বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ
একমাত্র সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে কাজের খোঁজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারপর বাংলাদেশের ওই নারী পাকিস্তানে পাচার হয়ে গিয়ে সেখানে ৩৫ বছর ধরে পার করেছেন নানা চড়াই-উতরাই। অবশেষে খোঁজ পেয়েছেন বাংলাদেশে তাঁর স্বজনদের। এখন তাঁর শেষ ইচ্ছা, মরার আগে স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ।
‘দ্য ডন’ আজ শনিবার এ নারীকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭৮ সালে স্বামীকে হারানোর দুমাস পর আয়েশা বিবি তাঁর একমাত্র সন্তানের জন্ম দেন। তখন তিনি সহায়-সম্বলহীন। এর আগে হারিয়েছেন মা-বাবাকেও। দরিদ্র আয়েশার দিকে কোনো স্বজনই তখন মুখ ফিরে চায়নি।
ছেলের জন্মের আগে দুমাস ঢাকায় অন্যের বাড়িতে কাজ করেছেন আয়েশা। কিন্তু ছেলের জন্মের পর নিজের রোজগার নিয়ে আবার চিন্তায় পড়েন তিনি। এ সময় তিনি জানতে পারেন, পাকিস্তানে গেলে মোটা বেতনে কাজ পাওয়া সম্ভব। ছেলের মুুখে হাসি ফোটাতে তিনি পাকিস্তানের করাচিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এখন পাকিস্তানে পাঞ্জাব প্রদেশের চাখওয়াল জেলার নারা মুগলান গ্রামে বাসকারী আয়েশা বিবি (৬৪) ‘দ্য ডন’-এর প্রতিবেদককে বলেন, ‘কে যেন আমাকে বলেছিল, করাচিতে গেলে সেখানে মোটা বেতনে কাজ পাওয়া যাবে। তখন আমি পাকিস্তানে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই।’ তিনি আরও বলেন, ‘১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর বাংলাদেশের বিধবা ও দরিদ্র নারীদের গোপনে পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবসা ছিল।’
আয়েশা খুব বেশি লেখাপড়া জানতেন না। তাই তিনি ফাঁদে পা দেন। এক পাচারকারী তাঁর কাছ থেকে সে সময়ে তিন হাজার রুপি নিয়ে তাঁকে ভারত হয়ে পাকিস্তানে পাচার করেন।
একটা সময় তিনি বুঝতে পারেন, তিনি পাকিস্তানে কাজ পেতে যাচ্ছেন না। বরং পাচারকারী তাঁকে অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। ১৬ দিন পর আরও অনেক নারীর সঙ্গে তিনি পাকিস্তানে পৌঁছেন।
পাকিস্তানে শামসুল হক নামের এক ব্যক্তির কাছে তাঁকে ও তাঁর ছেলেকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তখন তাঁদের প্রত্যেকের দাম ছিল মাত্র পাঁচ হাজার রুপি।
এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈনিক মির্জা মোহাম্মদ হুসেনের কাছে তাঁকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। হুসেন ছিলেন বিপত্নীক। তিনি আয়েশাকে কিনে নিলেন বটে, কিন্তু তাঁকে বিয়ের প্রস্তাবও দিলেন। আয়েশা তাঁকে ফেরাননি। আয়েশা বলেন, ‘সে ছিল আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। তখন সে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেবে-নেবে করছিল। আর তখন আমার তরুণ বয়স। কিন্তু আমার সহায় হবে, এমন কাউকে আমার খুব প্রয়োজন ছিল। তাই তাঁকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই।’
সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে হুসেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কয়েক বছর কাজ করেন। তাঁরা আর কোনো সন্তান নেননি। বরং ছেলেকেই বড় করার উদ্যোগ নেন।
আয়েশার ছেলে সাজিদ মাহমুদ এখন ইসলামাবাদের এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। স্বামী হুসেন ১৯৯৭ সালে মারা যান। এরপর হুসেনের পরিবারের লোকেরা আয়েশার সব সম্পত্তি দখল করে নেয় এবং তাঁকে তাড়িয়ে দিতে চায়। স্বামীর স্বজনদের বিষয়ে আয়েশা বলেন, ‘ওরা আমাকে ভীষণ পেটাত। বিধবা হিসেবে আমি সেনাবাহিনী থেকে যেটুকু পেনশন পেতাম, ওরা মিথ্যা চিঠি পাঠিয়ে সেটিও বন্ধ করতে চেয়েছিল। ওই চিঠিতে ওরা বলেছিল, আমি নাকি আবার বিয়ে করেছি।’
অবশেষে হুসেনের চাচাতো ভাইদের অত্যাচার সইতে না পেরে আয়েশা একটি আশ্রয় কেন্দ্রে এসে ওঠে।
গত ৩৫ বছরে আয়েশা বাংলা ভাষা প্রায় ভুলে গেছেন। এখন তিনি পাঞ্জাবি, উর্দু ও বাংলা মিলিয়ে এক অদ্ভুত ভাষায় কথা বলেন।
সম্প্রতি করাচি থেকে এক দম্পতি ঢাকায় আসেন। তাঁরাই আয়েশার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তাঁর স্বজনদের খোঁজ করেন এবং সফলও হন।
এরপর আয়েশার ভাতিজি তিন মাস আগে তাঁর বাড়িতে ফোন করেন। ১৯৭৮ সালে আয়েশা যখন দেশত্যাগ করেন, তখন তাঁর ভাতিজির জন্মই হয়নি। তবুও এক ধরনের সম্পর্ক তো থাকেই। এ প্রসঙ্গে আয়েশা বলেন, ‘কয়েক মিনিট ধরে আমরা দুজন শুধু কেঁদেছি। একটা কথাও বলতে পারিনি।’
এখন আয়েশার একমাত্র ইচ্ছা, বাংলাদেশে ফিরে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করা। যদিও তাঁর না আছে পাসপোর্ট না অর্থ। তিনি বলেন, ‘এখন আমার একমাত্র ইচ্ছা ভাতিজা-ভাতিজিদের সঙ্গে দেখা করা।’
বাংলাদেশ সময়: ০:০৪:১০ ৫২০ বার পঠিত