অনলাইন প্রতিবেদক,
বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ
নাম তার আদুরী। মাত্র ১১ বছর বয়স। হাড় জিরজিরে শরীর। গৃহকর্মী এই আদুরীর কপালে কোনো দিন জোটেনি একটুখানি আদর। গৃহকর্ত্রীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে এখন সে প্রায় মৃত্যুর দুয়ারে। পুলিশ তাকে উদ্ধার করেছে ডাস্টবিনের আবর্জনার মধ্য থেকে। আধো চেতনার ঘোরে দেওয়া আদুরীর জবানবন্দি ও নিকটাত্মীয়দের সহায়তায় পুলিশ অবশেষে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে আটক করেছে সেই নির্যাতনকারী গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদীকে (৩২)।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আদুরীকে নির্যাতনের কথা স্বীকার করলেও তার বর্তমান মুমূর্ষু অবস্থার জন্য তিনি দায়ী নন বলে দাবি করেছেন। নদী জানান, দুই মাস আগে আদুরী তাঁর বাসা থেকে পালিয়ে যায় এবং অন্য কোথাও গিয়ে এ নির্যাতনের শিকার হতে পারে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার বেনজীর আহমেদ জানিয়েছেন, আদুরীর চিকিৎসা, আইনগত সহায়তাসহ সবকিছু তদারকির জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে ক্যান্টনমেন্ট থানার এএসআই আবদুল মান্নান বারিধারা ডিওএইচএস এলাকার একটি ডাস্টবিনের পাশে অর্ধমৃত অবস্থায় আদুরীকে দেখতে পান। সেখান থেকে উদ্ধার করে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আদুরীর শরীরে বিভিন্ন ক্ষতচিহ্ন দেখে নির্যাতনের বিষয়ে সন্দেহ হলেও পুলিশের কাছে কোনো তথ্য ছিল না। আদুরীও তাৎক্ষণিকভাবে তেমন কিছু জানাতে পারেনি। এ অবস্থায় পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের উপকমিশনারকে চিকিৎসাসহ সার্বিক বিষয় তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়। গতকাল আদুরীকে তার মা ও নিকটাত্মীয়রা দেখতে আসেন। তাঁদের মাধ্যমেই পুলিশ জানতে পারে আদুরী পল্লবী এলাকার একটি বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে নিযুক্ত ছিল। বাসাটি একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আবদুল কাদের মোল্লার ভাইয়ের বাড়ি হিসেবে পরিচিত। পুলিশ গতকাল পল্লবী ১২ নম্বর সেকশনের ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে দোতলা থেকে আটক করে নদীকে।
জিজ্ঞাসাবাদে নদী জানিয়েছেন, তাঁর স্বামী সাইফুল ইসলাম মাসুদ এমএলএম কম্পানি এমওয়ের কর্মকর্তা। তিনি নিজে একটি প্রকল্পে চাকরি করেন। স্বামী অনেক মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করে এখন পলাতক। বরিশালের শায়েস্তাবাদে শ্বশুরবাড়ির সুবাদে আত্মীয় ঠিকাদার চুন্নু মিয়ার মাধ্যমে গত ডিসেম্বরে আদুরীকে তাঁর বাসায় এনে কাজে লাগানো হয়। আদুরী বিভিন্ন সময় টাকা চুরি করত এমন অভিযোগ করে নদী জানান, দুই মাস আগে টাকা ও স্বর্ণালংকার চুরি করে আদুরী পালিয়ে যায়। বিভিন্ন সময় উত্তেজিত হয়ে চড়থাপ্পড় মারলেও আদুরীকে কখনো নির্যাতন করা হয়নি বলে নদী দাবি করেন।
পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের উপকমিশনার শামীমা বেগম বলেন, আদুরীর মায়ের মাধ্যমে নির্যাতনকারী হিসেবে নদীর সন্ধান মেলে। তাঁকে আটকের পাশাপাশি এ ঘটনায় আর কেউ জড়িত আছে কি না তা যাচাই করা হচ্ছে। পল্লবী থানায় এ-সংক্রান্ত একটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
আদুরীর সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার ফাতিহা ইয়াসমিন বলেন, ‘চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি আদুরীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার শরীরের এমন কোনো স্থান নেই যেখানে নির্যাতনের চিহ্ন নেই। তাকে গরম ইস্ত্রি দিয়ে ছেঁকা দেওয়া হয়েছে, ব্লেড দিয়ে হাতসহ বিভিন্ন স্থান কেটে দেওয়া হয়েছে। ঠোঁট, জিহ্বাসহ বিভিন্ন স্থানে পোড়া চিহ্ন রয়েছে। আদুরী জানিয়েছে, তাকে দিনে একবেলা শুধু ভাত খেতে দেওয়া হতো। অসুস্থ আদুরী ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। যতটুকু জানাচ্ছে, তার সূত্রেই গৃহকর্ত্রী নদীকে শনাক্ত করা হয়েছে। নদীর মা ইসরাত জাহান, বোন পুষ্পিতাসহ অন্যরাও মারপিট করতেন বলে আদুরী অভিযোগ করেছে।
গতকাল নদীকে গ্রেপ্তারের সংবাদ পেয়ে আদুরীর মামা, খালুসহ নিকটাত্মীয়রা ঢাকা মহানগর পুলিশের কার্যালয়ে গিয়ে এ পৈশাচিক নির্যাতনের বিচার দাবি করেন।
আদুরীর খালু মিজানুর রহমান বলেন, ওরা (নদীর পরিবার) এলাকার প্রভাবশালী লোক। তাই তাঁদের কাছে আদুরীকে কাজে দিয়েছিলাম। সে এ পরিবারের কাছে প্রায় দুই বছর ধরে আছে। নদীর কাছে ছিল সর্বশেষ প্রায় এক বছর। মাসে ৫০০ টাকা বেতন ছিল। আদুরীর বাড়ি পটুয়াখালীর জৈনকাঠিতে। দশ ভাই-বোনের সংসারে ঠিকমতো খাবার জুটত না বলে আদুরীকে ঢাকায় কাজে দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:২৯:২৮ ৫২২ বার পঠিত