‘: স্বাধীনতার চার দশক পর যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে শাহবাগের যে আন্দোলন বেগবান, তার সঙ্গে সংহতি জানিয়ে এবার পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রায় থাকবে ৬৫ ফুট দীর্ঘ ভিন দেশি এক সরীসৃপ। অশুভ শক্তি তাড়ানোর দানবীয় এই প্রাণীকে ‘রূপক’ হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হবে বাঙালির ঐতিহ্যের দিনটিতে।আর একটা রাত পোহালেই বাংলা নববর্ষ। ১৪২০ সনের প্রথম দিনটি চিরায়ত উৎসব-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে হাজির হবে বাঙালির হৃদয়ে। প্রতি বছরই বর্ষবরণ উৎসবে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন করা হয়। আর শোভাযাত্রায় থাকে বিশেষ কোন এক প্রতীক। এরই ধারাবাহিকতায় এবার অশুভ শক্তি তাড়ানোর দানবীয় সরীসৃপের ধারণা।
এছাড়াও শাহবাগের গণজাগরণ চত্বর পেরিয়ে চারুকলার চত্বরে দিনরাত কাজ করে চারুকলার শিক্ষার্থীসহ তরুণ-তরুণীরা স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি করছেন বর্ষবরণের নানা অনুসঙ্গ।
লিচুতলায় আরেক দল কাঠ, বাঁশ, মাটিসহ বিভিন্ন উপকরণে গড়ে তুলছেন ভিন্ন ভিন্ন কাঠামো। কেউ সেগুলোকে করে তুলছেন বর্ণিল। এগুলোর মধ্যে আছে বিশালাকৃতির এক সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর কাঠামো, যেটির মূল থিমেটিক স্ট্রাকচার তৈরির কাজ প্রায় শেষ দিকে। সরীসৃপ জাতীয় এই প্রাণীটি ক্ষিপ্র গতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ থেকে আগুন ছুঁড়ছে।
কাজের ফাঁকেই কথা হয় এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি কাজের সমন্বয়ক মানবেন্দ্র ঘোষের সঙ্গে।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “আগামীর ভবিষৎ তরুণ প্রজন্মসহ সবার দাবি যুদ্ধাপরাধীরে ফাঁসি, রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ। সেই দাবিকেই শোভাযাত্রায় ফুঁটিয়ে তোলা হচ্ছে রূপকের মাধ্যমে।”
তিনি বলেন, “আমরা বাঙালির ঐতিহ্যকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখতে চাই। কিন্তু অশুভ শক্তি তা বাধাগ্রস্ত করছে প্রতিনিয়ত। তিনটি ভ্যানের ওপর কাঠের তৈরি ৩০ ফুট ফ্রেমে চেপে বসবে শোভাযাত্রার মূল অনুসঙ্গ ৬৫ ফুট দীর্ঘ এই প্রাণীটি। বাঙালির শিল্প-সাহিত্য-ঐতিহ্য নিয়েই মঙ্গল শোভাযাত্রায় রূপকের মাধ্যমে অশুভ শক্তিকে তাড়াবে এই দানব।
মঙ্গল শোভাযাত্রা ঘুরবে রাজধানীতে। এতে স্থান পাবে টেপা পতুলের রিকশায় ১৪-১৬ ফুট উচ্চতার ১২/১৩টি ঘোড়া এবং ১৫ ফুটের একটি হাতি। এছাড়াও দানবীয় প্রাণীটির সঙ্গে থাকবে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিল্প-সাহিত্যের নানা দিক। বাঙালি ঢঙে বৈশাখী পোশাকে তরুণ-তরুণী-যুবাসহ সব বয়সের নারী-পুরুষ গালে আলপনা এঁকে এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলবে শতভাগ বাঙালিপনা।
নববর্ষ উদযাপন কমিটির সিদ্ধান্তে শুধু রাজধানীতেই নয়, অশুভ শক্তি বিতাড়নের পহেলা বৈশাখ উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সিদ্ধান্তে টি-শার্ট এবং পোস্টারে প্রতীকী অর্থে মোটিভ তৈরি করে পাঠানো হবে সারা দেশে।
বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যের দিনটিতে রঙ-বেরঙের মুখোশ নিয়ে, শোলার পাখি, পেঁচা, প্রজাপতি, খরগোশ ও টেপা পুতুল, ঢাল-ঢোল-বাঁশি, লাঠি-বর্শা, তীর-ধনুক নিয়ে অংশ নেবেন মঙ্গলের যাত্রীরা।
চারুকলার ফটকের কাছেই এক দল শিক্ষার্থী মাটির মুখোশ, ব্যাঙ, হাতি, ঘোড়া, পুতুল, কলমদানি তৈরি ও বিক্রি করছেন।
সোহেল আশরাফ খান নামে এক শিক্ষার্থী বাংলানিউজকে বলেন, “এসব বিক্রির মাধ্যমে মঙ্গল শোভাযাত্রার অনুদান সংগ্রহ করে স্পন্সর (সহযোগি) ছাড়াই প্রতিবার শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।”
গত ১৭ মার্চ চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম বিক্রি শুরু হলেও এবার বিক্রি কম জানিয়ে মানবেন্দ্র বলেন, “এখানে কম দামে বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রকর্ম বিক্রি হয় শোভাযাত্রার খরচ মেটাতে। এ সুযোগে ইচ্ছে করলেই যে কেউ সেগুলো কিনে আমাদের সহায়তা করতে পারেন।”
গত বছরের শোভাযাত্রার প্রস্তুতি কাজের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা চারুকলার মৃৎশিল্পের শিক্ষার্থী নবেন্দু সাহাসহ আয়োজকরা জানান, শোভাযাত্রার অনুষঙ্গগুলো তৈরির বাইরে চারুকলার সীমানা প্রাচীরের বাইরের দিকে আলপনা আঁকা হবে।
মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে বৈশাখ থেকে বাংলা সাল গণনা শুরু হয়। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য তারা বর্ষ শুরুর জন্য সে দিনটি ধার্য করেছিল, তা এখন বাঙালির নববর্ষ।
বাঙালির সার্বজনীন উৎসবকে সরকারিভাবে উদযাপনে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। পহেলা বৈশাখে সরকারি ছুটি ছাড়াও রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন।
ওই দিন রমনা বটমূলে ছায়ানট আয়োজিত অনুষ্ঠান বিটিভি ও বেতারে সরাসরি সম্প্রচার হবে। বেসরকারি টিভি আর বেতারও সে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে। বাঙালির সংস্কৃতি তুলে ধরে পত্র-পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ হবে।
শিল্পকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলা একাডেমী ও বিসিক, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, জাতীয় জাদুঘরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-মেলা-লোক উৎসব-পিঠা উৎসব-আলোচনার আয়োজন করা হবে।
দেশের সব কারাগার, হাসপাতাল ও এতিমখানায় উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এবার ২৫তম মঙ্গল শোভাযাত্রার এই আয়োজনের স্লোগান- ‘রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ/মুক্তিযুদ্ধ অনিঃশেষ’।
১৪১৯’র শেষ সূর্য বিদায় নিয়ে ১৪২০ সালের নতুন দিনটিতে বাঙালি মেতে উঠবে বর্ষবরণে, দেশ হবে অপশক্তিমুক্ত- এটাই সবার প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:৫৯:৪৮ ৬৯০ বার পঠিত