বঙ্গ-নিউজ ডটকম:ভয়ের স্রোত পাড়ি দিয়ে ১৫৭ রানের দুর্দান্ত এক জুটিতে বাংলাদেশ দলকে টেনে তোলার কাজটা করেছেন মমিনুল ও তামিম। তামিম ফিরে গেলেও মমিনুল এখনো আছেন দলের আশার প্রতীক হয়ে।দুই মিটার ছুঁই-ছুঁই উচ্চতার কারণে পিটার ফুলটনের পরিচিতি ‘টু মিটার পিটার’। এই সিরিজের এমন ব্যাটিংয়ে মমিনুল হককে তবে কী নাম দেওয়া যায়? ‘পকেট ডায়নামো!’
শুধু ছয় ফুট পৌনে সাত ইঞ্চি উচ্চতাই নয়, সঙ্গে পেটানো শরীর মিলিয়ে ফুলটনকে সামনাসামনি মনে হয় সাক্ষাৎ দৈত্য। পাঁচ ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চির মমিনুলকে শরীর-স্বাস্থ্য আর মুখাবয়ব মিলিয়ে দেখতে লাগে আরও ছোট। ২২ বছর বয়সী যুবা নয়, যেন সদ্য পেরিয়েছেন কৈশোর! উচ্চতার কারণে আলাদা করে চোখে পড়েন বলেই শুধু নন, এই দুজনকে পাশাপাশি টানার কারণ আছে আরেকটি। উচ্চতার একটি রেকর্ডে দুজন ঠিক দুই প্রান্তে। টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে দীর্ঘদেহী সেঞ্চুরিয়ান ফুলটন, আর সবচেয়ে খর্বকায় সেঞ্চুরিয়ান মমিনুল।
ব্যাটিংয়ের ধরনেও আবার দুজন উল্টো। দৈত্যাকৃতির ফুলটনের ব্যাটিংয়ে সৌন্দর্যের লেশমাত্র নেই। ব্যাটিং দলের জন্য কার্যকর হতে পারে, দর্শকের জন্য চোখের যন্ত্রণা। মমিনুলের ব্যাট সেখানে তাঁর ডাকনামের মতোই সৌরভ ছড়ায়। চোখকে দেয় প্রশান্তি, ভরিয়ে দেয় মন। ‘ছোট্ট’ মমিনুল এই সিরিজে নিউজিল্যান্ডের সামনে সবচেয়ে বড় দেয়াল। কাল সংবাদ সম্মেলনে ফুলটন বলে গেলেন, মমিনুলকে নিয়ে তাঁদের কোনো পরিকল্পনাই কাজে লাগছে না। ফুলটনের বিস্ময় আকাশ ছুঁত, যদি জানতেন কালকের ইনিংসটি খেলেছেন মমিনুল জ্বর নিয়ে!
জ্বর নিয়েই ফিল্ডিং-বোলিং করেছেন পরশু। কাল জ্বর খানিকটা কমলেও একেবারে যায়নি। আর শরীরও ছিল অনেক দুর্বল। এমন ছোটখাটো শরীর আর এই শারীরিক অবস্থায় সোয়া পাঁচ ঘণ্টা ব্যাটিং, সেটাও ফুলটনের মতো ধুঁকে ধুঁকে নয়, নিজের মতোই সুরভি ছড়িয়ে। এই ইনিংসটাকে বলা যায় অতিমানবীয় কিছু।
এই সিরিজটিও কি নয়? মমিনুলের প্রতিভার কথা জানা ছিল কমবেশি সবারই। কিন্তু এই সিরিজে মমিনুল যা করলেন, সেটাকে অভাবিত বললেও কম বলা হয়। তামিম ইকবালের পর প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে করলেন টানা দুই টেস্টে সেঞ্চুরি। বাংলাদেশের মাটিতে এক সিরিজে সর্বোচ্চ রানের (৩৭৬) রেকর্ডও হয়ে গেছে, পেছনে ফেলেছেন তিলকরত্নে দিলশানকে (৩৬৬)। আজ সকালে একটি বাউন্ডারি এনে দেবে বাংলাদেশের হয়ে এক সিরিজে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটিও। হাবিবুল বাশার ৩৭৯ রানের রেকর্ড গড়েছিলেন তিন টেস্ট খেলে, মমিনুল দুই টেস্টেই সেই রেকর্ডের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছিলেন কাল দিন শেষে (৩৭৬)। দুই টেস্টের সিরিজে তামিমের ২৬৮ রানের রেকর্ড তো সেই কত পেছনে পড়ে গেছে! এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি চারের (২৭) রেকর্ড গড়েছেন চট্টগ্রামে। কাল এক সিরিজে সর্বোচ্চ চারের রেকর্ডও হয়ে গেছে। আজ যদি আর একটি রানও না করেন, ৫ টেস্ট শেষে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রান তবু হয়ে গেছে অনায়াসেই (৫৮৪)। হাবিবুল বাশারের আগের রেকর্ডকে (৩৫৭) পেছনে ফেলেছেন যোজন যোজন। যেন স্বপ্নের এক সিরিজ।
স্বপ্নের মতো সিরিজ কাটাচ্ছেন স্বপ্নের মতোই ব্যাটিংয়ে। চট্টগ্রামের মন্থর উইকেটে ১৮১ রানের ইনিংসটির কথা মনে করুন। বল ঠিকমতো ব্যাটে আসে না, এমন উইকেটেও অপূর্ব সব স্ট্রোকের প্রদর্শনী মেলে ধরেছিলেন। দেখিয়েছিলেন টাইমিং আর গ্যাপ খুঁজে পাওয়ার ক্ষমতা তাঁর সহজাত। এখানেও প্রথম ইনিংসে ৪৭ রানে ওই বাজে শটটির আগে খেলেছেন দারুণ সব শট। দ্বিতীয় ইনিংসে আর ভুলের পথে পা বাড়াননি। কখনো তাঁর জন্য রাখা হলো দুটি গালি, কখনো দুটি শর্ট কভার, দুটি শর্ট মিড উইকেট। সেঞ্চুরির আগে আগে অফসাইড নিশ্ছিদ্র করে রাখা হলো দুটি গালি, দুটি শর্ট কভার, পয়েন্ট, শর্ট পয়েন্ট ও মিড অফ। কোনো কিছুতেই যে কাজ হয়নি, সেটার প্রমাণ তো নামের পাশে অপরাজিত ১২৬ রানেই!
দিন শেষে তামিম ইকবাল বললেন, ‘স্বপ্নের মতো ব্যাটিং করছে মমিনুল।’ নির্লিপ্ত, নিরাবেগ মমিনুলের খেলায় সাকিব আল হাসানের ছায়াও দেখতে পাচ্ছেন তামিম। নিজের মানদণ্ডটা মমিনুল ঠিক করছেন নিজেই, পরিচিত হচ্ছেন নিজের নামে। পকেট ডায়নামো!
বাংলাদেশ সময়: ২:৪৩:৫০ ৪০৩ বার পঠিত