর্ব শুরু হবে। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে ভোট শুরু হবে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে। এ রকম একটি নির্ঘণ্ট হলে মমতা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও অন্য রাজ্যে প্রচারে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। যদি কোনও কারণে হাতে সময় কম থাকে, তা হলে অন্য রাজ্যে প্রচারে যাওয়ার জন্য মমতা হেলিকপ্টার বা বিমানে চড়বেন।
আলোচনা চলছে জোট গঠন নিয়েও। লোকসভা নির্বাচনের আগে তো বটেই, পরেও বিজেপির সঙ্গে দল কোনও ভাবেই জোট করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে তৃণমূলের একটি সূত্র। এমনকী বাইরে থেকে সমর্থন করাও সম্ভব নয় বলেই জানিয়েছে ওই সূত্রটি। অসম গণ পরিষদ (অগপ) কংগ্রেস-বিরোধী হলেও তারা বিজেপির সঙ্গে যেতে নারাজ। অগপ-র সঙ্গে তৃণমূলের একটি বোঝাপড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত জোট নিয়ে কোনও প্রস্তাব আসেনি তৃণমূলের কাছে। তবে এ প্রসঙ্গে দলের বক্তব্য, গত বার কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করায় ১৪টি আসন ছাড়তে হয়েছিল। এ বার যে হেতু একা লড়ে ওই আসনগুলিতে দলের জয়ের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তাই ভোটের আগে জোট করার ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে তৃণমূল নেতৃত্বের। কারণ দল মনে করে, একা লড়লে গত বারের চেয়ে বেশি আসনে জিতবে তৃণমূল। সব মিলিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট। আগামী নির্বাচনে দেশ জুড়ে এক নতুন ভূমিকায় নামতে চলেছেন মমতা।
বাংলাদেশ সময়: ৯:১২:৪৯ ৪০৭ বার পঠিত