বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ
‘জুয়েল যেন আমার লাশ না দেখে। সবার কাছে আমার একটা অনুরোধ। আমি জুয়েলের ভালোবাসার দাম দিলাম আমার জীবন দিয়ে।‘ যৌতুক দিতে না পারায় গ্রাম্য সালিসে জোরপূর্বক বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটানোর পর এমন কষ্ট ও নিদারুণ যন্ত্রণার কথা জানিয়েছেন সাবরিনা সুলতানা পারুল। ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিলেন তিনি। কিন্তু স্বামীর যৌতুকের লোভ তাঁর স্বপ্নের ঘর উড়িয়ে নিয়ে যায়। দুঃখে-অভিমানে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের পূর্ব গাজীপুর গ্রামে মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটে।
সাবরিনা সুলতানা পারুল আত্মহত্যার আগে চিরকুট লিখে গেছেন সাবরিনা সুলতানা। পুলিশ গত সোমবার বিকেলে ঘরের আড়ার সঙ্গে ওড়না পেঁচানো তাঁর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় সাবরিনা সুলতানার বাবা সূর্য্যত আলী বাদী হয়ে গত সোমবার রাতে শ্রীপুর মডেল থানায় দুই ইউপি সদস্যসহ ৯ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন। তবে পুলিশ গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
জানা গেছে, শ্রীপুরের কপাটিয়াপাড়া গ্রামের সূর্য্যত আলীর মেয়ে সাবরিনা সুলতানা পারুল। মাত্র দুই বছর বয়সে সাবরিনা সুলতানাকে দত্তক নেন পাশের পূর্ব গাজীপুর গ্রামের নিজাম উদ্দিন।
নিজাম উদ্দিন জানান, দত্তক কন্যা সাবরিনা সুলতানা পারুলকে তিনি নিজের কন্যার মতোই পালন করেছেন। গত ২০০৮ সালের দিকে সাবরিনা সুলতানার সঙ্গে একই গ্রামের মাহবুব আলমের ছেলে কায়সার আহমেদ জুয়েলের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁদের প্রেম ২০১০ সালে পরিণয়ে রূপ নেয়। বিয়ের পর সাবরিনা বধূবেশে স্বামী জুয়েলের ঘরে ওঠেন। স্বামীর ঘরে সপ্তাহখানেক সুখেই কাটে সাবরিনার। কিন্তু এক সপ্তাহ পর শ্বশুর ও শাশুড়ি নগদ দুই লাখ টাকা ও একটি মোটরসাইকেল যৌতুক দাবি করে। দাবিকৃত যৌতুকের জন্য জুয়েলের মা জায়েদা আখতার নির্যাতন শুরু করেন তাঁকে। বিয়ের মাত্র ১৮ দিন পর দাবিকৃত যৌতুকের জন্য জায়েদা আখতার চুলের মুঠি ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেন সাবরিনাকে। সাবরিনা সুলতানা শ্বশুর ও শাশুড়ির যৌতুকের দাবি মেটাতে পূর্ব গাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্ল্যান বাংলাদেশ ও আহ্ছানিয়া মিশন পরিচালিত প্রজেক্টের স্কুলে সহায়ক শিক্ষক পদে চাকরি নেন। কিন্তু চাকরি করেও শ্বশুর-শাশুড়ির যৌতুকের বিপুল চাহিদা মেটাতে পারবেন না জেনে তিনি গত ১৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর আদালতে একটি মামলা করেন। মা-বাবার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করায় ক্ষিপ্ত হন কায়সার আহমেদ জুয়েলও। জুয়েল তাঁকে তালাক দিতে ওঠেপড়ে লাগেন। জুয়েলের বাবা মাহবুব আলম গত রবিবার বিকেলে সাবরিনার বিরুদ্ধে গ্রাম্য সালিস বসান। গাজীপুর বাজারে অ্যাডভোকেট লাভলু মিয়ার চেম্বারে সালিস বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন গাজীপুর ইউপি সদস্য শাহাবউদ্দিন, তাজুল ইসলাম, মজিবুর রহমান মাস্টার, নজরুল ইসলাম ও দেলোয়ার হোসেনসহ গ্রামের মাতবররা। মাতবরদের একতরফা সিদ্ধান্তে দেনমোহরের এক লাখ ৬০ হাজার টাকা নগদ পরিশোধের পর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক তালাকনামায় স্বাক্ষর নেন সাবরিনার।
সাবরিনার পালক মা জ্যোৎস্না বেগম জানান, মাতবরদের এক তরফা তালাকের সিদ্ধান্তের পর বারবার মূর্ছা যান সাবরিনা। এ অবস্থায় জোরপূর্বক তালাকনামায় সাবরিনার স্বাক্ষর নেন মাতবররা। জ্ঞান পেরার পর সাবরিনা কান্নায় ভেঙে পড়ে মাতবরদের বলছিলেন, ‘আপনাদের পায়ে ধরি, জুয়েলকে ছাড়া আমি বাঁচব না। এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন।‘
সাবরিনার বড় ভাই জিন্নাত আলী জানান, জুয়েলের বাবা মাহবুব আলমের সঙ্গে মোটা অঙ্কের টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে দুই ইউপি সদস্য ও মাতবররা সালিস ডেকে একতরফা সিদ্ধান্তে জোরপূর্বক তালাকনামায় স্বাক্ষর নেন। বাড়ি ফিরে সাবরিনা রাতভর কেঁদেছিলেন। গত সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দরজা বন্ধ করে ঘরের আড়কাঠে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস দেন সাবরিনা।
এদিকে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন ও জোরপূর্বক তালাকনামায় স্বাক্ষর নেওয়াসহ আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে সাবরিনা সুলতানা পারুলের বাবা সূর্য্যত আলী বাদী হয়ে গত সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে শ্রীপুর মডেল থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় সাবরিনার স্বামী কায়সার আহমেদ জুয়েল, শ্বশুর মাহবুব আলম, শাশুড়ি জায়েদা আখতারসহ পালক বাবা নিজাম উদ্দিন, দুই ইউপি সদস্য শাহাবউদ্দিন ও তাজুল ইসলামকেও আসামি করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে আসামিরা পলাতক।
শ্রীপুর মডেল থানার পরিদর্শক (ওসি) আমির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশের একাধিক দল সম্ভাব্য সব স্থানে অভিযান চালাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১:০৯:৫৯ ৫৪৫ বার পঠিত