ইতালির বন্দর শহর থেকে ফ্রান্সে আসা এ্যানেটা জিয়ভানানা মিলার্ড নামের মেয়েটি, ক্যাফেতে গান করে লাইন র্মাসা নামে। অভাব অনটনের মাঝে দানা বাঁধে ভালোবাসা, ফরাসি যুবক লুইস আলফানস জেসয়নরের সাথে। পথে পথে আ্যক্রোব্যটের নানান কৌশল কসরত করে জীবিকা নির্বাহ করে তরুণ। জীবনের চাওয়া পাওয়ার মাঝে ভালোলাগা এসে যায় নিয়তির হাত ধরে। দুটি তরুণ তরুণি ভাসে জীবন উচ্ছাসে। জন্ম নেয় তাদের একটি মেয়ে ১৯১৫র ১৯ ডিসেম্বর, ফ্রান্সের নিম্নবিত্ত হতদরিদ্র অবস্থায় বলা যায় পথেই জন্ম নিল তাদের মেয়ে ভালোবাসার জোয়ারে।এডিথ কাভেল ব্রিটিস র্নাস। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে ফ্রান্স সৈন্যদের জার্মান বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করার জন্য তাকে মৃত্যদণ্ড দেয়া হয়। বিশ বছর পরে ফরাসি বাবা আর ইতালিয়ান মা এর মিলনে এই সদ্য ভূমিষ্ট মেয়েটির নাম তার সাথে মিলিয়ে রাখা হয়, এডিথ জুবানা গেসোন।
হা দারিদ্র অবস্থায় ফ্রান্সের রাস্তায় জন্ম নেয়া এডিথকে ছেড়ে চলে যায় তার মা। এডিথ বড় হতে থাকে নানীর কাছে প্রকৃতির নিয়মে। বাধ্যগত ভাবে সে সময় যুবকদের সেনাবাহীনিতে যোগ দিতে হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফ্রান্স সৈন্যবাহিনীতে কাজ করার জন্য তার বাবাকে মনোনীত করা হলে, নানীর কছে থেকে এডিথকে নিয়ে এসে তার বাবা গনিকালয়ে একজন পতিতার কাছে রেখে যায়। তিন বছর থেকে সাত বছর পর্যন্ত পতিতালয়ে পতিতার মাতৃস্নেহে বড় হতে থাকে এডিথ। তিন বছর বয়সে ওর চোখের দৃষ্টি হারিয়ে যায়। নানা চিকিৎসার সাথে প্রথাগত বিশ্বাস অনুযায়ী টাকা দেয়া হয় দেবালয়ে, তীর্থযাত্রায়। আর আলৌকিক ভাবে যেন দৃষ্টি ফিরে পায় ছোট্ট এডিথ সাত বছর বয়স পর্যন্ত অন্ধ থাকার পর।।
পতিতার ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকা এডিথকে বাবা নিয়ে যায় তার আ্যাক্রব্যাট দলে সেনাবাহিনী থেকে ফিরে। চৌদ্দ বছর বয়সে সারা ফ্রান্সের পথে পথে খেলা দেখিয়ে জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত দেখে বড় হতে থাকে এডিথ।
এ সময় সিমন মোমেনে নামের যে মেয়েটির সাথে চলার পথে তার ভাব হয় সে এডিথের সৎবোন। দুজনে মিলে প্রথম গান করে রাস্তায় টাকা রোজগারের ধান্ধায়।
পনের বছর বয়সে এডিথ প্রথম রাস্তায় জনসম্মুখে গান করে। আর সব কিছু ছাপিয়ে গানটাই তার ভালোলাগে। গানের সাথে মিশে যায় মন, শরীর আর আবেগ। কিন্তু গান শেখা বা জানার সুযোগ হয়নি। এ যেন হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত স্রোতেরধারা। যত না গানের জন্য গান করা তার চেয়ে বেশী বেঁচে থাকার জন্য গান করা। এডিথ টাকা রোজগারের প্রয়াসে গান করে।
বাবার আ্যক্রব্যাট দল ছেড়ে দু বোন মিলে গ্যান্ড হোটেলের একটা ছোট্ট ঘরে বসবাস করতে শুরু করে। নিজের উপার্জন নিজের জীবন আর নিষ্ঠুর জগতে বেঁচে থাকার তাগিতে গান করে। এসময়ে এডিথ প্রেমে পরে যায় লুই ডিউপনের। কিছু দিনের মধ্যে লুই উঠে আসে তাদের ছোট্ট ঘরে। সিমন মোমেনে আর লুই একে অপরের চক্ষুশূল। ত্রয়ী সমস্যা জমজাট অবস্থায় জীবন বয়ে চলে। লুই কিছুতে মেনে নিতে পারে না এডিথের রাস্তায় রাস্তায় গান করে বেড়ানো। এডিথ প্রাণ পায় না অন্য কোন কাজে। তবু বাধ্য হয়ে যেখানে ওর প্রাণের সারা নাই লুইয়ের খুঁজে দেয়া কারখানার কাজে, লেগে থাকে কিছুদিন যখন ও গর্ভবতি হয়ে পরে । মাত্র সতের বছর বয়সে মেয়ে মার্সার জন্ম দেয় এডিথ। নীজের জীবনের একই পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে। লুইর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়। অনভিজ্ঞ মাতৃত্ব দারিদ্রতার প্রান্তে দাঁড়িয়ে পথে গান গাইতে নামতে হয় আবার। ক্লাবে শহরতলীর এখানে সেখানে যখন দুবোন মিলে গান গেয়ে বেড়ায়। বাচ্চাটিকে দেখার তখন কেউ নেই ঘরে। দু বছর বয়সে এডিথের মেয়েটি মারা যায় একা ঘরে মেনেনজাইটিস এবং দেখাশোনার অবহেলায়।
পিগলের পথ মধুর সুরে ঝংকৃত করা এডিথকে নাইট ক্লাবের মালিক লুইস লিপলে আবিষ্কার করে সুযোগ করে দেয় সুধীজনের মাঝে গান করার। অসম্ভব র্নাভাস এডিথ আরো ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যায় তার ছোটখাট আকৃতির জন্য। লুইস লিপলে তাকে সব রকম সহায়তা করে মঞ্চ উপস্থাপনার শিক্ষা দিয়ে, গান করার জন্য। কালো পোষাকে নতুন নামে আর্বিভুত হয় মোমে পিয়াফ বা মালিক বিহীন ছোট্ট চড়ুই বা লিটিল চমক।
ফ্রান্সের অনেক নামিদামী সেলিব্রেটি, মরিস সেভলিয়ার মতন অভিনেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ নতুন এই গায়িকার গান শোনার জন্য মঞ্চে উপস্থিত হয় লুইস লেপলের আয়োজনে। ১৯২৯ সনে রাস্তার মেয়ে এডিথ ফ্রান্সের গায়িকার খাতায় উঠে আসে ছোট্ট চড়ুই নামে। প্রথম উপস্থাপনায় বাজী মাত। দুটো রের্কড প্রকাশ করার সুযোগ পায় । একই বছর আসে তিন নাম্বার রের্কডটিও। জনপ্রিয়তা সারা ফ্রান্স জুড়ে ছোট্ট চড়ুইর, ওর গান না শুনে কারো ভালোলাগে না।এডিথ মানে ভালোবাসা, তার গান জড়িয়ে থাকে মনে।
পরের বছর লুইস লিপলেকে হত্যা করে কেউ। তার দায় পরে ছোট্ট চড়ুইর উপর অভিযুক্ত প্রশ্নবিদ্ধ মানুষ। মনে করা হয়, এডিথের আগের প্রেমিক তাকে হত্যা করেছে। যখন সে শোকে মুহ্যমান হয়ে দেখতে যায় লিপলের মৃতদেহ। বের করে দেয়া হয় এডিথকে লিপলের ফিউনারেল থেকে অভিষাপগ্রস্ত কলংকময় নারীর খ্যাতি দিয়ে। বিশাল প্রভাব পরে তার কর্মজীবনে মিডিয়ার এই নেতীবাচক প্রচার। যেন জীবন এডিথকে ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকতে দিবেনা বলে পণ করেছে।
স্বনাম খ্যাতি অর্জনের জন্য এডিথ তার নাম পরিবর্তন করে রাখে এডিথ পিয়াফ। গান লিখে সুর করে নানান জনের সাথে যোগাযোগে আবার ব্যস্ততায় ফিরে এডিথ পিয়াফ। এ সময় অভিনয়ও শুরু করে সে এবং সাফল্যের সাথে তার গুণপনার প্রভাব রাখে।
একটি মানুষের জন্ম হয়েছে যেন প্রতিভার ধারক হয়ে কিন্তু পদে পদে তাকে পেরুতে হয় কত রকমের বাধার প্রাচির। তবু সে থেমে থাকে না চেষ্টা করে নানা ভাবে। সে হয়ে উঠে সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী ফ্রান্সের। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তি সময়ে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পরে আর্ন্তজাতিক ভাবে তার জনপ্রিয়তা প্রচার পায়।। ইউরোপ, আমেরিকা, সাউথ আমেরিকায় ভ্রমণে করে গান করে মাতিয়ে দেয় এডিথ পিয়াফ। অর্জিত হতে থাকে শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার গুলো। সিনেমায় ব্যবহার হয় এডিথের কণ্ঠ। ল্যা ভি এ্যান রোজ তার বিখ্যাত গানের এ্যালবাম যা তার জীবন নিয়ে পরবর্তিতে সিনেমাও করা হয়েছে, একই নামে। ১৯৪৫ সালে গাওয়া গানের জন্য ভোট দিয়ে ১৯৯৮ সালে গ্রামি পুরষ্কার ল্যা ভিনে রোজের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
ফ্রান্সে বিখ্যাত অলিম্পিয়া হলে কনর্সাট করার জন্য পাঁচ বছর ১৯৫৫, ১৯৫৬.১৯৫৮.১৯৬১,১৯৬২ জন্য সংরক্ষণ করা হয় এডিথের জন্য। কিন্তু সে ১৯৫১ তে মারাত্মক এক গাড়ী র্দূঘটনায় ভেঙ্গে যায় তার হাড় পাজর, হাত পায়ের হাড়। চলত শক্তি রহিত এডিথ বিছানা আর হুইল চেয়ার সঙ্গী করে পরে থাকে, সময় কাটায়।
মন তো বিকল হয়েছিল তারও আগে থেকে জীবনের চরম উত্থানের সময়, এক অনুষ্ঠানে বিখ্যাত মুষ্ঠিযোদ্ধা র্মাসেল গার্ডেনের সাথে পরিচয়ের পর থেকে অনুরাগ ছড়াতে থাকে দুজনের মধ্যে। যদিও মার্সেল বিবাহিত কিন্তু ভালোবাসা কখন যে কেমন করে আলো ছড়ায়। দুজনের মুগ্ধতা সমোঝতা যেন পরিপুরক জুটি। প্রচণ্ড রকম আবেগ প্রবণতায় ভোগে এডিথ মার্সালের জন্য। প্যারিস থেকে নিউ ইর্য়ক আসছিল র্মাসাল এডিথ পিয়াফের সাথে দেখা করতে। অপেক্ষা আর উত্তেজনায় অস্থির পিয়াফ ভালোবাসার দেখা পাবার। অথচ প্লেনটা ক্র্যাস করল। র্মাসালের সাথে, প্রেমিকের সাথে আর দেখা হলো না পিয়াফের। ১৯৪৯ এর অক্টোবরে এই ঘটনার পর থেকেই মানসিক ভাবে অস্থির পিয়াফ।
একটাও সিডি, রেকর্ড ধারন করা হয়নি অনেকদিন। প্রায় দেউলিয়া অবস্থার দায় বাঁচাতে এডিথ, ল্যা হোমে দ্যা র্বালিন জীবনের শেষ গানটি করে।
যদিও জীবনে অনেক প্রেমিকের আনাগোনা ছিল কিন্তু জীবনের শেষ দিনগুলি লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত এডিথ পিয়াফ নিঃসঙ্গতায় নদীর স্রোতে চোখ রেখে, ঘরের দেয়ালে মুখ লুকিয়ে কাটিয়ে যায়। একাকী শেষ দিনগুলি কাটিয়ে যেন আবেগের সাথে জড়িত প্রেমিক মার্সেলের মৃত্যুর অক্টোবর মাসটাকেই বেছে নিল মৃত্যুর জন্য মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়সে। গানের সুরের উঠানামার মতনই রোমাঞ্চকর চড়াই উতরাই পেরানো এক পথ যেন তার জীবন। রোমান ক্যাথলিকরা তার অবারিত জীবন যাপনের জন্য ধর্মিয় প্রথায় অন্তোষ্টিক্রিয়া করতে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের মিছিল জমে উঠেছিল রাস্তায় ভক্তদের তার শোকে। একশ হাজার মানুষ হয়েছিল কবরস্থানে, ধর্মকে উপেক্ষা করে এডিথ পিয়াফের প্রতি ভালোবাসায়।
জীবন এক রহস্যময় গতি পথ। কখন কেমন করে বদলে যায় কেউ জানে না।অথচ ছকে বাঁধা নিয়মে বাঁচতে ভালোবাসে বেশীর ভাগ মানুষ। খাওয়া পরা বিলাস এই তো জীবন। অথচ এই সহজ জীবনের বাইরে অবিনাশী সংঘাতে যাপিত হয় কত যে জীবন। রেখে যায় শাশ্বত চিহ্ন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:৩৩:৩৮ ৫০০ বার পঠিত