শুভ,বঙ্গ-নিউজ ডটকম : ২০১২ সালে নারী নির্যাতনের চিত্র ছিল ভয়াবহ। নারী নির্যাতনের আওতায় ইভটিজিং ছিল অন্যতম আলোচিত বিষয়। আত্মহত্যা, হত্যা, ধর্ষণসহ নানা ঘটনাই ছিল গত ২০১২ সালে।২০১১ সালে পুলিশ সদর দপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী সারা দেশে নারী নির্যাতনের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৩৪৪ জন, যা ২০১২ সালে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত যার সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১০,০২৯। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৩৪৪৮ জন নারী। এসিড আক্রমণের শিকার হয়েছে ৪৯ জন নারী। অপহরণ হয়েছে ২০৭৭ জন। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৮৬৯ জন এবং ধর্ষণের পর খুন হয়েছে ১৩ জন। এছাড়া বিভিন্ন কারণে খুন হয়েছে ১১৬ জন নারী এবং অনান্য ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে ২৩৯৪ জন।
এদিকে, বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালের ১১ মাসে ৭৭১ জন নারী যৌতুকের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ২৫৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ৪৮৫ জনকে বিভিন্নভাবে অত্যাচার নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে ।
নারী ও শিশু অধিদপ্তরের আওতাধীন নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের তথ্য মতে, ২০১২ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ৬টি বিভাগ থেকে নির্যাতিত নারীদের ২৩৩০টি আবেদন জমা হয়েছেন সেলে। এর মধ্যে ২৩০০টি মামলা নিষ্পিত্তি হয়েছে। দেনমোহর ও খোরপোষ বাবদ টাকা আদায় হয়েছে ৯২ লাখ, ৩৫ হাজার ৫০ টাকা।
এই সম্পর্কিত ২০১২ সালের উল্লেখ যোগ্য ঘতনা গুল হল :
ঘতনা ১। রাজধানীর হাতিরপুলে ১৪তলা নাহার প্লাজার ১৩তলায় সুস্মিতা ওরফে রুমির (১৭) ২৬ টুকরা লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। ২রা জুন নাহার প্লাজার ১৩তলার ১৩০৮ নম্বর কক্ষে রুমির প্রেমিক এবং সোনালী ট্রাভেল্সের মালিক সাইদুজ্জামান ওরফে বাচ্চু (৩০) এই নৃশিংসতম হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ঘটনার এক দিন পর এলাকার লোকজনের চোখে খণ্ড খণ্ড মাংস ও হাড়ের টুকরা পাওয়া পর রমনা থানা পুলিশ আসলে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসে। প্রেমিক বাচ্চুকে আটক করে ৪ দিনের রিমান্ডে নিলে সো মুখ খোলে। বাচ্চু তার জাবানবন্দিতে বলে, রুমির সঙ্গে তার এক বছর আগে পরিচয় হয় ফোনে। এরপর তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। পহেলা জুন শুক্রবার বাচ্চু রুমিকে নাহার প্লাজার ওই অফিসে নিয়ে আসে। এরপর তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক করার পর শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেন। এরপর বঁটি, ছুরি দিয়ে তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গের হাড় থেকে মাংস ছাড়িয়ে মাংসগুলো বাথরুমে ফ্লাশ করে দেয়। এবং হাড়গুলো বিভিন্নস্থানে ফেলে দেয়। কিন্তু বাথরুমের ফ্লাশ করা মাংস ও নাড়ী-ভুঁড়ি পাইপে আটকে গেলে পাইপ জ্যোম হয়ে যায়। এছাড়া ওই বিল্ডিংয়ের অন্য কক্ষের বাথরুমেও ভেসে উঠে রক্ত। ঘটনার দিন সকালেই হাড় ও মাংস এলাকার বাসিন্দাদের চোখে পড়লে ধরা পরে বাচ্চু। এরপর উক্ত এলাকা ও কক্ষ থেকে রুমির লাশের ২৬ টুকরা উদ্ধার করে রমনা থানার পুলিশ।
ঘতনা ২। প্রেমিকের আসল চেহারা প্রকাশ পাওয়ায় সম্পর্ক ছিন্ন করায় নিশৃংসভাবে হত্যার শিকার হয় পপি আক্তার (১৬)। মিরপুর ১৪ নাম্বার এলাকার কচুক্ষেত বালুর ঘাট এলাকার বাসিন্দা আলাউদ্দিনের মেয়ে পপি। ২০১২ সালের ১৬ই জুন ওই এলাকার ঝটপট্টি এলাকা থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যায় ঘাতক প্রেমিক রিপন ও তার সাঙ্গুপাঙ্গরা এরপর ওই এলাকার একটি নির্মাণাধীন ভবনে নিয়ে গিয়ে রাতভর ধর্ষণ করে রিপন এবং তার বন্ধু গাইট্টা বাবু, সুমন, বিল্লাল, হাসান, শামীম, রুবেল ওরফে চান্দু এবং আরিফ। এরপর শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে পপিকে। পরিচয় গোপন রাখতে ঘাতক দল হাতুড়ি দিয়ে থেঁতলিয়ে দেয় পপির চেহারা। এরপর তার লাশ ঝুট কাপড়ের বস্তায় ভরে পরিত্যক্ত ড্রেনে ফেলে দেয়। পরের দিন পুলিশ বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্তের জন্য হস্তান্তর করে। এরপর আসামিদের গ্রেপ্তার করেন মিরপুর থানা পুলিশ ।
ঘতনা ৩। যৌতুকের দাবিতে গৃহবধূ কাকলী আক্তার চৌধুরীর হাত-পা বেঁধে নির্যাতন চালায় স্বামী ইছহাক ও তার পরিবার। ২০১২ এর ২৫শে মে এ নিয়ে তোলপাড় চলে নবীগঞ্জের দিনারপুর পরগনায়। ২০০৯ সালে দীঘলবাগ ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা মৃত সিরাজুল ইসলামের মেয়ে কাকলীর সঙ্গে বিয়ে হয় গজনাইপুর ইউনিয়নের সাতাইহাল গ্রামের বাসিন্দা মৃত আব্দুল কাদিরের ছেলে ইছহাকের সঙ্গে। বিয়ের পর বিভিন্ন সময়ে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন চালায় তারা। এক পর্যায়ে কাকলী নির্যাতন সইতে না পেরে বাবার বাড়ি চলে যায় । কিন্তু নানা খেসারত করে স্বামী ইছহাক তাকে বাবার বাড়ি থেকে এনে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন চালায়।উক্ত এলাকার বাসিন্দারা কাকলীর পরিবারকে খবর জানালে তারা কাকলীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে। গ্রামের চেয়ারম্যান এ বিষয়টি সালিশের মাধ্যমে নিষ্পিত্তি করেছেন বলে জানা গিয়েছিল।
ঘতনা ৪। প্রেমিককে বিয়ে না করতে পারায় ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্রী বিনা সুলতানা তন্নির আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাএ অম্লান সাহার সঙ্গে ছিল প্রেম। কিন্তু সেই ভালবাসার মাঝে এসে দাঁড়ায় ধর্মের ভিন্নতা। মুসলমান পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে রাজি হবে না পরিবার, তাই পিছু হেঁটেছিল অম্লান। কিন্তু ভালবাসার মানুষটিকে ফিরে পেতে অপ্রাণ চেষ্টায় অবশেষে প্রাণ বিসর্জন দিল তন্নি। ২৪শে এপ্রিল রাজধানীর বনানীর বি ব্লকের ৫ নাম্বার বাসার একটি কক্ষ থেকে তন্নির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে রামপুরা থানা পুলিশ। আত্বহত্যার পূর্বে তন্নি দেড় পাতার একটি চিঠি লিখেন, যেখানে তিনি তার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কথা লিখেছেন। পুলিশ হত্যার কোন আলামত না পেলেও তন্নির পরিবার ঘটনাটি হত্যা বলে দাবি করেছিলেন। এদিকে প্রেমিক অম্লানকে আটক করে ৩ দিনের রিমান্ডে তন্নির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ও বিয়ে নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়ার কথা স্বীকার করে অম্লান। তিনি জানিয়েছিলেন ঘটনার দিন তন্নি তার ওই ফ্লাটে আসলে বিয়ে করা নিয়ে তাদের মধ্যে অনেক ঝগড়া চলে। এক পর্যায়ে তন্নি ওই ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। এরপর অম্লান তার বন্ধু টিটুর রুমে গিয়ে পড়াশুনা করতে থাকে। রাত ১০টায় বই নেয়ার উদ্দেশে দরজা খুলতে বললেও তন্নির কোন সাড়া না পেলে অম্লান ও তার বন্ধু টিটু দরজা ভেঙে তন্নির ঝুলন্ত লাশ দেখতে পায় ।
ঘতনা ৫। ধর্ষণে বাধা দেয়াই শ্বাসরোধে খুন হন ডাক্তার সাদিয়া আফরিন ইভা (২৭)। ২৯শে নভেম্বর রাত ১২টায় দক্ষিণাস্থ আমতলার ব্র্যাক ক্লিনিকের ঘটনা ছিল এটি। কেয়াটেকার ফয়সাল (২৩) আটক হওয়ার পর ডিবি হেডকোয়ার্টারের মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সামনে ডা. ইভার হত্যার চিত্র তুলে ধরেন। ওই দিন নাইট ডিউটিতে ছিলেন ডা: ইভা। রাত ১২টায় ফয়সাল তার কক্ষের দরজায় নক করেন। দরজা খোলার পরপর ঘাতক ফয়সাল ঝাঁপিয়ে পড়ে ডা. ইভার ওপর। আত্মরক্ষায় চিৎকার করেন ডা. ইভা। এক পর্যায় লাথি মেরে ফ্লোরে ফেলে দেন তিনি ঘাতক ফয়সালকে। এরপর ফয়সাল আবার উঠে বসে ডা. ইভার বুকের উপর। ডা. ইভা আবার চিৎকার করার চেষ্টা করলে তার মুখ ও গলা চেপে ধরে ফয়সাল। এর পর নিস্তেজ হয়ে পরেন তিনি। ডা. ইভার মৃত্যু নিশ্চিত করার পর ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় ঘাতক। এরপর ফয়সালকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরস্থ তার নানা বাড়ি থেকে আটক করেন পুলিশ।
ডা. ইভা ঘটনার ১৫ দিন আগেই ওই ক্লিনিকে চাকরিতে যোগ দেন। জাবনবন্দিতে ফয়সাল জানায়, ওই ক্লিনিকে ৫ মাস যাবৎ সে কাজ করছিল। এই ঘটনা দক্ষিণখান থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছিল।
ঘতনা ৬। চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের যৌন হয়রানির মামলা করায় ফতোয়ার শিকার হয়েছিলেন গৃহবধূ আসমা আক্তার (৩০)। আর তাই তার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেন ওই এলাকার মেম্বার ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হক জুনু। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশীর সাথে পারিবারিক কলহ চলছিল প্রবাসী আনোয়ারা ইসলামের স্ত্রী আসমার। ২৭শে জুলাই ওই ওয়ার্ডের আবদুল রশিদ পণ্ডিতের বাড়ির বাসিন্দা নুরুল আফসার (৪৮), আবদুল্লা (৫০),আবুল কাশেম (৩৮) এবং নুর নবী (৪৫) তাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ওই বাড়ির একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখেন। এরপর প্রায় ১ ঘণ্টা পর অন্য প্রতিবেশীরা তাকে উদ্ধার করেন। এ সময় জুনু মেম্বারসহ আরও অনেকেই উপস্থিত থাকলেও তারা ছিলেন নীরব। এ ঘটনায় আসমা বাদী হয়ে ২৯শে জুলাই মীরসরাই থানায় ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। দফায় দফায়া আসমা মামলা করলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন জুনু মেম্বার। ২রা অক্টেবর স্থানীয়া ফোরকানিয়া মাদরাসায় দু’ঘণ্টার এক বৈঠকে জুনু মেম্বার আসমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন উস্কানিমূলক ফতোয়া জারি করেন। ফতোয়ায় জুনু মেম্বার বলেছিলেন আসমা আক্তারের সাথে যৌন হয়রানির কথা তিনি নিজেই শিকার করেছেন। এ ধরনের অপরাধে শরিয়তের বিধান রয়েছে বিবাহিত নারীদের বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে রেখে পাথর নিক্ষেপ করার। কিন্তু যদি আসমা গ্রামের সব মুরব্বির কাছে ক্ষমা চায় এবং অপরাধ স্বীকার করে তাহলে তাকে গ্রামে থাকতে দেয়া হবে। মামলা করার অপরাধে ফতোয়া জারির পাশাপাশি আসমাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
কুষ্টিয়ায় ৯ দিন আটকিয়ে রেখে মা ও মেয়েকে নির্যাতন: কুষ্টিয়ায় মা আলেয়া বেগমকে ও মেয়েকে ৯ দিন আটক রেখে নির্যাতন চালিয়েছিল পুলিশ। প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ৯ই সেপ্টেম্বর রাত ৯টায় কুষ্টিয়ার রাজবাড়ি বেড়াডাঙ্গা এলাকায় বাড়ি থেকে চরমপন্থির কানেকশন সন্দেহে কুষ্টিয়া খোকশা কুমারখালী থানা ও ডিবি পুলিশের ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য তাদের আটক করেছিল। এরপর তাদের খোকশা কুমারখালী থানায় দু’দিন রেখে কারেন্ট শক দিয়ে নির্যাতন চালায়। এর দু’দিন পরে রাতে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ লাইনের ডিবি অফিসে। সেখানেও তাদের ওপর চলে নানা নির্যাতন। আলেয়া বেগম জানিয়েছিলেন, তাদের যেখানে আটক করা হয়েছিল সেখান থেকে তার মেয়েকে প্রতি রাতে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালিয়েছে পুলিশ। প্রায় ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা পর মেয়েকে তারা তার মায়ের কাছে দিয়ে যেত বলে জানিয়েছিলেন তিনি। ডিবির এসআই মাসুদসহ আরও কয়েক জন পুলিশ তাদের আটকে রেখে ক্রসফায়ারে নিহত সন্ত্রাসী মোতালেবের স্ত্রী শীলার সন্ধান চাইতো বলে জানান তিনি। এদিকে নির্যাতন ও লাঞ্ছনার কারণে মানসিকভাবে ভেফু পড়েছিলেন আলেয়া এবং তার কলেজ পড়ুয়া মেয়ে। আর তাই আটক অবস্থায় থেকেই বহু বার আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন তারা ।
এদিকে এ ব্যাপারে রাজবাড়ী থানার পুলিশ ইনচার্জ এবং খোকশা থানার অফিসার্স ইনচার্জ হরেন্দ্র নাথ সরকার একে অপরকে দোষারোপ করেন। এদিকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নাল আবেদিন গুরুত্বপূর্ণ ওপারেশনে থাকার অজুহাতে এড়িয়ে যান ঘটনাটি।
এমনও না যানা আর অনেক ঘতনা ঘটে যাচ্ছে আমাদের সমাজে।
বাংলাদেশ সময়: ৮:০৮:১৭ ৬৯৮ বার পঠিত