শ্যামা সঙ্গীতের রূপকথা
ঘনঘন নালিশ যাচ্ছিল মণিবের কাছে। মনিব হলেন কোলকাতার গড়ানহাটার জমিদার দুর্গাচরণ মিত্র। প্রথম প্রথম জমিদার মশাই তেমন কিছুই বলেন নি। শেষে একদিন বিরক্ত হয়ে হিসেবের খাতা সমেত তলব করলেন অকম্মার ঢেঁকি সেই মুহুরীকে। মুহুরীর কাছ থেকে থেকে হিসেবের খাতা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলেন জমিদার বাবু। আশ্চর্য ! খাতার পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে গান। হিসেবের খাতায় গান ? এতো মহা অপরাধ। হঠাৎ জমিদারের চোখ আটকে গেলো একটি গানে। গানটিতে লেখা- “ দে মা আমায় তবিলদারি, আমি নিমক হরাম নই শঙ্করী” ।
গানটি পড়তে পড়তে জমিদার বাবুর বুকটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। ছিঃ ছিঃ ! তিনি একি করছেন ? কাকে তিনি সামান্য হিসাব লেখার কাজে লাগিয়েছেন। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেলো। সামনে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছেন সেই মুহুরী। জমিদার তাকে বললেন, তুমি বাড়ি যাও বাবা। অনেক বড় কাজের জন্য তোমার জন্ম হয়েছে। সংসার চালাবার জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না। মাসে মাসে ত্রিশ টাকা তোমার বাড়িতে আমি পাঠিয়ে দেব। মুহুরী তখন খুব আনন্দিত হলেন। তিনি ফিরে এলেন হালিশহরে। তিনি নিশ্চিত হলেন। ভাবলেন ,আর চিন্তা নেই। সংসারের খরচ নিয়ে তার আর মাথা ব্যথা নেই। তিনি মনে প্রাণে লেগ গেলেন নিজ কর্মে, তার নিজ সাধনায়। অচিরেই বাংলার বুকে উদ্ভাসিত হলো অসাধারণ কালজয়ী সব শ্যামা সঙ্গীত । যে সঙ্গীতের গুণেই শ্মশান বাসিনী মা কালী হয়ে উঠলেন বাঙ্গালীর ঘরের মেয়ে। বাঙ্গালীর স্নেহময়ী মাতৃস্বরূপা । সেই সময়ের তান্ত্রিক কাপালিকদের তন্ত্র সাধনার মা কালী সাধারণ বঙ্গীয় সমাজের অঙ্গ ছিল না। আর সেই বেড়াটাই সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গেলো সেই অসাধারণ শ্যামা সঙ্গীতের গুণে। সৌজন্যে ছিলেন হালিশহরের সেই মুহুরী। তিনি আর কেউ নন , আমাদের সকলের সুপরিচিত সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন।
আনুমানিক ১৭১৮মসালে , মতান্তরে ১৭২০ সালে হালিশহরের শিবের গলিতে এক তান্ত্রিক কবিরাজ পরিবারে তার জন্ম। সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের জীবনের বহু অলৌকিক ঘটনার কথা লোক মুখে আজও প্রচলিত আছে। যেমন স্বয়ং মা কালী রামপ্রসাদের কন্যা রূপে এসে কবিকে ঘরের বেড়া বাঁধতে সাহায্য করে ছিলেন। আবার ধরুন বারানসি থেকে স্বয়ং দেবী অন্নপূর্ণা হালিশহরে রামপ্রসাদের গান শুনতে এসেছিলেন। ইত্যাকার বহু অলৌকিক ঘটনার ঘনঘটা সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের গোটা জীবন ঘিরেই ছিল। বহু মানুষ আছেন যারা এ সব বিশ্বাস করেন না, আবার তেমনি বহু মানুষ রয়েছেন, যারা পরম ভক্তি ভরে আজও এ সকল ঘটনা কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করেন। এ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের জীবনের যে সব ইতিহাস আশ্রিত ঘটনাবলী লক্ষ্য করা যায়, তা কিন্তু অলৌকিক ঘটনাগুলির চাইতে কোন অংশে কম আশ্চর্যের নয়। ইতিহাস আশ্রিত সেই সব ঘটনাবলী যদি বিশ্লেষণ করা যায় , তাহলে দেখা যাবে যে, রামপ্রসাদ সেনের অন্যতম সেরা দুটি পরিচয়। একাধারে তিনি ভক্তি রসের অনন্য সাধারণ গায়ক, অন্যদিকে তিনি অত্যন্ত এক অসাধারণ কবি যার কাব্য প্রতিভার বিচ্যুরণ এক কথায় কালজয়ী। কোলকাতার গড়ান হাটার সেই জমিদার দুর্গাচরণ মিত্র, রামপ্রসাদ সেনের সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার পর কবি হালিশহরের পৈত্রিক বাড়িতে ফিরে এসে মনপ্রাণ ঢেলে দিলেন দুই সাধনায়। এক দিকে ছিল মাতৃসাধনা অন্য দিকে ছিল মাতৃসাধনায় একের পর এক শ্যামা সঙ্গীতের ভাবের সাগরে ডুব দেয়া। প্রতিদিন ভোরে উঠে শুরু করতেন মায়ের নাম গান। একটু বেলা হলে হালিশহরে গঙ্গার ঘাটে চলে যেতেন। ( রাম প্রসাদ সেনের স্নান ঘাট –সন-১৯৭৩ , দৃষ্ট হবে )। জলে দাঁড়িয়ে গাইতে থাকেন একের পর এক গান। সেই গান শুনার জন্য গঙ্গার ধারে ভীড় জমে যেতো। নদীর বুকেও থেমে যেতেঅ সারি সারি নৌকা। রামপ্রসাদ সেন যখন গান ধরেন-
” এমন দিন কি হবে মা তারা
যাব তারা তারা ‘ বলে
তারা বেয়ে পড়বে ধারা”।
মানুষজন তখন তার নামে ধন্য ধন্য করে উঠতেন। মাঠে চাষবাসের কাজ করতে গিয়ে তিনি যখন গেয়ে উঠতেন-
”মন রে কৃষি কাজ জাননা।
এমন মানব জমিন রইলো পতিত
আবাদ করলে ফলতো সোনা। “
( চলবে)
বাংলাদেশ সময়: ২০:৫০:১২ ৩০০ বার পঠিত #রামপ্রসাদ #রূপকথা #শ্যামা সঙ্গীত