বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলয় পাল্টাতে শুরু করেছে ব্যাংক ব্যবসার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাভাবিক লেনদেনেও এর প্রভাব পড়েছে। অবরোধের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের দৈনিক ৪০০ কোটি টাকার লেনদেন ৪ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও একাধিক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকিং ব্যবসায় ধস বেশ আগে থেকেই নেমেছে। ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত।সূত্র জানায়, রাষ্ট্রায়ত্ত, বিশেষায়িত, বেসরকারি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভাগ এবং জেলা শহরের শাখাগুলোর চিত্র আরো ভয়াবহ। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গেই তফসিলি ব্যাংকগুলোর লেনদেন কমেছে প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকের সঙ্গে লেনদেনেও প্রায় একই চিত্র বলে জানা গেছে।
সূত্রটি জানায়, গত সপ্তাহের মঙ্গল ও বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল শাখার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাংকের লেনদেন কমেছে ৮০ শতাংশ। এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকের জমার পরিমাণ কমেছে ৯০ শতাংশ এবং উত্তোলনের পরিমাণ কমেছে ৬১ শতাংশ। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় বিভিন্ন ব্যাংক জমা করেছে মাত্র ৭৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকে জমা পড়েছে ২৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা এবং ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেছে মাত্র ৫৩ কোটি ৬ লাখ টাকা। অথচ অবরোধের আগের দু’দিন অর্থাৎ গত সপ্তাহের রবি এবং সোমবার এ লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩৯৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা পড়েছে ২৫৭ কোটি ২১ লাখ টাকা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ব্যাংক উত্তোলন করেছে ১৩৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মতিঝিল শাখার কারেন্সি অফিসার (মহাব্যবস্থাপক) মো. সাইফুল ইসলাম খান বলেন, অবরোধের কারণে এখন টাকা তোলার চাহিদা কম। এছাড়া বর্তমানে রাস্তাঘাট নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। এ কারণে কোনো ব্যাংক টাকা নিয়ে যেতে সাহস করছে না। ব্যাংকগুলো টাকা নেয় তাদের গ্রাহকদের চাহিদা মেটানোর জন্য। কিন্তু ব্যাংকে গ্রাহকদের উপস্থিতি এবং লেনদেন খুবই কম থাকায় ব্যাংকগুলোর টাকার সংকট পড়ছে না। এ কারণে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করছেন না।
এদিকে, বছরজুড়ে বিদ্যুৎ-গ্যাসের সংযোগ না পাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকাসহ নানা কারণে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ঋণ কম নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। এমনকি উদ্যোক্তাদের ঋণের তেমন কোনো চাহিদাও নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসেব মতে, চলতি বছরের আগস্ট মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এর আগের মাস তথা জুলাইয়ে এর হার ছিল ১১ দশমিক ৬১ শতাংশ। যদিও ২০১২-১৩ অর্থবছর শেষে জুন মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ ২০১১-১২ অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ২০ শতাংশ।
এছাড়া, আমদানি-রফতানির প্রধানতম সড়কে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় দেশের পরিবহন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এতে সঠিক সময়ে পণ্য জাহাজীকরণ করা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোও কাক্ষিত পরিমাণ ঋণ বিতরণ করতে না পারায় আগের মতো মুনাফা করতে পারছে না। এতে করে দেশের বিনিয়োগ শূন্যের কোটায় চলে এসেছে।বিনিয়োগ মন্দায় পর্যাপ্ত তারল্য পড়ে থাকায় আমানত সংগ্রহে অনীহা দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো। আর ঋণের গুণমান ভালো না হওয়ায় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ বিভাগের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে ৩১৪ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছিল, যা অক্টোবর ‘১৩ দাঁড়িয়েছে ২৭৯ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। সে হিসাবে, অক্টোবরে আমদানিতে এলসি খোলার হার কমেছে ১১ দশমিক ২৩ শতাংশ। একইভাবে অক্টোবর মাসে আমদানি নিষ্পত্তি হয়েছে ২৮৪ কোটি ডলার। যা এর আগের মাসে হয়েছিল ৩০৯ কোটি ২৮ লাখ ডলার। এতে করে আমদানি নিষ্পত্তি কমেছে ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। এদিকে চলতি অর্থবছরের অক্টোবর মাসে ১২৩ কোটি ৪৭ লাখ মার্কিন ডলার বা তার সমপরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে, যা ২০১২-১৩ অর্থবছরের একই মাসে ছিল ১৪৫ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। সে হিসাবে অক্টোবরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ১৫ শতাংশ।
অপরদিকে, রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে পরিবহন খাতে ব্যাংকগুলোর দেওয়া নয় হাজার কোটি টাকার ঋণ আদায়। চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে দেশের বিভিন্ন রুটে প্রায় ১০ হাজার বাস-ট্রাক অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও হামলার শিকার হয়েছে বলে তথ্য দিয়ে নিয়মিত ঋণ পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে চিঠি দিয়েছেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা।
ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ২০১২ সালের শুরুতে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা খাতে একাধারে ঋণ দিয়ে আসলেও চলতি বছরে ঋণের স্থিতি কমেছে। এদিকে ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে এ খাতে বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে অনাদায়ী অর্থ। এ অবস্থায় পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ভবিষতে ব্যাংক এ খাতে ঋণ দিবে কিনা এ নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। তারা বলছেন, ঋণের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হবে এমন আশঙ্কায় নতুন করে এ খাতে ঋণ বিতরণে আগ্রহ দেখাচ্ছে না অধিকাংশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০০ শতাংশ হলেও এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ১৩ শতাংশ।
এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এবিবির চেয়ারম্যান মো. নুরুল আমিন বলেন, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে যে পরিস্থিতি চলছে এতে এ খাতে লগ্নিকৃত অর্থ আদায় করাই কষ্টসাধ্য। ইতোমধ্যে অনেক ব্যবসায়ীই ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়েছেন। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস বাংলাদেশের (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, দেশের অনিশ্চয়তার জন্য অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে ব্যাংকিং কর্মকান্ড পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে। আর সাম্প্রতিককালে যাতায়াত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সময়মতো রফতানি করা যাচ্ছে না। এতে ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের ঋণও পরিশোধ করতে পারছেন না। ফলে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। খেলাপির বিপরীতে প্রভিশন করতে গিয়ে ব্যাংকের নিট মুনাফা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শেয়ারহোল্ডারদের আমরা কাক্ষিত লভ্যাংশ দিতে পারছি না।
বাংলাদেশ সময়: ১৬:৪৩:১৯ ৩৯৩ বার পঠিত