বঙ্গ-নিউজ ডটকম:সংগ্রহ ও ভূমিকা:অপু রহমান
কবি শামসুর রাহমানকে আমরা জানি রবার্ট ফ্রস্ট ও খাজা ফরিদের কবিতার অনুবাদক হিসেবে। কবির মৃত্যুর পর তাঁর অনুবাদ কবিতাগুলি নিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে অনুবাদ কবিতা সমগ্র নামের সংকলন। তিনি হো চি মিনের কবিতারও অনুবাদক। অধুনালুপ্ত বিচিত্রা পত্রিকার ৯ মে ১৯৭৫ (তৃতীয় বর্ষ ৪১ সংখ্যা) তারিখের ‘ভিয়েতনাম সংখ্যা’য় খুঁজে পাওয়া গেল শামসুর রাহমানকৃত ভিয়েতনাম বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা হো চি মিনের ১২টি কবিতার অনুবাদ।‘দিয়েন বিয়েন ফু থেকে সায়গন’ শিরোনামের এই ভিয়েতনাম সংখ্যায় ‘আবার স্বদেশকে গড়ব সুন্দর করে’ শীর্ষক হো চি মিনের শপথবাক্যের পাশাপাশি আছে ভিয়েতনাম বিপ্লবের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অভিনন্দনবাণী। শামসুর রাহমানের অনুবাদে এক নতুন হো চি মিন আবিষ্কৃত এখানে। প্রসঙ্গে সমসাময়িক হয়েও এই কবিতাগুলি সর্বমানবের অনুভবে হয়ে উঠেছে চিরায়ত।
কবি শামসুর রাহমানকে আমরা জানি রবার্ট ফ্রস্ট ও খাজা ফরিদের কবিতার অনুবাদক হিসেবে। কবির মৃত্যুর পর তাঁর অনুবাদ কবিতাগুলি নিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে অনুবাদ কবিতা সমগ্র নামের সংকলন। তিনি হো চি মিনের কবিতারও অনুবাদক। অধুনালুপ্ত বিচিত্রা পত্রিকার ৯ মে ১৯৭৫ (তৃতীয় বর্ষ ৪১ সংখ্যা) তারিখের ‘ভিয়েতনাম সংখ্যা’য় খুঁজে পাওয়া গেল শামসুর রাহমানকৃত ভিয়েতনাম বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা হো চি মিনের ১২টি কবিতার অনুবাদ। ‘দিয়েন বিয়েন ফু থেকে সায়গন’ শিরোনামের এই ভিয়েতনাম সংখ্যায় ‘আবার স্বদেশকে গড়ব সুন্দর করে’ শীর্ষক হো চি মিনের শপথবাক্যের পাশাপাশি আছে ভিয়েতনাম বিপ্লবের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অভিনন্দনবাণী। শামসুর রাহমানের অনুবাদে এক নতুন হো চি মিন আবিষ্কৃত এখানে। প্রসঙ্গে সমসাময়িক হয়েও এই কবিতাগুলি সর্বমানবের অনুভবে হয়ে উঠেছে চিরায়ত।হো চি মিনের কবিতা
ডায়েরির প্রথম পাতা
কবিতা আবৃত্তি করা ছিলো না অভ্যাস
কিন্তু এই কারাগারে এখন কী-ই বা
করা যায় আর?
এই বন্দী দিনগুলি কাটাবো কবিতা লিখে আমি
আর কবিতার সুরে এগিয়ে আনবো স্বাধীনতা।
সিংসি জেলে প্রবেশ করার মুহূর্তে
পুরোনো কয়েদি স্বাগত জানায় নতুন কয়েদিদের।
আসমানে শাদা মেঘগুলি কালো মেঘেদের করে ধাওয়া
শাদা-কালো মেঘ চোখের আড়ালে কখন গিয়াছে চলে,
পৃথিবীতে সব মুক্ত লোককে গাদাগাদি করে কয়েদে হচ্ছে পোরা।
গুরুতর অসুস্থ
পরিবর্তমান এই চীনের আবহাওয়ায় আমার শরীর
হয়েছে বিধ্বস্ত খুব, ভিয়েতনামের দুর্দশায়
আমার হূদয় ক্ষতিবিক্ষত ভীষণ, হায়, কয়েদখানায়
অসুস্থ হওয়াটা কী যে সাংঘাতিক ব্যাপার কী বলি—
কিন্তু আমি কান্নার বদলে গান গেয়ে যাওয়াটাই
অধিক পছন্দ করি।
দুপুর
কয়েদখানার কী সুখের দুপুরের ঘুম।
আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভাসি গভীর নিদ্রায়।
স্বপ্ন দেখি আমি ড্রাগনের পিঠে সওয়ার, চলেছি স্বর্গপথে
জেগে দেখি, হ্যাঁচকা টানে আমাকে আবার আনা হলো
এ বন্দীশালায়
বিকেল
বেলা দুটো বাজে: সেলের দরজা খুলে যায়, তাজা
বাতাস আসবে বলে।
একটু আকাশ দেখার জন্যে প্রত্যেকে তোলে মাথা।
হে মুক্তপ্রাণ, মুক্তির নীল গগনবিহারী
তোমরা কি জানো বন্দীশালায় তোমাদের
সব স্বজন মরছে ধুঁকে?
সন্ধ্যা
আহারের পরে সূর্য অস্ত যায় পশ্চিমে, এখন
চতুর্দিকে অকস্মাৎ বেজে ওঠে লোকগীতি, মধুর সংগীত,
বিষণ্ন আঁধার ঘেরা সিংসি বন্দীশালা হয়ে যায়
নিমেষে ললিতকলা একাডেমি এক।
বন্দীর বাঁশি
হঠাৎ বাঁশিতে বাজে দূর স্মৃতিজাগানিয়া সুর:
বিষণ্ন সংগীত জেগে ওঠে, সুর তার নিরালা ফোঁপানি যেন
অনেক পাহাড় আর অনেক নদীর পরপারে, হাজার মাইলব্যাপ্ত
ভ্রমণ অত্যন্ত শোকাবহ আর যন্ত্রণাদায়ক। মনে হলো, এক
নারীকে দেখছি, যেন উঠেছে সে অতিদূর এক
মিনারে একাকী কারও প্রত্যাবর্তন দেখবে বলে।
কী কঠিন জীবনের পথ
দুরারোহ পর্বত এবং খুব উঁচু গিরিচূড়ায় ওঠার পর
খোলা প্রান্তরে আরও বেশি বিপদের মুখোমুখি হবো—
এটা কী করে আশা করা যায়?
পাহাড়ে বাঘের মুখে পড়েছিলাম, কিন্তু আমার গায়ে
এতটুকু আঁচড় লাগেনি,
খোলা প্রান্তরে মানুষের মুখোমুখি হলাম এবং
আমাকে নিক্ষেপ করা হলো বন্দীশালায়।
২.
ভিয়েতনামের প্রতিনিধি আমি,
চীন যাওয়ার পথে একজন হোমরা-চোমরা ব্যক্তির সঙ্গে
দেখা করবার কথা ছিলো আমার।
শান্ত পথে আচমকা উঠলো ঝড়
এবং আমাকে এক মাননীয় অতিথি হিসেবে
ঠেলে দেওয়া হলো কয়েদখানায়।
৩.
অকপট লোক আমি, আমার বিবেকও নয় কলুষিত,
কিন্তু চীনের গুপ্তচর বলে অভিযুক্ত করা হলো আমাকে।
সুতরাং জীবন, দেখতেই পাচ্ছেন, কখনো খুব মসৃণ ব্যাপার নয়
এবং এখন বর্তমান কষ্ট-কণ্টকিত।
সকাল
প্রতিটি সকাল সূর্য দেয়াল টপকে ফটকে
ছুড়ে দ্যায় তার রশ্মি-হিরণ,
কিন্তু ফটকে ঝুলছে তালা।
কয়েদখানার ভেতরে চৌকি আঁধারে ঢাকা,
অথচ বাইরে ঝলমল করে সূর্যোদয়।
২.
জেগে উঠলেই প্রত্যেকে মাতে উঁকুন হননে।
বেলা আটটায় ঘণ্টা রটায় সকাল বেলার খাবার সময়।
চলো চলো যাই আমরা সবাই।
প্রাণ ভরে আজ খাইগে চলো।
ঢের দুর্ভোগ সয়েছি আমরা, এবার আসবে
আসবে সুদিন সুনিশ্চয়।
নিজেকে উপদেশ
শীতের এমন হিমশীতলতা, জনশূন্যতা ছাড়া
বসন্ত তার উত্তাপ আর গাঢ় মাধুর্য পারে না বিলোতে,
দুঃখ আমাকে গড়েছে শক্ত ধাতুতে আর
হূদয় আমার হয়ে গেছে ইস্পাত।
অবিরাম বৃষ্টি
ন’ দিন কেবলি বিরতিবিহীন বৃষ্টি দিন,
একদিন শুধু আবহাওয়া খুবই ভালো।
ওপরে আকাশ নির্দয় বড়ো বাস্তবিক,
আমার জীর্ণ জুতো জোড়া দ্যাখো হয়ে গেছে খান খান।
কর্দমাক্ত রাস্তা পা দুটোকে করে নোংরা ভারি,
যা হবার তাই হয়েছে, এখন এগিয়ে যেতেই হবে।
জ্যোৎস্না
কারাবাসীদের জন্যে একটু মদ নেই ফুলও নেই,
অথচ রাত্রি এমন মধুর, আমরা কীভাবে একে
করবো উদ্যাপন?
ঘুলঘুলিটার কাছে যাই আর তাকাই চাঁদের দিকে—
ঘুলঘুলিটার ভেতর দিয়েই
চাঁদ মৃদু হাসে বন্দী কবিকে দেখে।
জেলখানায় দেখা
স্বামীটি রয়েছে কয়েদখানার ভেতরে আর
বধূটি দেখছে তাকে গরাদের আড়াল থেকে।
এত কাছাকাছি দুজন এখন, কেবল কয়েক
ইঞ্চির ব্যবধান।
তবু কত দূরে—আকাশ এবং সাগরতলার মতো।
পারে না যা কিছু কথারা বলতে, তাদের মরিয়া
চোখ বলে দ্যায় তা-ও।
প্রতিটি কথার আগেই ওদের চোখ ভরে ওঠে জলে।
কে আছে এমন দুজনার এই মিলন দেখবে
এখানে দাঁড়িয়ে নিথর নিরুত্তাপ?
বাংলাদেশ সময়: ৩:০০:৩৪ ৪৭৪ বার পঠিত