বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ
রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক খাত নিয়ে দেশে ও বিদেশে নানা ধরনের সমালোচনা কমে যাওয়ার পর পোশাকমালিকেরাও আগের অবস্থানে চলে যাচ্ছেন। মালিকেরা এখন বলছেন, তাঁরা পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ২০ শতাংশ বা ৬০০ টাকার বেশি বাড়াতে পারবেন না।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) মজুরি বৃদ্ধির আনুষ্ঠানিক যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে নিম্নতম মজুরি দাঁড়ায় তিন হাজার ৬০০ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি দুই হাজার ৪০০, বাড়ি ভাড়া ৯৬০ ও চিকিৎসা ভাতা ২৪০ টাকা।
নিম্নতম মজুরি বোর্ডের পঞ্চম সভায় গতকাল মঙ্গলবার বিজিএমইএর পক্ষে এই লিখিত প্রস্তাব দেন বোর্ডের সদস্য ও সমিতির পরিচালক প্রতিনিধি আরশাদ জামাল। ছয় সদস্যের মজুরি বোর্ডের এই সভায় সভাপতিত্ব করেন বোর্ডের চেয়ারম্যান এ কে রায়।
এদিকে শ্রমিকপক্ষের আট হাজার ১১৪ টাকার প্রস্তাবের বিপরীতে বিজিএমইএর মাত্র তিন হাজার ৬০০ টাকার পাল্টা প্রস্তাবকে অযৌক্তিক বলেছেন মজুরি বোর্ডের দুই সদস্য—শ্রমিকনেতা ফজলুল হক ও সিরাজুল ইসলাম। মালিকপক্ষের প্রস্তাবে দ্বিমত পোষণ করেন তাঁরা।
সভা শেষে জাতীয় শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকরী সভাপতি ফজলুল হক সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে কোনো সুস্থ মানুষ বিজিএমইএর প্রস্তাব মেনে নিতে পারেন না। আর জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, আশা ছিল মালিকপক্ষ ভালো একটি মজুরির প্রস্তাব দেবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা যেটি দিয়েছেন, সেটি অমানবিক।
গতকাল বেলা ১১টায় বোর্ডের সভা শুরু হয়। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা সভা শেষে চেয়ারম্যান এ কে রায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকের সভায় (গতকাল) মালিকপক্ষের পাল্টা প্রস্তাব দেওয়ার কথা ছিল। তাঁরা সেটি যথাযথভাবে দিয়েছেন। পরে মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষের প্রস্তাব নিয়েই প্রথম রাউন্ড দর-কষাকষি হয়েছে। বলা যায়, প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা ও এর আশপাশের তিনটি এবং চট্টগ্রাম ও এর আশপাশের দুটি কারখানা পরিদর্শন করবেন বোর্ডের সদস্যরা। এ সময় শ্রমিক ও মালিক উভয় পক্ষের কথা শুনবেন তাঁরা।
এ কে রায় আরও বলেন, বোর্ডের সদস্যরা থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার পোশাক কারখানা পরিদর্শনে যাবেন। সেখানে তাঁরা শ্রমিকদের মজুরি কীভাবে দেওয়া হয়, মজুরি বোর্ড কীভাবে কাজ করে, সেগুলো পর্যবেক্ষণ করবেন। আগামী ২১ অক্টোবর মজুরি বোর্ডের পরবর্তী সভার তারিখ ঘোষণা করা হয়।
মালিকপক্ষের প্রস্তাবের পক্ষে আরশাদ জামাল বলেন, ‘শ্রমিকদের দাবির যৌক্তিকতা মেনে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানার সামর্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে এবং পোশাকশিল্পের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই প্রস্তাবটি দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা শ্রম আইনের ৪১ ধারার উৎপাদন খরচ, উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য ও শিল্পের সামর্থ্য বিবেচনা করব।
আরশাদ জামাল আরও বলেন, গত এক বছরের ব্যবধানে পোশাক উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর ২০১০ সালের নভেম্বর থেকে গত আড়াই বছরে (জুন, ২০১৩) সাধারণ মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ। মূলত মূল্যস্ফীতির এই ২০ শতাংশ সমন্বয় করে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিজিএমইএর লিখিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ডলারের বিপরীতে টাকার ৮ দশমিক ৬ শতাংশ অতিমূল্যায়নের পাশাপাশি প্রতিযোগী দেশগুলোর মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সক্ষমতা অসমভাবে কমে এসেছে। এ অবস্থায় এক তরফা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে পোশাক খাতের জন্য হুমকি ডেকে আনবে। এ ছাড়া সমিতি বতর্মান মজুরি কাঠামোর সাতটি গ্রেডের মধ্যে ৩ নম্বর গ্রেডের বিলুপ্তির প্রস্তাব দিয়েছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিজিএমইএ দেওয়ার তথ্যের মধ্যে ফাঁক আছে। গত আড়াই বছরে ১৯ দশমিক ৫৩ নয়, বরং সাধারণ মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২২ দশমিক ১ শতাংশ। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হওয়ায় এখন পোশাক মালিকদের রপ্তানিতে কিছুটা ক্ষতি হলেও আমদানি ব্যয় আগের চেয়ে অনেক কম হবে।
সিপিডির এই গবেষক আরও বলেন, নিম্নতম মজুরি নির্ধারণে খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে সঠিকভাবে খাদ্যবর্হিভূত বিষয়গুলো (শিক্ষা, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, যোগাযোগ) সমন্বয় করা হচ্ছে না। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের প্রায় সমান ব্যয় হয়। তা ছাড়া শ্রমিকেরা একটি পরিবারের সঙ্গে থাকেন। সার্বিকভাবে পরিবারের ভরণপোষণের বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মালিকদের সক্ষমতার চেয়ে শ্রমিকদের ন্যূনতম চাহিদা মেটানোই জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জানতে চাইলে পোশাকশ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, ‘বিজিএমইএ যে প্রস্তাব দিয়েছে তা আমাদের হতবাক করেছে। নিম্নতম মজুরি নির্ধারণে তাঁরা শ্রমিকদের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কোনো বিষয়ই বিবেচনায় নেয়নি। ফলে বাস্তববর্জিত এই প্রস্তাব আমরা প্রত্যাখ্যান করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিজিএমইএর প্রস্তাবে বাড়িভাড়া বাবদ রাখা হয়েছে ৯৬০ টাকা। কিন্তু এই টাকায় আজকাল বস্তিতেও কোনো ঘর পাওয়া যায় না।’
সিরাজুল ইসলাম বলেন, ২০০৬ সালের পর ২০১০ সালে নিম্নতম মজুরি বৃদ্ধি করে তিন হাজার টাকা করা হয়। তখন ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু এবার শুরুতেই বিজিএমইএ মাত্র ২০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। এতে দর-কাষাকষি হলেও খুব বেশি বাড়াতে হবে না, মালিক পক্ষ এমন চিন্তা করেই প্রস্তাব দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:১৪:৪০ ৪২৪ বার পঠিত