বঙ্গ নিউস ডট কম - তারিখটি মনে নেই। তবে সে দিনের সেই ছোট্ট ঘটনাটি এখনও জ্বলজ্বল করছে স্মৃতিতে। বছর দুই আগে এমনই এক শীতের দুপুরে চট্টগ্রামে নেটে গভীর মনোযোগ দিয়ে অনুশীলন করছিলেন একজন। কিছুটা দূরে গ্যালারি থেকে কচিকণ্ঠের ডাক যেন ধ্যান ভেঙে দেয় সেই যোগীর। অনুশীলন থামিয়ে গ্যালারির ধারে এসে অনুরোধ করেন, এভাবে ডেকো না, আমি তোমাদের সঙ্গে অনুশীলনের পর কথা বলব। এরপর নিরাপত্তারক্ষীদের অতি তৎপরতায় লাঠি ওঠে স্কুলপড়ূয়া সেই কচিদের ওপর। আবারও নেট থেকে বেরিয়ে এসে নিরাপত্তারক্ষীদের বলেন, গ্যালারির ওই ছেলেগুলো তার অতিথি। তিনিই তাদের ডেকেছেন। মনে আছে, প্রায় দু’ঘণ্টা অনুশীলনের পর শচীন রমেশ টেন্ডুলকার এসে সেই ছেলেগুলোকে খুঁজে তাদের সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন, একটি বল উপহার দিয়ে বলেছিলেন, ‘জীবনে কখনও লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না, মনের কথাটি মাথা দিয়েও শুনবে।’ স্কুলপড়ুয়া ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য হৃদয়ের অনেকটা জায়গা ফাঁকা ছিল শচীনের। যেমনটি ছিল বাংলাদেশিদের প্রতি বন্ধুত্বের জায়গাটাও। আশরাফুল, সাকিব, মাশরাফি, তামিমদের হোটেলে, মাঠে, এমনকি ড্রেসিংরুমেও বড় ভাইয়ের মতো আশ্রয় দিতেন। এবারও যখন মার্চে এশিয়া কাপ খেলতে এসেছিলেন, তখন বাংলাদেশের কাছে হেরেও মুশফিকদের ড্রেসিংরুমে গিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছিলেন। কে জানত, সেটাই ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে এই কিংবদন্তির শেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কে জানত এ মিরপুরই ছিল তার ওয়ানডে ক্রিকেটের ২৩ বছরের লম্বা যাত্রার শেষ স্টেশন। যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার ২৩ বছর আগে করাচিতে, তারই অন্তিম ছিল মিরপুরে সেই পাকিস্তানের বিপক্ষেই। ৪৬৩ ওয়ানডে ম্যাচের শেষটি তিনি খেলেছিলেন এ মিরপুরেই, ১৮ মার্চ ২০১২ সালে।
কেউ না জানলেও শচীনের অন্তরাত্মা হয়তো ঠিকই জেনেছিল। আর তাই ১৬ মার্চ যখন বাংলাদেশের বিপক্ষে ১১৪ রান করেন, তখন মিরপুরের আকাশে অস্তগামী সূর্যকে প্রণাম করেই বিদায়ের সুর তুলেছিলেন। সেদিন ভারত ২৮৯ রান করেও হেরেছিল ৫ উইকেটে। মনে আছে, প্রেস বক্সে থাকা ভারতীয় সাংবাদিকরা তখন রাগে-ক্ষোভে গজগজ করছেন। যাদের কলম শচীনকে ভারতীয় ক্রিকেটের ঈশ্বর বানিয়েছিল, তাদের কলম থেকেই গোলার মতো আগুন বেরোচ্ছে শচীনকে লক্ষ্য করেই। সেদিন শচীনের ১৪৭ বলে ১১৪ রান করার ধীরগতিকেই দুষছিলেন ভারতীয় কলমচিরা। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে ‘অবসর কবে নেবেন’ প্রশ্নটি জুত করে লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন অনেকে। দিলি্লর অফিসকে বলে সেদিন অনেকেই সেই সংবাদ সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। সেদিনের সেই বিষণ্ন শচীন কিন্তু সবকিছু সামলে বাংলাদেশকেই কৃতিত্ব দিয়েছিলেন। ‘বাংলাদেশ আমাদের চেয়ে সবকিছুতে ভালো করেই এ ম্যাচ জিতেছে।’ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে এক দঙ্গল হিংস্র ভারতীয় সাংবাদিকদের সামনে একটুও গলা কাঁপেনি শচীনের। বরং স্বদেশি সাংবাদিকদের কৌতূহলে জল ঢেলে দিয়েছিলেন এই বলে যে_ ‘আপনারা বোধহয় ভুল সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন। আমার মন যেদিন বলবে আমি আর দলকে কিছু দিতে পারছি না, যেদিন মনে হবে আমার আর কিছু দেওয়ার নেই_ সেদিনই অবসর নেব। কারও কথায় আমি ক্রিকেট খেলতে আসিনি, কারও কথায় অবসরও নেব না। এটা একান্তই আমার নিজের সিদ্ধান্ত।’
আসলে শচীনের অবসর নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া সেই বিশ্বকাপের পর থেকেই পিছু লেগে আছে। মুম্বাইয়ে বিশ্বকাপের সেই ফাইনালের জেতার পরও ওয়াংখেড়ের প্রেস বক্সে সারাক্ষণ ব্রেকিং নিউজের খোঁজে থাকা ভারতীয় সাংবাদিকদের দেখেছি, শচীনের অবসর নিয়ে গুঞ্জন তুলতে। তেইশ বছরের লম্বা যাত্রার অভিজ্ঞতা আর মানসিক বল নিয়েই হয়তো এতদিন শচীন সেই কানপড়া, গুঞ্জন সব উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে এবার বোধহয় সত্যিই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। পাকিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ওয়ানডে সিরিজটা তিনি খেলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নির্বাচকরা আড়েফেঁড়ে তাকে বাদ দেওয়ার ইঙ্গিত দিতেই বুদ্ধিমান শচীন বুঝে নিয়েছেন। চট্টগ্রামে স্কুলের সেই ছোট ছেলেটিকে বলা ‘মনের কথা মাথা দিয়ে শুনতে’ কথাটি এদিন নিজের জীবনেও ব্যবহার করলেন।
বিদায় নিলেন ওয়ানডে ক্রিকেটের এক বরপুত্র, যিনি বাংলাদেশের সঙ্গে ১২টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে একটি সেঞ্চুরি নিয়ে ৪৯৬ রান করেছিলেন। ৭ টেস্টেও ৮২০ রান নিয়েছিলেন ৫টি সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে। প্রতিবার যখন বাংলাদেশে আসতেন এই লিজেন্ড, তখন তার উইকেট অনেকবার নিয়েছেন যিনি, সেই মাশরাফি বিন মর্তুজাও শচীনের বিদায়কে সম্মান জানালেন তার মতো করে, ‘অনেক সময় অবাক হয়ে ভাবি, একজন ক্রিকেটার ২৩ বছরের ধরে কীভাবে একই ফর্ম ধরে রেখেছিলেন। আসলে তার মতো লিজেন্ডকে নিয়ে বলার কিছু নেই। আমি মনে করি, তিনি ভালো মনে করেছেন বলেই অবসর নিয়েছেন। তার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো উচিত সবার।’
সত্যিই তো তাই, অতীতকে সম্মান জানানোটাই তো বর্তমানের দায়িত্ব আর ভবিষ্যতের পাথেয়।
বাংলাদেশ সময়: ১০:১৭:৩৫ ৬১৫ বার পঠিত