নীল আশিক বঙ্গ-নিউজঃ পোশাক খাত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আসা আনিসুল হকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তারই একজন ব্যবসায়িক অংশীদার, যা আমলে নিয়ে নোটিশ জারি করতে বলেছে হাই কোর্ট।
আনিসুল হক ও তার ছেলে নাভিদুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ‘দেশ এনার্জি লিমিটেডের’ দুই উদ্যোক্তাকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন এবং অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কোম্পানিকে আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলেছেন।
উদীয়মান ব্যবসায়ী হিসাবে গত বছর ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের শিরোনামে আসা নূহের লতিফ খান সোমবার এই মামলা দায়ের করেন, যিনি মাত্র ২১ বছর বয়সে দেশ এনার্জি গড়ে তোলেন।
তার বোন দেশ এনার্জির অপর পরিচালক শাহপার সাবাও এ মামলার একজন বাদী, যিনি অধিকারের সুরক্ষায় আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
হাই কোর্টের বিচারপতি মো. রেজাউল হাসানের বেঞ্চ মঙ্গলবার মামলাটি গ্রহণ করে এ বিষয়ে নোটিশ জারির নির্দেশ দেয়।
আদালতের আদেশের পর এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার আনিসুল হকের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে কয়েক ঘণ্টা পর ই মেইলে এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, নূহেরের অভিযোগ মিথ্যা এবং অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশ এনার্জি লিমিটেডের অধীনে সিলেটের কুমারগাঁওয়ে গ্যাসচালিত ও নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে তেলনির্ভর দুটি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে, যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১১০ মেগাওয়াট। আর এ কোম্পানিতে অভিযোগকারী ভাই-বোন নূহের লতিফ খান ও শাহপার সাবার শেয়ারের পরিমাণ ১০ শতাংশ করে।
আর্জিতে বলা হয়, গত দুই বছর ধরে দেশ এনার্জির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আনিসুল হক এবং তার ছেলে ও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনক নাভিদুল হকের সঙ্গে দুই আবেদনকারীর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। দুই উদ্যোক্তা পরিচালকের ‘ন্যায়সঙ্গত প্রত্যাশাকে’ পাশ কাটিয়ে বিবাদীরা ‘অবৈধ ও স্বেচ্ছাচারীমূলকভাবে’ প্রধান প্রধান ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত থেকে আবেদনকারীদের বাদ দেন। তাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকের দায়িত্ব পালনেও বাধা সৃষ্টি করা হয়। বিবাদীরা কোম্পানির কার্যক্রমকে ‘মারাত্মক অব্যবস্থাপনার’ মধ্যে ঠেলে দেন এবং দুই বাদীকে সরিয়ে দিতে হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও পীড়নের কৌশল গ্রহণ করেন।
অব্যবস্থাপনার দৃষ্টান্ত হিসাবে মামলায় বলা হয়, ‘অননুমোদিত’ কোম্পানির মাধ্যমে সস্তা যন্ত্রাংশ কেনায় সিদ্ধিরগঞ্জের ১০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত কেন্দ্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এছাড়া পরিচালক হিসাবে নূহের বা তার বোনের স্বাক্ষর না নিয়েই দেশ এনার্জি থেকে বড় অংকের টাকা তুলেছেন আনিসুল হক, যার মাধ্যমে নিয়ম ভাঙা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, বোর্ড রেজ্যুলেশন অনুসারে কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দুটি গ্রুপের যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালিত হওয়ার কথা। গ্রুপ-এ তে আছেন আনিসুল হক ও তার ছেলে নাভিদুল হক। আর গ্রুপ-বি তে রয়েছেন নূহের ও তার বোন। এই নিয়মের বিষয়টি ব্যাংককে জানানো থাকলেও দুই বিবাদী অন্য গ্রুপের কারো স্বাক্ষর ছাড়াই ২৮ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন।
বাদীপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা বলেন, “আনিসুল হক এভাবে কোম্পানির অব্যবস্থাপনা চালিয়ে যেতে থাকলে কোম্পানি ব্যাংকের দায় দেনা পরিশোধের সক্ষমতা হারাবে। অথচ দুই বাদী ব্যাংকের গ্যারান্টার হিসাবে রয়েছেন।”
নূহের লতিফ খান দেশ এনার্জি লিমিটেডের জন্মলগ্ন থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে এলেও গত ২৩ মার্চ আনিসুল হক ও নাভিদুল হক বোর্ড সভা করে তাকে পদচ্যুত করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলার আর্জিতে।
নূহেরের আইনজীবী এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, “আনিসুল হক পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা ভঙ্গ করে দেশ এনার্জিকে একটি পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো পরিচালনা করছেন। তিনি ও তার ছেলে মিলে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূহের লতিফ খানকে পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। তার গাড়ি কেড়ে নিয়েছেন। বন্ধ করে দিয়েছেন তার জ্বালানি ও মোবাইল বিল। হুমকি-ধামকি ও পীড়নের কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাদের দেশ এনার্জি চত্বর ছাড়তে বাধ্য করেছেন। আবেদনকারীরা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বিগ্ন।”
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নূহের ও তার বোন তাদের কাছে থাকা কোম্পানির ২০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করতে চাইলে আনিসুল হক তা কিনতে অস্বীকার করেন। আবেদনকারীরা কোম্পানি থেকে কোনো লভ্যাংশ বা বেতনভাতাও পাচ্ছেন না। আবার ব্যবস্থাপনার কাজেও অংশ নিতে পারছেন না।
লন্ডনের একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর ২০০৫ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে দেশ এনার্জি প্রতিষ্ঠা করেন নূহের লতিফ।
তখন কোম্পানিতে তার শেয়ারের পরিমাণ ছিলো ২৫ শতাংশ। বাকি শেয়ারের মধ্যে তার বোনের হাতে ২৫ এবং প্রতিষ্ঠাতা শেয়ার হোল্ডার ও পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের নামে ছিল ৫০ শতাংশ শেয়ার।
জাহাঙ্গীর আলমের শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে ২০০৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি এ কোম্পানিতে যোগ দেন মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিসুল হক, যিনি বিগত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ছিলেন।
পোশাক প্রস্তত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনিসুল হক ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের কোটায় সার্ক চেম্বারেরও সভাপতি ছিলেন।
শুরুতে দেশ এনার্জিতে ৪৬ শতাংশ শেয়ার থাকলেও ২০০৬ সালেই আনিসুল নিজের শেয়ারের পরিমাণ ৫৫ শতাংশ করেন। বর্তমানে কোম্পানিতে তার শেয়ার ৭৫ শতাংশ।
চলতি বছরের মার্চে নূহের লতিফকে সরিয়ে আনিসুল হক নিজেই দেশ এনার্জির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেন।
বর্তমানে মোহাম্মদী গ্রুপের কার্যালয়কেই প্রধান কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করছে দেশ এনার্জি। এ প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ছাড়া অন্য সকল কর্মীও এসেছেন মোহাম্মদী গ্রুপ থেকে। মোহাম্মদী গ্রুপের হিসাব বিভাগই দেশ এনার্জির হিসাব বিভাগ পরিচালনা করে।
আনিসুল হকের ছেলে নাভিদুল হক এ কোম্পানির পরিচালক হন ২০০৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি; প্রতিষ্ঠাতা শেয়ার হোল্ডার ও পরিচালক তাসনিম সুলতানার শেয়ার গ্রহণের মাধ্যমে। বর্তমানে দেশ এনার্জিতে নাভিদের শেয়ারের পরিমাণ ৫ শতাংশ।
মামলার বাদীদের অভিযোগ, বিদ্যুৎ খাতে তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এখন কাজে বাধা সৃষ্টি করে, অন্যায়ভাবে তাদের কোম্পানি থেকে সরিয়ে দিতে চাইছেন আনিসুল হক।
এই অবস্থায় আনিসুল হক ও তার ছেলে যাতে নায্যমূল্যে অপর দুই পরিচালকের শেয়ার কিনে নেন- সে বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা চেয়েছেন দুই বাদী।
আনিসুল হক বিনিয়োগ, সমর্থন ও নির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে তরুণ উদ্যোক্তাকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি নিয়ে কোম্পানিতে এলেও নূহের খান আর্জিতে বলেন, “এর কোনো কিছুই পাওয়া যায়নি।”
আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা কেন করেননি জানতে চাইলে নূহের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই ফ্যামিলির সঙ্গে সমঝোতা অসম্ভব। আনিসুল হক এবং তার স্ত্রী প্রায়ই আমাকে হুমকি দিতেন। ভয় দেখাতেন, নানাভাবে ঝামেলায় ফেলতেন।”
“উনি (আনিসুল হক) একবার আমাকে এমনও বলেছিলেন যে, ১৯৮৬ সালে এক লোক গুম হয়ে যায়। পরে নাকি তার দাফন হয়।”
“যেহেতু তারা দুজনেই প্রভাবশালী, মিডিয়ার সঙ্গে সু সম্পর্ক আছে, তাই তাদের চ্যালেঞ্জ করে কোনো লাভ হবে না বলেও আমাকে হুমকি দেয়া হয়েছে।”
“কয়েকদিন আগেও আনিসুল হক আমাকে বলেছেন, ‘মিডিয়াতে আমরা যা খুশি করতে পারি। এফবিসিসিআই নির্বাচনের সময় দেখনি?’”
এসব কথা বলার সময় আনিসুল হক বিভিন্ন টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতির ফিরিস্তিও দিতেন বলে জানান নূহের।
“তার স্ত্রীও আমাকে প্রায়ই বলেন, ‘আনিসকে কে না চেনে! ওর অনেক ক্ষমতা।’”
আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
নূহের বলেন, “টেলিফোনে বা বিভিন্ন বৈঠকের কথোপকথন রেকর্ড করার অভ্যাস আছে আনিসুল হকের। পরে ওই কনভারসেশন এডিট করে এমনভাবে ব্যবহার করতেন, যার সঙ্গে মূল আলোচনার কোনো মিলই থাকতো না।”
“সেধে কে মামলায় জড়াতে চায় বলেন? আমি বাধ্য হয়ে আদালতে এসেছি”, বলেন মাহের।
আদালতে তাদের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার আখতার ইমাম। তাকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম ও ব্যারিস্টার রেশাদ ইমাম।
আনিসুল হকের প্রতিক্রিয়া
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ই মেইলে পাঠানো এক প্রতিক্রিয়ায় আনিসুল হক বলেন, আদালতে তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আদালতেই এর ফয়সালা হবে।
দেশ এনার্জিতে কোনো বিনিয়োগ না করার যে অভিযোগ নূহের এনেছেন, তা প্রত্যাখ্যান করে আনিসুল বলেন, বিনিয়োগ ও দায় মিলিয়ে এই প্রতিষ্ঠানে মোহাম্মদী গ্রুপের অবদান চারশ কোটি টাকার বেশি।
“আসলে নূহের আমাদের কাছে এসেছিল বলেই আমরা তার সঙ্গে ব্যবসায় যাই। এই প্রতিষ্ঠানে তার এবং তার বোন সাবার শেয়ারের পরিমাণ মাত্র ২০ শতাংশ। তাদের বিনিয়োগও উল্লেখযোগ্য নয়।”
দায়িত্ব পালনে বাধার অভিযোগ অস্বীকার করে আনিসুল হক বলেন, নূহের নিয়ম ভেঙে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে ছিলেন। কোম্পানির অনেক জরুরি প্রয়োজনেও ইচ্ছাকৃতভাবে দায়িত্ব থেকে দূরে থাকেন তিনি।
“এসব কারণে এমডি পরিবর্তনের জন্য ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন অনুযায়ী আমরা বোর্ড মিটিং ডাকি, যাতে নূহের ও সাবাও উপস্থিত ছিল। হুমকি দেয়ার যে অভিযোগ সে করেছে তা ভিত্তিহীন ও উদ্যেশ্যপ্রণোদিত। বরং তার অব্যবস্থাপনা আর সাপ্লায়ারদের সঙ্গে অবৈধ যোগসাজশের কারণে কোম্পানি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
আনিসুল হক বলেন, তিনি এখনো জানেন না কখন, কোন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে আর ঠিক কী আদেশ আদালত দিয়েছে। গণমাধ্যমের খবর থেকে তিনি কেবল এটুকু জানতে পেরেছেন যে আদালত একটি নোটিস দিতে বলেছে।
মামলা করার মাধ্যমে নূহের কোম্পানিতে এমডি হিসাবে তার কর্মকাণ্ডের দায়দায়িত্ব এড়াতে চাইছে বলেও অভিযোগ করেন চেয়ারম্যান।
বাংলাদেশ সময়: ২০:২০:১৬ ৫৮৯ বার পঠিত